ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের চার ধাপের নির্বাচনে দেশের ৯ জেলার ৬৯টি উপজেলায় ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) পদ্ধতিতে ভোটের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আধুনিক এই পদ্ধতিতে ভোটদানে তরুণ ভোটারদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ থাকলেও কিছুটা শঙ্কায় রয়েছেন স্বল্প শিক্ষিত ও প্রবীণ ভোটাররা। একই সঙ্গে অনেক উপজেলায় ইভিএম ভোটদানের পদ্ধতি সম্পর্কে এখনো পর্যাপ্ত প্রচার ও প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে ভোট গ্রহণের সময় বেশি সময় ক্ষেপণ এবং নির্ধারিত সময়ে ভোটদান শেষ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রার্থীরা।
আগামীকাল বুধবার (৮ মে) প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৪২টি উপজেলার মধ্যে ২২টিতে ভোট গ্রহণ হবে ইভিএমে। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ১৬০ উপজেলার মধ্যে ২৪টিতে, তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলার মধ্যে ২১টিতে এবং সর্বশেষ চতুর্থ ধাপে ৫৫টির মধ্যে দুটি উপজেলায় ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হবে।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে যেসব উপজেলায় ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হবে, সেসব উপজেলায় এই পদ্ধতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং ভোটারদের ভোটদানের পদ্ধতি সম্পর্কে জানানোর সার্বিক ব্যবস্থা আগেই নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে প্রয়োজনীয় ইভিএম যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে বাকি তিন ধাপে যেসব উপজেলায় ইভিএমে ভোট হবে, সেসব উপজেলায়ও একইভাবে এই পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের সার্বিক প্রস্তুতি চলছে।
ইভিএম পদ্ধতির ভোটে মাঠের প্রস্তুতি
প্রথমবারের মতো আগামীকাল ৮ মে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হবে মানিকগঞ্জের সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলায়। জেলা নির্বাচন অফিস ইভিএমে ভোটের প্রস্তুতি নিয়েছে। সিংগাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের মেদুলিয়া গ্রামের ভোটার মাসুম বাদশা বলেন, ‘বিভিন্ন নির্বাচনে আমরা ব্যালট পেপারে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত। এই মেশিনে ভোট দেওয়ার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই। হরিরামপুর উপজেলার চালা ইউনিয়নের সট্টি গ্রামের ভোটার আনিছা আক্তার লাবণী বলেন, ‘প্রথমবার ইভিএম মেশিনের মাধ্যমে ভোট দেব- বিষয়টি ভালো লাগছে। তবে কীভাবে ভোট দিতে হবে, সে সম্পর্কে যদি আগে কোনো ট্রেনিং কিংবা নমুনা ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো তাহলে ভালো হতো।’
সিংগাইর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী সায়েদুল ইসলাম বলেন, ‘ইভিএমে অনেকেরই ভোটের ধারণা নেই। ব্যালট পেপারে ভোট হলে বয়স্কদের জন্য সুবিধা হতো। তবে ইভিএমের ভোটে আমার আস্থা আছে। এ ছাড়া ভোটের ফলও কম সময়ে পওয়া যায়।’
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ আমিনুর রহমান মিঞাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে প্রচার চালিয়েছি, তবে নমুনা ভোটের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তার পরও সমস্যা হবে না আশা করছি। কারণ ভোটের দিন সকাল থেকেই রেপ্লিকা মেশিন দিয়ে লাইনে থাকা ভোটারদের দেখানো হবে কীভাবে ইভিএমে ভোট দিতে হয়।’
পাবনার বেড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী রেজাউল হক বাবু বলেন, ‘ইভিএমে ভোট কারচুপির সুযোগ নেই। তবে ইভিএমের বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা কম, অনেকের আঙুলের ছাপ মিলতে চায় না। ফলে অনেক সময় ভোট গ্রহণে বেশি সময় লাগে। ফলে নির্ধারিত সময়ে ভোট শেষ করা সম্ভব হয় না। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও প্রচারের অভাবে ভোগান্তির আশঙ্কা স্থানীয়দের। গ্রামের সাধারণ মানুষের আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে ধারণা কম থাকায় ইভিএমে ভোটদান ও ভোট গ্রহণেও বেশি সময় লাগে বলে জানান জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান। তার পরও ইভিএমে ভোটের পদ্ধতি সম্পর্কে জানাতে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে প্রচার চালানো হয়েছে।’
সিরাজগঞ্জে (সদর, কাজীপুর ও বেলকুচি) তিনটি উপজেলায় ইভিএমে ভোট হবে। ইভিএমে প্রথমবারের ভোট দেওয়ার জন্য তরুণ ভোটারদের মধ্যে অনেক উৎসাহ কাজ করলেও গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজে যুক্ত। অনেকেই এগুলোর ব্যবহার ভালোভাবে জানেন না। এ ছাড়া বয়স্কদের জন্য ইভিএম অনেক অসুবিধা বলে মনে করেন অনেকে। তা ছাড়া আঙুলের ছাপ না মেলা ও নানা কারণে ইভিএমে ভোট দিতে অনেক দেরি হয়।
জেলার কাজীপুর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ জানান, ইভিএম সম্পর্ক চরের মানুষ এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, অনেকেরই এই যন্ত্র সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। যার কারণে ভোট দিতে গিয়ে অনেক দেরি হয়। যদি তাদের বারবার প্রশিক্ষণ দেওয়া যেত তাহলে ভালো হতো।
এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনে যারা দায়িত্বে থাকবেন মাঠপর্যায়ে সব কর্মকর্তাকে নিয়ে ইভিএম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কর্মশালা হয়েছে। ইভিএমে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে ভোটারদের আগ্রহ বাড়াতে গ্রাম ও পাড়া-মহল্লাগুলোতে ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে ভোট দেওয়া দেখানো হচ্ছে। আশা করছি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আমরা উপহার দিতে পারব।’
চাঁদপুরের দুই (মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ) উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে ইভিএমে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ধাপে (চাঁদপুর সদর, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি) তিন উপজেলায়, তৃতীয় ধাপে (কচুয়া ও ফরিদগঞ্জ) দুই উপজেলায় ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ তোফায়েল হোসেন জানিয়েছেন, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের ইভিএম বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের ইভিএমে ভোটের ধারণা দিতে এ বিষয়ে প্রচারে প্রার্থীদেরও সার্বিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ইভিএম যন্ত্রগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা সম্পন্ন হয়েছে।
ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেছেন, ‘ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও প্রার্থীদের কাছ থেকে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। চার ধাপে ৬৯টি উপজেলায় ইভিএমে ভোটের আনুষ্ঠানিকতা চলছে। এ পর্যন্ত ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে আমরা প্রার্থীদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি। ভোটারদের সচেতনতার অভাব, আঙুলে ছাপ মেলাতে কিছুটা ভোগান্তি আগে কিছুটা থাকলেও এ পর্যায়ে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে মাঠপ্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আশা করি ভোট গ্রহণে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হবে না।’
[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, জামালপুর, যশোর, পাবনা, শরীয়তপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি]