করোনার ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। তার পরও বছরের ব্যবধানে কোনো লোক বেকার হননি বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দাবি করেছে।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। গত বছরের একই সময়েও বেকার ছিলেন ২৫ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে এই তিন মাসে দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়েনি। বছরের ব্যবধানে বেকারত্বের হারও বাড়েনি। প্রথম প্রান্তিকে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। গত বছরের এই সময়ে তা-ই ছিল।
সোমবার (৬ মে) বিবিএসের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করে। এই জরিপ প্রতিবেদনে চলতি বছরের গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ের বেকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে দেশের মোট জনসংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১৭ কোটি ২৯ লাখ। এর মধ্যে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সী কর্মক্ষম লোকসংখ্যা হচ্ছে ১২ কোটি ২০ লাখ। পুরুষের সংখ্যা ৬ কোটি ১ লাখ এবং নারী ৬ কোটি ১৮ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিবিএস যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ যতই দিন যাচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লোকজন বেকার হচ্ছেন। এ ব্যাপারে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিবিএস যেভাবে বেকারের সংখ্যা বের করে, সে পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আমরা বারবার বলছি, এটা ঠিক নয়। কারণ তারা জানতে চায় গত সাত দিনে এক ঘণ্টা কাজ করারও সুযোগ হয়েছে কি না। অনেকে মানসম্মানের ভয়ে তা বলতে চান না। আবার বিশ্বমন্দার প্রভাবে শ্রমবাজারেও লোক কমে গেছে। প্রশিক্ষণ কমে গেছে। শিক্ষাতেও কমেছে কর্মক্ষম লোক। এসব ক্ষেত্রে বেকার লোকের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ হতে পারে। বিবিএস তাদের জরিপে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটায়, তা দেখার বিষয়। তারা ৪ শতাংশও বেকার দেখায় না।’
ড. মোস্তাফিজুর আরও বলেন, ‘গত বছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে। সরকারি বিনিয়োগও কমে গেছে। তাহলে বেকারের সংখ্যা তো বাড়বেই। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ কৃষি খাতে সারা বছরই টুকটাক কাজ লেগে থাকে। তার পরও এখানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে গেছে। যে করেই হোক, বেকারের হার কমাতে হবে। শ্রমিকরা ভালো থাকলে মালিকের উৎপাদন বাড়বে। এর ফলে রপ্তানিও বাড়বে। অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠবে।’
তৈরি পোশাকশিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে আমরা কঠিন অবস্থায় পড়েছি। কারণ বায়াররা মূল্য বাড়াচ্ছেন না। প্রতিনিয়ত অর্ডার কমে যাচ্ছে। আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ অর্ডার কমে গেছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে অনেকেই বেকার হয়ে পড়ছেন। যেভাবে কারখানা বন্ধ হচ্ছে, সেভাবে কেউ নতুন করে কারখানা গড়ে তুলছেন না।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়মকে আমলে নিয়ে বিবিএসও বলছে, বেকার তারাই, যারা গত সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ পাননি। কিন্তু কাজ করার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন। গত এক মাস ধরে বেতন বা মুনাফার জন্য কোনো না কোনো কাজের খোঁজে ছিলেন।
বিবিএসের জরিপ বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। তাদের মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে ২৫ লাখ ৯০ হাজার মানুষ বেকার ছিলেন। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেও সেই অবস্থাই রয়ে গেছে অর্থাৎ বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। মানে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বেকারের সংখ্যা আর বাড়েনি। বর্তমানে বেকারের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০২৩ সালেও বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।
প্রথম প্রান্তিকে বেকারের সংখ্যা না বাড়লেও পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, নারী বেকার কমেছে। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, গত মার্চ মাস শেষে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (মার্চ-জানুয়ারি) সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ১০ হাজার। গত বছরের এই সময়ে ৮ লাখ ৮০ হাজার নারী বেকার ছিলেন। এখন নারী বেকারের সংখ্যা ৩০ হাজার কমে ৮ লাখ ৫০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
শ্রমশক্তির বাইরেও বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নন, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নন। বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে এমন জনগোষ্ঠীভুক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা হচ্ছেন সাধারণ ছাত্র, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক নারী-পুরুষ, কাজ করতে অক্ষম ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং কর্মে নিয়োজিত নন বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক গৃহিণী। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে এই সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার।