গাছে ফুল কেন ফোটে, বিজ্ঞানীরা ত্রিশের দশক থেকে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ মতে, দিনে আলোর স্থিতিকাল বা দিনের দৈর্ঘ্যের প্রতি সাড়া দিয়েই ফুল ফোটে। আমাদের দেশে শীতকালে দিনে আলোর স্থিতিকাল বা সময় থাকে কম। এজন্য আলুর ফুল ফোটে না। কিন্তু ইউরোপে দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকায় সেখানে আলুর ফুল ফোটে, আবার সে ফুল থেকে ফল ও বীজও হয়। আমাদের দেশে কৃষিবিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ঘরের ভেতরে আলু গাছ লাগিয়ে কৃত্রিম আলো জ্বেলে শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেখেছেন যে, তার প্রভাবে আলু গাছে ফুল ফোটে ও ফল ধরে। সে ফল থেকে প্রকৃত আলুবীজও উৎপন্ন হয়। সেসব বীজ মাটিতে লাগিয়ে আলু চাষও করা যায়। কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হলো ফুল কেন ফোটে?
রাশিয়ার একদল বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেছেন যে, পাতা থেকে একটি রহস্যময় বস্তু বিটপ বা ডগায় যায়। সেই বস্তুর কারণে সেখানে প্রথমে কুঁড়ির উদ্ভব হয়। সেই কুঁড়িই পরে ফুল হয়ে ফোটে। সেই রহস্যময় বস্তুটি হলো ‘ফ্লোরিজেন’ হরমোন। কিন্তু কেনই বা গাছের একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে ফুল ফোটে, যা এক এক উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়? যদিও বেশির ভাগ ফুল ফোটে ডালের আগায় বা পাতার কোল থেকে। কিন্তু নাগলিঙ্গম ফুলের দিকে তাকিয়ে দেখ, গাছের গুঁড়ির গা থেকে কেমন থোঁকা ধরে ফুল ফুটছে! বৈশাখের দিনে রমনা উদ্যানে গেলে এ দৃশ্য বিরল নয়। এ প্রসঙ্গে সুইডিশ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সের ওভ নিলসন বলেছেন, ‘আমরা এর পেছনে দায়ী একটি জিন খুঁজে পেয়েছি, যার নাম এফটি। এই জিন পাতায় সক্রিয় হয় ও যার কার্যকারিতা দিনের দৈর্ঘ্য বা ডে লেন্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দিনের আলোর সংকেত পেলেই এই জিন উদ্দীপিত হয়ে ওঠে এবং তা পাতা থেকে ডগার শীর্ষে স্থানান্তরিত হয়। কীভাবে এই জিন সক্রিয় হওয়ার পর কুঁড়ি গঠন করে তা নিয়ে তারা গবেষণা চালিয়েছেন।
তারা দেখতে পেয়েছেন যে, এই জিন কিছু প্রোটিন উৎপাদনে সহায়তা করে ও সেসব প্রোটিন ভবিষ্যতে গাছের কোন অংশে কুঁড়ি বের হবে ও ফুল ফুটবে সেই অংশে থাকা প্রোটিনগুলোর সঙ্গে এসব প্রোটিনের যোগাযোগ ঘটে এবং সঠিক সময়ে সঠিক স্থানেই ফুলটি ফোটে। তবে বিজ্ঞানীরা এও বলেছেন যে, ফুল ফোটার ক্ষেত্রে শুধু জিন বা প্রোটিন নয়, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও মাটির অবস্থারও ভূমিকা রয়েছে। আমরা সবাই জানি, কদম ফুল ফোটে আষাঢ়ে, শিউলি ফোটে শরতে। কিন্তু বর্তমান জলবায়ুর পরিবর্তনহেতু এখন হেমন্তেও কোনো কোনো গাছে কদম ফুটছে, শরত বাদে হেমন্তেও ফুটছে শিউলি ফুল। ইউরোপে বসন্তকালে দিনের আলো বেশিক্ষণ থাকায় সেখানে ড্যাফোডিল ফোটে, কিন্তু গোলাপকে ফোটার জন্য অপেক্ষা করতে হয় গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থও ঠিক ভেবে পাননি, যে ড্যাফোডিলের রূপে তিনি এত মুগ্ধ, সেই ফুলগুলো ফোটার পেছনে রহস্যটা কী? আধুনিক