উৎপাদন সক্ষমতায় ঘাটতি না থাকলেও জ্বালানিসংকটের কারণে দেশে চাহিদার সবটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া এই গ্রীষ্মে অত্যধিক গরম ও তাপপ্রবাহ থাকার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৫টি। উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়যোগ্য জ্বালানিসহ)। পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে গত ২২ এপ্রিল রাত ৯টায়। সে সময় উৎপাদন হয়েছিল ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট। একই সময়ে লোডশেডিং হয়েছে ৪৪৬ মেগাওয়াট। এরপর গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই বাড়ছে লোডশেডিং। এর মধ্যে গত সোমবার ঘণ্টায় সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে দিনের বেলায় ঘণ্টায় তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে। গড়ে উৎপাদন করা হচ্ছে ১৩ হাজার থেকে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। চাহিদা আছে সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট।
গত রবিবার জাতীয় সংসদের অনির্ধারিত আলোচনায় বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক বলেন, গ্রামে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং, তাহলে বিদ্যুৎ গেল কোথায়? ‘সরকার বলেছে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা আছে, তাহলে বিদ্যুৎ গেল কোথায়?’ জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘এখন কমবেশি ১৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে।’ লোডশেডিংয়ের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন জাপার আরেক সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে। সারা দেশে তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর কাছে জানতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সমস্যা দ্রুত সমাধানের নির্দেশ তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গ্রামে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।’ পরিস্থিতি তুলে ধরে ১৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কথা জানান প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও অনেক। পিজিসিবির হিসাবে গত সপ্তাহে সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল ৩ হাজার ১৯৬ মেগাওয়াট। দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) একাই লোডশেডিং করেছে ৩ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, গ্রামের মানুষকে লোডশেডিং থেকে কিছুটা স্বস্তি দিতে এবার রাজধানী ঢাকায় লোডশেডিং নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। সেই পরিকল্পনায় প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের চিন্তা করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি, ওজোপাডিকো, নেসকো ও আরইবি। এর মধ্যে দেশের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ করে আরইবি। লোডশেডিংয়ে ভুগছেন মূলত এ সংস্থার গ্রাহকরা। মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের ৫৫ শতাংশই এ সংস্থার অধীন।
পিডিবির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কয়েক দিন ধরে গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে গত সপ্তাহে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ভারতের ঝাড়খন্ডের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। পিজিসিবির গ্রিডে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকায় ওই সময় কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট উৎপাদন শুরু করে। এরপর উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়ছে।
আরইবির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত বৃহস্পতিবার আরইবির বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট। এ সময় তারা সরবরাহ পেয়েছে ৫ হাজার ৯৯৭ মেগাওয়াট। ৩৭ শতাংশ ঘাটতি তারা পূরণ করেছে লোডশেডিং দিয়ে। এতে দেশের একটি বড় অংশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পায়নি মানুষ। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এরপর চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট অঞ্চল ছাড়াও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বরিশাল অঞ্চলেও কিছুটা লোডশেডিং হয়েছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস ও কয়লা থেকে পরিকল্পনা মতো উৎপাদন হচ্ছে। তবে বকেয়া বিলের জটিলতায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোদমে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এটি তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি করা যাচ্ছে না।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন জানান, গরমের সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। জ্বালানি তেলচালিত কেন্দ্র থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আদানির কেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় ঘাটতি বেশি হয়েছে।
লোডশেডিং পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, কাগজে-কলমে যে পরিমাণ লোডশেডিং বলা হয় প্রকৃত লোডশেডিং আরও বেশি। গ্রামের কেউ কেউ ৮০ ভাগ সময় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। এটা বৈষ্যমমূলক আচরণ। এমনকি লোডশেডিং সংকটে সেচ ব্যাহত হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘এখন সর্বোচ্চ গরম পড়ছে। গরম কমার আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। গ্যাসসংকটের কারণে উৎপাদনের সব সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আমরা এখন শহর ও গ্রামে লোডশেডিং ভাগ করে দিচ্ছি। আগে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় লোডশেডিং করা হতো না।’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক শামীম হাসান বলেন, ‘আমরা আমাদের চাহিদা মতো গ্যাস পাচ্ছি না। ফলে বিদ্যুতের যে চাহিদা, সেই অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের কিছু প্ল্যান্ট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কিছু প্ল্যান্ট তার ক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদনে চালাতে হচ্ছে। আর এখন বিদ্যুতের তো পিক আর অফপিক নেই। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে দিনে-রাতে সব সময় বলতে গেলে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় সমান। আমরা চাহিদার চেয়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে পিছিয়ে আছি।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিটওয়েভ কমে গেলে ৫০০ মেগাওয়াট চাহিদা কমবে। তারপরও গরম থাকবে। তখনো লোডশেডিং করতে হবে। তবে এত খারাপ হবে না।
এদিকে গত কয়েক দিন ধরে আন্দোলনে রয়েছেন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণসহ অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়নের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে রয়েছেন সারা দেশে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী। গত রবিবার সকাল ৯টা থেকে দেশের ৮০টি পবিসের সদর কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।