যশোর শহরের মাওলানা মোহাম্মদ আলী রোড (এম এম আলী) রোডে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী জেলা শাখা। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটির প্রধান ফটক ধরে এগোতেই কানে ভেসে এলো নাচ আর গানের মহড়ার শব্দ। পরে দেখা গেল, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে চলছে কচি-কাঁচাদের নাচের মহড়া। প্রশিক্ষক দেখিয়ে দিচ্ছেন নাচের ভঙ্গিসমূহ। কোন জায়গায় কোন তাল। এ যেন নৃত্যকে নিখুঁত করার ঘষামাজার শেষ পর্যায়। আরেকটু পথ এগিয়ে গেলেই আরেকটি কক্ষ। সেখানে তবলা আর হারমনিয়ামের সঙ্গে দলবেঁধে চলছে গানের চর্চা। এসো হে বৈশাখ, এসো এসো....।
উদীচী কার্যালয় থেকে বেরিয়ে মিনিট তিনিকের পথ এগোতেই পৌর পার্ক। পার্কের ভেতরে আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন চারুপীঠ। সেখানে অনেকে মিলে বাঁশ দিয়ে তৈরি করছেন বিশাল আকৃতির মোরগ ও পুতুল। কাগজ কেটে ফুল, প্যাঁচা, পাখপাখালির আদল গড়ছেন কেউ কেউ। গভীর মনোযোগে কেউবা জলরঙে ছবি আঁকছেন, কেউবা নকশা করছেন কাগজে। নানা আকৃতি ও ধরনের মুখোশে দেওয়া হচ্ছে রং তুলির পরশ।
শুধু এই দুটি সংগঠন নয়, যশোর শহরের অন্তত ২৫টি সাংস্কৃতিক সংগঠন শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী। বিবর্তন, উদীচী, পুনশ্চ, চাঁদের হাটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে চলছে গান, নাচ, নাটক, কবিতা আবৃত্তি ও গীতিনাট্যের মহড়া। বর্ণিল উৎসব ঘিরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তৈরি করেছে ভিন্ন আঙ্গিকের আমন্ত্রণপত্রও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলা বর্ষবরণে যশোরের ঐতিহ্য চার দশকের বেশি। করোনা সংক্রমণ ও রমজানের কারণে গত চার বছর নববর্ষের উৎসব ছিল অনেকটা ঘরবন্দি ও সংক্ষিপ্ত। এবার ঈদুল ফিতরের পরপরই পহেলা বৈশাখ হওয়ায় আনন্দ দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।
পহেলা বৈশাখে বর্ণিল সাজে ঢাক-ঢোলের বাদ্যে মাততে প্রস্তুত হচ্ছে সংগঠনগুলো। বরাবরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখে জেলার ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দান থেকে সকাল ৯টায় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে। এবার পহেলা বৈশাখটি যশোরবাসীকে পরিপূর্ণতা দিতে প্রায় তিন দশক পর যোগ হয়েছে ১০ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। শহরের ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানে ১৩ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত।
যশোর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, ‘কোভিড ও রমজানের কারণে পরপর চার বছর সাড়ম্বরে বৈশাখী উদযাপন করতে পারিনি। এ বছর আমরা চেষ্টা করছি যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এবং যশোরের শিল্পী সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে নববর্ষকে একটি বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য আয়োজন উপহার দেওয়ার। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈকালিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এ ছাড়াও এবার বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। আর এ মেলার সঙ্গে থাকবে লোক সাংস্কৃতিক উৎসব। এ সাংস্কৃতিক উৎসবে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অংশ নেবে। এর মাধ্যামে বৈশাখী যে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব এবং সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে প্রচেষ্টা তা এর মাধ্যামে অব্যাহত থাকবে।’
বর্ষবরণের প্রধান অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভাষ্য, দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৯৮৫ সালে সূচনা হয় সংস্কৃতি যশোর শহর থেকে। সেই সময়ে ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহবুব জামাল শামীম আরও দুই সহপাঠীকে নিয়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন চারুকলার প্রতিষ্ঠান চারুপীঠ। এই প্রতিষ্ঠানই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার।