অনেক জাতের ধানের এখন ফুল ফোটার জন্য কোনো মৌসুমের অপেক্ষা করা লাগে না। কিন্তু দেশি অনেক জাতের আমন ধানের ফুল ফোটে শরতে, ধান পাকে হেমন্তে। বছরের যে সময়েই সেসব জাতের ধান লাগানো হোক না কেন, তার ফুল শরতেই ফুটবে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, ফুল কখন ফুটবে তা নির্ধারণ করে আসলে ‘Apetala1’ নামক একটি জিন। এই জিন অন্য জিনদের আদেশ করে তারা যেন ডগায় আর কোনো পাতা উৎপাদনের সংকেত না পাঠায়। তখন এই আদেশে পেয়ে সহস্রাধিক জিন পাতা উৎপাদন বন্ধ করে ফুলের জননাঙ্গ গঠনের কাজে লেগে পড়ে।
ফুল ফোটার এসব জৈবিক ক্রিয়াকলাপ ছাড়াও রয়েছে আর এক ধরনের পদার্থবিজ্ঞান বা ফিজিক্স। আমেরিকায় হার্ভার্ডের একদল পদার্থবিদ গবেষক তাদের এক গবেষণাপত্রে ফুল ফোটার ফিজিক্সকে তুলে ধরেছেন। এশিয়াটিক লিলি ফুলের ওপর তারা গবেষণা করেছেন। তারা লক্ষ্য করেছেন যে, তরুণ কুঁড়ি থেকে একটি এশিয়াটিক লিলি ফুল ফুটতে প্রায় সাড়ে চার দিন সময় লাগে। এ সময়ে কুঁড়ি ধীরে ধীরে জল শোষণ করে, বড় হয় ও ফুল ফোটার জন্য তৈরি হয়। এই জল বৃতি ও পাঁপড়ির গোঁড়ায় দিযে চাপ দেয়, যার প্রভাবে বৃতি ও পাঁপড়ি বাইরে দিকে মেলতে শুরু করে। সে সময় বৃতি ও পাঁপড়ির ওপরের প্রান্তে থাকা কোষগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় সেগুলো বড় হতে শুরু করে ও ছড়ানোর জায়গা খুঁজতে থাকে। এটাও ফুল ফোটার এক কারণ হতে পারে বলে তারা মনে করেন। আবার জলের প্রবাহ ও চাপ কমে গেলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ধানের ফুল ফোটার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে দেখা যায়। সকালে জলের চাপে মাত্র ঘণ্টাখানেকের জন্য ধানের ফুলের বড় তুষ ও ছোট তুষখণ্ড ফাঁক হয়ে যায় ও ভেতরের জননাঙ্গগুলো তুষের বাইরে বেরিয়ে পড়ে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে পরাগায়ন সম্পন্ন হলেই তুষ আবার বন্ধ হয়ে যায় চিরকালের জন্য। পানিপ্রবাহের চাপেই এ ঘটনা ঘটে থাকে।
ফুল কখন ফোটে তার ওপর নির্ভর করে ফুলের রং। সাধারণত সাদা ও সুগন্ধযুক্ত ফুলগুলো ফোটে রাতে, রঙিন ও গন্ধহীনা ফুলেরা ফোটে দিনে। এর পেছনেও রয়েছে বিজ্ঞান। গাছে ফুল আসলে ফোটার দরকার কী? না ফুটলে কী হবে? ফুল না ফুটলে ফল হবে না, ফল না হলে বীজ হবে না। বীজ না হলে ওসব গাছের বংশরক্ষা হবে না। মানুষের মতো গাছেরাও চায় তার বংশ বা সন্তান রেখে যেতে। ফল উৎপাদনের জন্য দরকার পরাগায়ন, যা করে মৌমাছির মতো অনেক পতঙ্গ। পতঙ্গরা আবার দুই রকমের- নিশাচর ও দিবাচর। নিশাচর পতঙ্গরা রাতে কোথায় কোন ফুল ফুটে আছে তা সাধারণত ভালো করে দেখতে পারে না। তাই ওদের ফুলে ফুলে বিচরণ তত সহজ হয় না। তাই গাছেরা ঠিক করেছে, রাতে ওরা সাদা ফুল ফোটাবে যাতে নিশাচর পতঙ্গরা দেখতে পারে আর সুগন্ধ দিয়ে সেসব ফুলের উপস্থিতি জানান দেওয়া যাতে পতঙ্গরা বুঝতে পারে কোথায় ফুলগুলো আছে। দিনে এসব সমস্যা নেই, তাই সুগন্ধ দিয়ে পতঙ্গদের আকর্ষণ করতে হয় না। ফুলের রঙেই দিবাচর পতঙ্গরা আকর্ষিত হয় ও পরাগায়ন ঘটায়। তবে এখনো গবেষণার ফলাফলে পুরোপুরি স্পষ্ট নয় যে, ঠিক কী কী কারণে বা কারণগুলোর মিলিত প্রভাবে ফুল ফোটে।
জাহ্নবী