আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সুপার ট্যাক্স গ্রুপ অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি আয়ের মানুষের ওপর ধার্যকৃত বার্ষিক করের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, অতিরিক্ত সম্পদ থাকার কারণে মাশুল হিসেবে নির্দিষ্ট হারে প্রদেয় কর ‘সারচার্জের’ সবোর্চ্চ হার বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এক কোটি টাকার বেশি কর বকেয়া আছে, এমন সব করদাতার কাছ থেকে কর আদায়ে বাজেটে আইন করে কঠোরতা আনার হিসাব কষা হয়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আসছে বারের প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি পরিমাণের কর অব্যাহতির ছক আঁকা হয়েছে। শিল্পের অনেক খাতে কর অবকাশ সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাধারণ করদাতাদের ওপর কর কমিয়ে ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে এবং করের আওতা সম্প্রসারণ করে আদায় বাড়ানো উচিত।’
আইএমএফসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর চাপ থাকলেও এনবিআর এর বিরোধিতা করছে। ন্যূনতম করের হার কমানোরও পক্ষে নয় রাজস্ব আদায়কারী সরকারি সংস্থাটি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে এসব প্রস্তাব প্রণয়ন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব প্রস্তাব খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে। এনবিআরের এসব প্রস্তাবনা শেষ পর্যন্ত রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
সূত্র জানায়, আইএমএফের সুপারিশে এনবিআরের প্রস্তাবে কর আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে ই-পেমেন্টে কর পরিশোধ উৎসাহিত করা হয়েছে। অনলাইনে করদাতা সংগ্রহ এবং রিটার্ন দাখিলে কড়াকড়ি আনা হয়েছে। এনবিআর কর শাখার কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব কার্যালয় বাড়ানোর প্রস্তাবও থাকছে। ভূমি রেজিস্ট্রেশন, সিগারেট, মোবাইল, ভ্রমণ কর, পরিবেশ সারচার্জ, কার্বোনেটেড বেভারেজে করের এবং করের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইএমএফের সুপারিশে প্রণীত এনবিআরের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘ন্যূনতম ১০ বছর ধরে কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ ধরনের শিল্প খাত। এসব শিল্পের বেশির ভাগ খাত থেকে কর অবকাশ সুবিধা বাতিল করে করের আওতায় আনা হলে রাজস্ব বাড়বে, যা বাজেট ঘাটতি কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। ১০ বছর ধরে কর অবকাশ সুবিধা পাওয়া শিল্প খাতের মধ্যে রয়েছে ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষি যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স শিল্প, অটোমোবাইল, বাইসাইকেল, গাড়ির টায়ার, নির্মাণসামগ্রীর ইট কিংবা রড রপ্তানি করে- এমন কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, পোলট্রি শিল্প, প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্প ও মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ। তৈরি পোশাকশিল্প এবং প্রযুক্তি খাতেও রয়েছে বড় অঙ্কের রাজস্ব ছাড়। দীর্ঘদিন ধরে দেওয়া এসব সুবিধা কমাতে হবে।’
এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘বছরের পর বছর ঢালাও কর ছাড়ের সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। শিল্প খাতে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কর ছাড়ের সুবিধা কমাতে হবে। এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে।’
কর ছাড়ের বিরোধিতা করে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বড় মাপের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে কর সুবিধা কমানো বা প্রত্যাহার করা হলে সমগ্র অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সময় দিয়ে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। যত চাপ বড়দের ওপর। এটা তো ঠিক নয়। আমাদের কথা বিবেচনা করতে হবে।’
অতিরিক্ত সম্পদ থাকার মাশুল হিসেবে নিয়মিত করের পাশপাশি সম্পদশালীদের বাড়তি কর (সারচার্জ) দিতে হয়। বর্তমানে নিট পরিসম্পদের মূল্য ১০০ কোটি টাকা অতিক্রম করলে ৩৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর দিতে হয়। এ হার আরও ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেক দিন ধরে এ কর কমানোর জোরালো দাবি থাকলেও আগামী অর্থবছরের বাজেটে তা আমলে আনা হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের বাজেট প্রস্তুতির এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘ধনীদের সারচার্জ প্রদান সমস্যা নয়। এর হার বাড়ানো যৌক্তিক। তবে আমাদের দেশের ধনীরা ক্ষমতাবান, সমাজের প্রভাবশালী। শেষ পর্যন্ত সারচার্জ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’