চারুপীঠের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘পয়লা বৈশাখে যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রার বর্ণাঢ্য ইতিহাস আছে। যশোরে প্রথম দিন যে উদ্দীপনায় বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করা হয়েছিল, আমরা সেখান থেকে একচুলও সরে আসিনি। এবারও চারুপীঠের পক্ষ থেকে শোভাযাত্রায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
উদীচী যশোর ৫০ বছর ধরে পৌর উদ্যানে নববর্ষের প্রথম প্রভাতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। যশোর শহরের শত শত মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন পোশাকে, নতুন সাজে সেই আয়োজনে শামিল হয়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব জানান, এ বছরও বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি তাদের। সকাল ৭টায় পৌর উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।
বিবর্তন যশোরে সভাপতি নওরোজ আলম খান চপল বলেন, ‘বরাবরের মতো এবারও আমাদের ব্যতিক্রমী আয়োজন থাকছে আমন্ত্রণপত্রে। মিষ্টিমুখ, শোভাযাত্রা, নাটক, নৃত্য সংগীতে সঙ্গে এবার প্রধান আকর্ষণ তোতারাম নাটক মঞ্চায়ন।’
এদিকে বাংলা নববর্ষ ঘিরে এবার টাউন হল ময়দানে ১০ দিনব্যাপী লোকজ সাংস্কৃতিক উৎসব ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও যশোর ইনস্টিটিউট। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এই মেলার সার্বিক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সংশ্লিষ্ঠরা।
কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় সরকার যশোরের উপ-পরিচালক রফিকুল হাসান মেলার মাঠে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলা সংস্কৃতি পরিচয়বাহী কবিগান, পটগান, গম্ভীরা, জারিগান, সঙগান যাত্রাপালা, লাঠিখেলা সাপখেলাসহ গ্রাম বাংলার লোকজ আঙ্গিকে ধারাবাহিকভাবে প্রদর্শিত হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে শিশুদের আর সন্ধ্যার পরে সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মীরা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করবেন। জেলা ও উপজেলার মোট ১৩০টি সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশ নেবে এই লোকজ সাংস্কৃতি উৎসবে।
বাহারি কার্ডে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রণ:
পহেলা বৈশাখে উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি ‘নববর্ষে’র শুভেচ্ছা জানানো চিরায়ত বাংলার রীতি। এই শুভেচ্ছা ও নববর্ষের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর পত্রেও তাই ঠাঁই পেয়েছে বাংলার ঐতিহ্য। যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এখন নববর্ষের আমন্ত্রণপত্রকে ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে পরিণত করেছে। জেলার অন্তত ২০টি সংগঠন বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যকে তুলে ধরে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রণপত্র তৈরি করছে। নববর্ষে কার্ড বা শুভেচ্ছাপত্র দেওয়ার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে এখন এক অন্যরকম প্রতিযোগিতায় রূপ দিয়েছে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এ প্রতিযোগিতা নান্দনিকতার প্রতিযোগিতা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ধরে রেখে শুভেচ্ছাপত্রকে রঙ, রূপ আর বৈচিত্র্যে ভরে তোলার প্রতিযোগিতা।
বির্বতন যশোর কাগজ দিয়ে বাঙালির ঐতিহ্য ঢুলি তৈরি করেছেন। মানুষের মুখবয় ও দুটি হাত দিয়ে ঢোলি ঢোল বাজাচ্ছেন। ঢোলের উপরে লেখা ১৪৩১ বিবর্তন।
সাংস্কৃতিক সংগঠন তির্যক গ্রাম বাংলার খেজুর গাছ কাটার অনুসঙ্গ ঠুঙ্গি ও গাছি দা। একটি চারকোণা কাঠের ওপরে বাঁশ দিয়ে সুনিপুন কারুকাজের তৈরি ঠুঙ্গি। তার ভিতরে কাঠ দিয়ে তৈরি ‘গাছি দা’।
এ ছাড়া যশোরের অন্তত ২০টি সংগঠন বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যকে তুলে ধরে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রণপত্র তৈরি করছে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিপাঙ্কর দাস রতন বলেন, ‘এক দশকের বেশি সময় ধরে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নববর্ষের শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রণপত্র বাংলার ঐতিহ্য ধরে রেখে নান্দনিকতায় ভরপুর করে তুলছে। এখন সংগঠনগুলোর মধ্যে আমন্ত্রণপত্রে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।’
এইচ আর তুহিন/জোবাইাদা/অমিয়/