মাইক্রোবাসে লেখা অ্যাম্বুলেন্স, ছাদে সাইরেন, আর ভেতরে সাধারণ সিট, চিকিৎসা সরঞ্জামের বালাই নেই। চিকিৎসা নগরী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসব অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে প্রতিনিয়ত রোগী বহন করছে, চার্জ নিচ্ছে পেশাদার হাসপাতালের সমান বা তারও বেশি। মাইক্রোবাসকে সামান্য পরিবর্তন করে গড়ে তোলা এই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা এখন রীতিমতো লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের বেশিরভাগই অবৈধ। অথচ এর পেছনে লুকিয়ে আছে জীবনের ঝুঁকি, অনিয়ম আর নজরদারির ঘাটতি। একটি ট্রলি আর সাইরেন ছাড়া কিছুই থাকে না এসব অ্যাম্বুলেন্সে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও পুলিশ, বিআরটিএসহ সব জায়গায় ম্যানেজ করে সেবার নামে চলছে রমরমা ব্যবসা। লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি হলেও একবার মামলা খেয়ে এক মাস চলতে পারে এবং মামলার দেওয়া কাগজ দিয়ে দীর্ঘদিন ট্রাফিক সিগন্যাল এড়িয়ে চলেন বলে জানান অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। দিনেরবেলা অ্যাম্বুলেন্সের তকমা লাগিয়ে রোগী পরিবহন করলেও আশেপাশের জেলাগুলোতে রাতের বেলা বিভিন্ন মোড় থেকে যাত্রী পরিবহন করা হয় এই অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সগুলো দিয়ে।
প্রশাসন এসব অবৈধ যানবাহন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন ও সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেন চালকরা। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোন সুরাহা করতে পারে না পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও বিআরটিএ।
বিআরটিএর ভাষ্য অনুযায়ী, গাড়ী আমদানির সময় "হেলথ ভেহিক্যাল সার্ভিস" হিসেবে অ্যাম্বুলেন্স আমদানি করা হয়। যেগুলো পরবর্তীতে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে রোগী পরিবহন করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এসব তালিকা বিআরটিএকে পাঠানো হয়। তালিকা ধরেই অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন দেওয়া হয়। কোন ব্যক্তির নামে নিবন্ধন দেওয়া হয় না। ব্যক্তি মালিকানার অ্যাম্বুলেন্স চলাচল সম্পূর্ণ অবৈধ। 'গ' সিরিয়ালে প্রাইভেটকার এবং 'ঠ' সিরিয়ালে পিকাপের রেজিস্টেশন দেওয়া হয়। 'ছ' সিরিয়ালে ৭১ ও ৭৪ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স রেজিষ্ট্রেশন দেওয়া হয়। এই সিরিয়ালের বাইরে যেসব অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় চলাচল করে সেগুলো মূলত মাইক্রোবাস কেটে বানানো।
এছাড়াও শর্ত থাকে যে অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর জন্য স্থায়ী শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্ক, চিকিৎসকের বসার ব্যবস্থা, স্ট্রেচার ও সাইরেন থাকতে হবে। চালক চিকিৎসক, রোগীসহ মোট ছয়জন বসতে পারে এমন গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স বানাতে হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রংপুর মেডিকেল ক্যাম্পাসের ভেতরেই রোগীর জন্য অপেক্ষা করছে লক্কর ঝক্কর মাইক্রোবাস। তবে সেগুলোর বেশিরভাগ লাইসেন্সবিহীন ও ঢাকা মেট্রো চ ও গ সিরিজের নম্বর প্লেট। তবে কিছু কিছু গাড়ীতে ঠ সিরিজ আছে। এসব গাড়িতে নেই ফিটনেসের বালাই, নেই কোন অক্সিজেন। বেশিরভাগ গাড়িই ব্যাক্তিমালিকানাধীন।
এই অ্যাম্বুলেন্সের চালকদের একজন রাসেল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে সমিতি আছে সেই সমিতির আন্ডারে এই গাড়িগুলো চলে। এগুলো বেশিরভাগই নোয়া মাইক্রোবাস কেটে অ্যাম্বুলেন্স বানানো। একটা এম্বুলেন্সের ভাড়া রোগীরা দিতে পারে না তাই আমরা কম দামে যাত্রীদের সেবা দেই। আমরা সেবা না দিলে রোগী যাবে কোথায়। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স কম। তাছাড়া সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে দামও অনেক বেশি চায়। তাই রোগীরা যেতে চায় না। সবাই সময় মত তাদেরকে পায়না।
