শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নামে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছিল একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এ চক্রের লাগাম টানতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ছয়টি দল যৌথ অভিযান চালায়। এ সময় চক্রের মূল হোতাসহ আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সোমবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস।
এর আগে গত রবিবার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, কুমিল্লা ও ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৪, ৫, ৮, ১০, ১১ ও ১৪ ব্যাটালিয়ন আভিযানিক দল।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন চক্রের মূল হোতা জাকির হোসেন হাওলাদার (৪৭), অন্যতম মূল সহযোগী মো. বাপ্পি মোল্লা (২০), মো. উসমান গনি মোল্লা (৩৩), শামীম হোসেন (২৯), মোহাম্মদ জিহাদ (৩৪), কাজী সাদ্দাম হোসেন ওরফে আমির হামজা (২৬), মো. আহাদ গাজী (২৪), মো. মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জয় (২৬)। এ চক্রের সঙ্গে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও রয়েছে। তারা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার করে থাকে।
র্যাব বলছে, সারা দেশে এই চক্রের দুই হাজারের বেশি সক্রিয় এজেন্ট রয়েছে। শেয়ার বাজারের মতো এক রকম দর-কষাকষি করে তাদের হাজারে ৩০-৪০ টাকা কমিশনে প্রতারণার কাজ দেওয়া হয়। চক্রের এজেন্ট হতে হলে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়।
মুনীম ফেরদৌস বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এই প্রতারক চক্র শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। গত ২৪ মার্চ রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানাধীন শালবাগানে বিএনসিসি অফিসে অবস্থানকালে এক ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বর থেকে কল আসে। মেয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস শাখায় কর্মরত মিজানুর রহমান বলে নিজের পরিচয় দেয় এক ব্যক্তি। তার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন-এ প্লাস পাওয়ায় শিক্ষা উপবৃত্তির ২২ হাজার ৫০০ টাকা এসেছে বলে জানায় সে।
ওই টাকা বাদীর অ্যাকাউন্টে চলে যাবে উল্লেখ করে একটি ব্যাংকের এটিএম কার্ডের ১৬ ডিজিটের নম্বর দিতে বললে তিনি সেটা দিয়ে দেন। এরপর ওটিপিও ওদের জানান। পরে বাদী মোবাইল মেসেজ অপশনে দেখতে পান, তার অ্যাকাউন্ট থেকে চারবারে ১ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনায় তিনি অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে আরএমপির বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলা করেন। রাজশাহীর র্যাব-৫ জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। পরে র্যাব-৫-এর একটি দল প্রতারণার কাজে জড়িত শামীম হোসেনকে রাজশাহী জেলার রাজপাড়া থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে।
শামীম জানায়, সে শুধু মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা দিত। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সিম কার্ডসহ বেশ কয়েকটি মোবাইল উদ্ধার করে। এরপর একে একে চক্রের মূল হোতা জাকিরসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ২৩টি মোবাইল সেট, ৩১০টি সিম কার্ড, নগদ ৩ লাখ ১ হাজার ২৭০ টাকা ও ৯টি ব্যাংক লেনদেন স্লিপ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত প্রত্যেকটি সিম কার্ডে বিভিন্ন ধরনের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
‘ওয়েলকাম’ ও ‘হ্যালো’ গ্রুপ
তারা এলাকায় পরিচিতি ‘ওয়েলকাম’ ও ‘হ্যালো’ গ্রুপের সদস্য হিসেবে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সরকারি অফিস থেকে শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে তারা। এরপর ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের কল সেন্টারে শেয়ার করে। পরের পর্যায়ে মূল হোতা জাকির হোসেনের দুই ছেলে মানিক ও হিরা ফোন দেয়। নম্বর নেয়। কথা বলে বিশ্বস্ততা অর্জন করে ওটিপি নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে।
সারা দেশে এজেন্ট ২ হাজার
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-৫-এর অধিনায়ক বলেন, সারা দেশে ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের রয়েছে দুই হাজারের বেশি এজেন্ট। এজেন্ট হতে হলে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এন্ট্রি করাতে হয়। এরপর মোবাইলে তাদের নামে একটা অ্যাকাউন্ট হয়। ইতোমধ্যে তদন্তে ১৮৬টি মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে টাকা লেনদেন ও যোগাযোগ হয়েছে।
হাজারে ৩০ বা ৪০ টাকা কমিশন পাওয়ার চুক্তিতে প্রতারণার কাজে এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এজেন্টের এন্ট্রি করা মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড থাকে মূল চক্রের হাতে। টাকা ঢোকা মাত্র তারা তুলে নেয়।
শহর থেকে দূরে অবস্থান করে চক্রের সদস্যরা
এই চক্রের সদস্যরা এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না। মূল শহর থেকে সাধারণত ১৫-১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে। টাকা আসা মাত্র কাছের কোনো এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমে টাকা উঠিয়ে নেয় তারা। শুধু মোটরসাইকেলে চলাচল করে। বাড়িতেও থাকে না, নির্জনে থাকে।
এই প্রতারণাকে তারা ব্যবসা হিসেবে দেখে, খারাপ কিছু ভাবে না। তারা শুধু নিজেরাই নয়, নিজ নিজ পরিবারের সদস্যরাও এ ‘কাজে’ জড়িত। প্রতারক চক্রের সদস্যদের বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজনরাও প্রভাবিত হয়ে অনেকে এই অভিনব প্রতারণার বলয়ে জড়িয়ে পড়েছে বলে র্যাব তথ্য পেয়েছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম বলেন, ‘খোকন মোল্লা নামে এক ব্যক্তি এই প্রতারণায় জড়িত। পলাতক খোকন মোল্লার ছেলে বাপ্পি মোল্লাকে আমরা গ্রেপ্তার করি। খোকন মোল্লার মোবাইলে এক দিনে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা এসেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার। মূল হোতা জাকির হোসেন হাওলাদারকে গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইলে দেখা গেছে দুই লক্ষাধিক টাকা আদান-প্রদান হয়েছে।’
চক্রের যারা সদস্য তাদের মধ্যে দর-কষাকষি হয়। এক রকম শেয়ারবাজারের লেনদেনের মতো দর ওঠানামা করে। কেউ হাজার টাকায় ৪০ টাকা, কেউ হাজার টাকায় ৩০ টাকা কমিশন পেতে কাজটি নেয়।
তাদের মধ্যে যারা পারদর্শী ও বিশ্বস্ত, তাদের কাজটি দেওয়া হয়। অর্থ আত্মসাতের ‘কাজ’টি সম্পন্ন হওয়ার পর সেই এজেন্ট নিজের প্রাপ্য অংশ রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপর প্রচার চক্রের মূল হোতা বাকি টাকা ভাগ বণ্টন করে দেয়।
চক্রটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার করে এবং মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে।