দেশব্যাপী সড়ক-মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে ও মহানগরীর সড়কে মোটরযানের গতিসীমা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সে খসড়া চূড়ান্ত হলে সড়ক-মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা কত হবে, তা নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রণালয়।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব জাতীয় মহাসড়কে যানবাহনের গতিসীমা সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ঢাকা শহরের জন্য গতিসীমা হবে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার গতকাল রবিবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৪-এর উপধারা-১ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণির সড়কে মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণ করা হচ্ছে। যেকোনো সময় এটি প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হবে। নীতিমালায় দেশের সব ধরনের সড়কে গাড়ির গতিবেগ কোথায় কেমন হবে তা বলা হয়েছে। সড়কের আশপাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি গ্রামীণ সড়কেও গতিসীমা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এটি নির্ধারণ হলে অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করবে।’
বিআরটিএ বলছে, এখনো সারা দেশে রাস্তাভেদে গতিসীমা নির্ধারণ করা আছে। তবে সব ক্ষেত্রে সেই গতিসীমা মানা হয় না। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে গতিসীমা থাকলেও অন্যান্য সড়কে থাকে না।
সড়ক-মহাসড়কে ও মহানগরীর সড়কে মোটরযানের গতিসীমা নিয়ে গত সপ্তাহে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে একাধিক সভা হয়েছে অংশীজনদের সঙ্গে। তবে বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, যদিও গতিসীমা নীতিমালা ছয় মাস আগেই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে সেটি নিয়ে বিভিন্ন সময় কাজ করাতে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করতে সময় লাগছে।
এর আগে সব শ্রেণির সড়কে মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণের জন্য গতিসীমা ম্যাপ তৈরি করা হয়। এ ম্যাপে মহাসড়কের কোন অংশে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি কত হবে, তা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক বলেন, তবে জাতীয় মহাসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েতে ৮০ কিলোমিটার মানে সব সময়ই ৮০ কিলোমিটার থাকবে তা নয়। অবস্থা অনুযায়ী গতিসীমা পরিবর্তন করতে হবে।
জাতিসংঘ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী মহানগরের সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। আর এটিকে সামনে রেখেই রাজধানীর গতিসীমা নির্ধারণ করার চিন্তা ছিল। তবে বিমানবন্দরসহ কিছু সড়কে এত কম গতিতে গাড়ি চালানো সম্ভব নয় বিধায় ঢাকার ওই ‘প্রাইমারি সড়কে’ গতিসীমা সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার করা হয়েছে বলে জানান বিআরটিএর শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই কর্মকর্তা বলেন, ২০২২ সাল থেকে গতিসীমা নির্ধারণের এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাংলাদেশে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মতো সংস্থাগুলো সাধারণত সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করে। তাই প্রতিটি সংস্থা তাদের আওতায় থাকা সড়কের ম্যাপ তৈরি করেছে।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও সড়কের সব জায়গায় এই গতিতে গাড়ি চলতে দেওয়া যাবে না। সড়কের পাশে যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা অফিস-আদালত রয়েছে, সেখানে যানবাহনগুলোকে গতি কমানোর নির্দেশক দেওয়া হবে। হাটবাজার এলাকার জন্যও আলাদা গতিসীমা নির্ধারণ করা হবে। গতিসীমা আরোপের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক এসব বিষয় ছাড়াও সড়ক অবকাঠামোর বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘খুব দ্রুত প্রজ্ঞাপন হয়ে যাবে। হয়তো এক-দুই দিন সময় লাগবে।’
মহাসড়কে ৮০ ও ঢাকা মহানগরে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন যদি হয় তাহলে সেটিই দেখতে পাবেন।’
তবে সড়ক-মহাসড়কে গতিসীমা নির্ধারণ করা হলেও পরিবহনচালকরা তা মেনে চলছেন কি না, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেট নেই পর্যাপ্ত। সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট বহাল থাকার কথা থাকলেও এখন কাজ করছেন মাত্র পাঁচজন। চট্টগ্রামে তিনজনের স্থলে একজন, খুলনায় একজন, ময়মনসিংহে একজন রয়েছেন। সিলেট, রংপুর ও বরিশালে বিআরটিএর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নেই।
এনফোর্সমেন্ট বিভাগ শূন্য পদে নিয়োগের আবেদন জানিয়ে ছয় মাস ধরে চিঠি চালাচালি করলেও আশানুরূপ সাড়া মিলছে না বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বিআরটিএর অভিযানে ঢাকায় সিটি করপোরেশন, ডিএমপি, ডিটিসিএর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। বাইরে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা সহায়তা করছেন। বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়ানো হবে শিগগির। তাতে সংস্থাটির কার্যক্রমেও গতি বাড়বে।
এর আগে ২০১৫ সালে দেশের মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছিল জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। ২০১৫ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলাচল ঠেকাতে গাড়িতে ‘স্পিড গভর্নর’ নামের একটি যন্ত্রও বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
সড়কে গতিসীমা নীতিমালা নিয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘কোন সড়কে গতিসীমা কত হবে তা কিন্তু সরকার নির্ধারণ করে দেয় না। নির্দিষ্ট এলাকার সড়কে গতি কত হবে তা ওই এলাকার সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীরাই ঠিক করে দেবেন। এখন সড়কের কোনো সেকশনে গতি কমাতে হলে সড়কের শ্রেণিভেদ অনুযায়ী তার গতিসীমা ঠিক করতে হবে। আমাদের সড়ক আধুনিকায়ন করা হয়েছে গতি বাড়ানোর জন্য। এখন সেই সড়কে হুট করে গতিসীমা কমিয়ে দিলে তাতে গণপরিবহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।’
বুয়েটের অধ্যাপক ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব এক্সপ্রেসওয়ে করা হচ্ছে, সেগুলোর জ্যামিতিক নকশার সঙ্গে গতি নির্ধারণের বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক্সপ্রেসওয়ে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে ১০০ কিলোমিটার গতিবেগে গাড়িগুলো চলতে পারে। এখন সেই গতিসীমা কমিয়ে আনা হলেও সড়ক কাঠামোর কারণে সেই গতি সহজে কমিয়ে আনা যাবে না। অনেক গাড়িচালক মামলার ফাঁদে পড়বেন।’
অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মতে, সড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এখন সড়কে গতিসীমা নীতিমালা করতে যাচ্ছে বিআরটিএ। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরাও সড়কে যান চলাচলের গতিসীমা বাড়াতে বিনিয়োগ করেছি। এখন গতি নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ এনে নীতির বিষয়ে প্রশ্নই সামনে আনা হচ্ছে।’