আর একচালক রিপন মিয়া বলেন, আমাদের সবাই একজোট রয়েছি। এ কারণে নতুন করে কেউ এই অ্যাম্বুলেন্স চালাতে গেলে সমিতির আন্ডারে আসতে হয়। তখন আর সমস্যা হয় না।
তবে অভিযোগ রয়েছে, কোন রোগী মারা গেলে অ্যাম্বুলেন্স চালকদের সিন্ডিকেটে পড়ে বাড়তি অর্থ গুনতে হয়। মারা যাওয়ার সাথে সাথেই এই সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হয় রোগীর স্বজনদের। ফলে লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েন স্বজনরা।
জানা গেছে, এই অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট চালায় বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতি রংপুর শাখা। এই কমিটির সদস্যরা অনেকেই পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গেও রয়েছে। সংগঠনটির নিয়ন্ত্রণে হাসপাতাল এলাকায় ৭০ টি অ্যাম্বুলেন্স চলে যার ৫৫টিই মাইক্রোবাস কেটে বানানো। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ করতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শাজাহান হাওলাদার ম্যাক্স সহ হাসপাতালে কর্মরত আওয়ামী পন্থী সংগঠনের কয়েকজন নেতা। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন ম্যাক্সের নিজের ভাই শরিফুল ইসলাম সহ অন্যান্য নেতারা।
সংগঠনের জেলা ও মহানগর শাখার সভাপতি তারিকুল ইসলাম তারেক বলেন, এই অ্যাম্বুলেন্স গুলো বেশিরভাগই মাইক্রোবাস কেটে বানানো। ৭০ টির মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি বৈধ। অবৈধ অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও আমরা সংগঠন থেকে বেশ কিছু দাবি-দাওয়া জানিয়েছি। আমরা মাঝখানে আন্দোলনে গিয়েছিলাম পরে পুলিশের সাথে সমঝোতা করে চলছে। পুলিশ কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছে আরও কিছু দাবি-দাওয়া আছে। যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলে সেন্ট্রাল থেকে পরবর্তীতে যে ঘোষণা আসবে আমরা সেটাই করব। তবে এই অ্যাম্বুলেন্স গুলো থাকাতে রোগীরা কম দামে সেবা নিতে পারে। যার কারণে অবৈধ হলেও চাহিদা বেশি।
অবৈধ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, এরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে ব্যবসা করে আসছে। আমাদের দুটি অ্যাম্বুলেন্স তাই তারা থাকলে রোগীরা কিছুটা সেবা পায়। অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যাপারে যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে হবে এবং অ্যাম্বুলেন্সে প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে তাদের সাথে বসা হয়েছিল আবারও বসার চেষ্টা করব।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ- পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুর রশিদ বলেন, এটা নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি নিয়ন্ত্রণ করার।
বিআরটিএ রংপুর সার্কেলের সহকারী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম সরকার জানান, মাইক্রোবাস বা পিক-আপ কেটে অ্যম্বুলেন্স বানানো একেবারেই অবৈধ। আমরা এই অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের দৌরাত্ম নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ না হবে আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।
সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি অবৈধ অ্যাম্বুলেন্স বন্ধের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী রোগী ও তাদেরর স্বজনরা।
সিফাত/