জ্ঞান অর্জনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের পাশাপাশি অন্যান্য এলাকার মানুষের জন্য ১৯০৫ সালে অক্সফোর্ড থেকে অনেক বই আনিয়েছিলেন। সাহিত্যে পাওয়া তার নোবেল পুরস্কার দেখতে কেমন, জাদুঘরে রাখার জন্য তারও একটি ছবি দিয়েছে শান্তিনিকেতন কর্তৃপক্ষ। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবী ২ হাজার টাকা ধার চেয়ে এস্টেটের ম্যানেজারের কাছে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তাও দেখার সুযোগ নেই দর্শক-পর্যটক আর রবীন্দ্র গবেষকদের।
পতিসরে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর’ ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিসংবলিত এ রকম অনেক নিদর্শনেরই জায়গা দিতে পারেনি গত ২৪ বছরেও। কিন্তু স্থানীয় জনগণ চান এসব টিকে থাকুক শত শত বছর, আর সে কারণেই রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউটের একটি শ্রেণিকক্ষে অন্যান্য নিদর্শনের পাশাপাশি এগুলোও রাখা হয়েছে। ওই শ্রেণিকক্ষটিকে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা’ করা হয় ২০১৪ সালে।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের জমিদারি পৈতৃক হলেও নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পতিসরে কালীগ্রাম পরগনা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব। জমিদারির প্রয়োজনে তিনি পতিসরে প্রথম আসেন ১৮৯১ সালের জানুয়ারিতে। ১৯৪১ সালের ৭ আগষ্ট মারা যাওয়ার ৪ বছর আগে তিনি এখানে শেষ বারের মতো আসেন ১৯৩৭ সালে। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রথম বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাচারি বাড়িতে চালু করেন ডাকঘর, আর ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি সমবায় ব্যাংক। কৃষির উন্নয়নে তিনি আনেন কলের লাঙল, শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে পুত্রের নামে প্রতিষ্ঠা করেন রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউট।
এর আগে ১৯০৫ সালে পতিসরে মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এলাকার মানুষের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেন কবিগুরু। স্থানীয় বাসিন্দা রবীন্দ্রপ্রেমী মতিউর রহমান মামুন কবি ও তার পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিসংবলিত নিদর্শন উদ্ধারে কাজ শুরু করেন ২০০৩ সালে। গত ২১ বছরে তিনি নাটোর ও নওগাঁর বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করেছেন কৃষি ব্যাংকের জলছাপযুক্ত লেজার, নিজ হাতে লেখা কবির বায়োগ্রাফি, আয়না, আলমিরা ও সিন্দুকসহ অনেক কিছুই। তিনি এসব দিতে চেয়েছিলেন ‘রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর’ কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তারা নেয়নি।
মতিউর রহমান বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেও যখন এসব জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে দিতে পারিনি, তখন স্থানীয় জনসাধারণ ও রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি।’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০০৯ সালে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করলেও রবীন্দ্রপ্রেমিক, গবেষক আর দর্শনার্থীদের জন্য দুই যুগেও সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই এলাকায় নেই কোনো রেস্তোরাঁ, সুযোগ নেই রাত্রিযাপনের। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, কবির মূল্যবান স্মৃতিজড়ানো নিদর্শন দীর্ঘ সময়ের জন্য সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আধুনিক জাদুঘর। গবেষক আর দর্শনার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে এখানে থাকা ও ভালো মানের খাবারের।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মুনিহারি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক বখতের অভিযোগ, কবির স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। সুযোগ- সুবিধার অভাবে দর্শকের সংখ্যাও বাড়ছে না আশানুরূপ। তিনি বলেন, ‘পতিসর কাচারি বাড়িকে সরকার গুরুত্ব দেয় শুধুমাত্র ২৫ বৈশাখ কবির জন্মজয়ন্তীতে। আমরা চাই সরকার যেন সারা বছরই এ কাচারি বাড়িকে গুরুত্ব দেয় আর দর্শনার্থী, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে।’
পতিসর কাচারি বাড়ির দায়িত্বে আছেন সুকেল শর্মা। তিনি জানান, এ কাচারি বাড়িতে প্রতিদিন গড়ে দর্শনার্থী আসেন ৭০ জন। ঈদের ছুটি ও জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আসেন হাজার হাজার মানুষ। এ প্রসঙ্গে সুকেল শর্মা বলেন,‘গত ঈদুল ফিতরের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই কাচারি বাড়িতে এসেছিলেন প্রায় ৮শ দর্শনার্থী।’
মতিউর রহমান মামুন অভিযোগ করেন, ‘প্রত্ন আইন লঙ্ঘন করে আড়াল করা হয়েছে কাছারি বাড়ি, প্রশাসন বাড়ির সামনে তৈরি করেছে পার্ক। যেখানে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে এলোপাতাড়ি দোকানপাট। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সামনেই কাছারি বাড়ির কাছে দখল হয়েছে কবির স্মৃতিবিজড়িত নাগর নদের বিভিন্ন অংশ, বাদ যায়নি দৃষ্টিনন্দন রবীন্দ্রদিঘির পাড়ও। ওই নদকে কেন্দ্র করেই কবি লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি/ দুই কূল উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি…’।
পতিসর কাচারি বাড়ি দেখভাল করার দায়িত্বে আছেন নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার ‘পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার’ সাইটের কাস্টোডিয়ান মো. ফজলুল করিম। তিনি জানান, জন্মজয়ন্তীর উৎসবকে কেন্দ্র করে পতিসরে আসেন হাজার হাজার দর্শক। তাদের সবার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। কিন্তু অন্যান্য সময় তাদের বসার জায়গা আছে। পানিও পান করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পতিসর কাচারি বাড়ির সমস্যাগুলো সমাধানে কর্তৃপক্ষ কি উদ্যোগ নিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে মো. ফজলুল করিম বলেন, ‘নওগাঁর সবগুলো সাইট নিয়ে বড় একটি প্রকল্প করার পরিকল্পনা আছে। তখন এই মূল্যবান সাইটটিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’ ১৯১৩ সালে নোবেল বিজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে বসেই রচনা করেছিলেন চিত্রা, পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, গোরা ও ঘরে বাইরের অংশবিশেষ, আর বঁধু মিছে রাগ করো না বিখ্যাত সেই রবীন্দ্র সংগীতসহ অনেক কবিতা ও প্রবন্ধ।