সিংহের হঠাৎ মনে হলো সবাই মিলে অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে না। এই ভেবে বনের সবাইকে ডেকে বললেন, ‘কতদিন হয়ে গেল আমাদের আনন্দ-উৎসব হয় না। চলো আমরা বনের বাইরে মনোরম, সুন্দর কোনো জায়গায় ঘুরে আসি।’
সিংহের কথা শুনে পেছন থেকে একটা বানর লাফ দিয়ে উঠে বলল, ‘মানে চড়ুইভাতি!’
সিংহ বললেন, ‘চড়ুইভাতিও বলতে পার। বাড়ির বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে জম্পেশ খাওয়াদাওয়াও হবে, তাই না! কোথায় যাওয়া যায় বল দেখি?’
সবার মাঝখানে বসে ছিল যে হরিণটা! সে দাড়িয়ে বলল, ‘বন থেকে তিন গ্রাম দূরে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে খেলার মাঠ আছে। সেই মাঠে চড়ুইভাতি খেলতে যেতে পারি। কিন্তু এতগুলো পশুপাখি এতদূর যাব কেমন করে?’
হরিণের পেছন থেকে মাথা বের করে শেয়াল বলল, ‘পঞ্চাশ সিটের একটা বাস ভাড়া করে নিই। আমরা যারা মুরব্বি আছি সবাই সিটে বসলাম, পাখিরা বাসের ছাদে আর বানরগুলো জানালায় ঝুলতে ঝুলতে চলে যাব।’
ছোট্ট একটা বানর তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘অন্যরা ঝুলে ঝুলুক, আমি ঝুলতে পারব না।’
শেয়াল বলল, ‘তোমাকে ঝুলতে হবে না, তুমি ছোট্ট বানর আমার কোলে বসে যেও কেমন!’ শেয়ালের কথা শুনে সবাই হাসে।
কিছু সময় আলোচনা চলল- এতগুলো পশুপাখির খাবার কী হবে? খাবার প্যাকেট করে নিয়ে যাবে নাকি গিয়ে রান্না করবে? রান্নার বাবুর্চি পাবে কোথায়? বিনোদনের ব্যবস্থা কী ইত্যাদি ইত্যাদি। আলোচনা শেষে ঠিক হলো রান্না গিয়েই হবে, সিংহ নিজেই করবে। খেলাধূলার জন্য ফুটবল নিয়ে যাবে। বিনোদন হিসেবে আরও থাকবে গানবাজনার ব্যবস্থা। যাত্রাকালে বাসে নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গানবাজনা চলবে। এতসব আলোচনার মাঝে একটা বাঘ ঝিমুচ্ছিল। সবার কথা শেষ হলে একটুখানি আড়মোরা কেটে সে বলল, ‘খেলাধূলায় পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকা দরকার। অথবা র্যাফেল ড্র। এমন একটা চড়ুইভাতির অনুষ্ঠানে পুরস্কারের ব্যবস্থা না থাকলে হয়!’
বাঘের কথাটা বেশ মনে ধরল সিংহের। বললেন, ‘বেশ, কী কী পুরস্কার থাকলে ভালো হয় বলে তুমি মনে করো, বাঘ?’
বাঘ বলল, ‘র্যাফেল ড্রতে প্রথম পুরস্কার হোন্ডা। প্রথম পুরস্কারটা আমিই পাব কি না, তাই! হোন্ডা করে বনের এ মাথা থেকে ও মাথা অবধি ঘোরার খুব শখ আমার। দ্বিতীয় পুরস্কার টেলিভিশন। শুনেছি জিওগ্রাফি বলে একটা চ্যানেল আছে, ওখানে আমাদের নাকি খুব দেখায় টেখায়, টেলিভিশনে নিজেকে দেখারও অনেক শখ।’
পাশ থেকে একটা শেয়াল হুক্কা হুয়া আওয়াজ দিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয় পুরস্কার টেলিভিশনটা আপনিই পাবেন তাই না বাঘ মামা?’
শেয়ালের কথা শুনে সবাই আবার হাসে। বাঘ শেয়ালকে ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বলল। আরও বলল, ‘তৃতীয় পুরস্কার মোবাইল। একটা মোবাইল জরুরি হয়ে গেছে। বনের বাইরে কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখা যাচ্ছে না।’
সব শুনে সিংহ বললেন, ‘হোন্ডা আর টেলিভিশনের ব্যাপারটা বিবেচনা করা যায়, মোবাইল একদম নয়। মোবাইল হাতে পেলে বনের ছোট ছোট পশু-পাখিরা সারা দিন শুধু গেমস খেলবে। এত গেমস খেলা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।’
বড়রা হাততালি দিয়ে বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন সিংহজি।’
একটা সুরেলা কণ্ঠের পাখি দু’কলি গান গেয়ে বলল, ‘আমি বলি কী, প্রথম পুরস্কার গাছের চারা দেওয়া হোক। এক লাখ একটা চারা। বনে গাছপালা কমে আসছে। মাঝে মধ্যে উড়ে এসে মনে হয় বসে একটু আরাম করব সেরকম গাছই খুঁজে পাচ্ছি না।’
পালকজুড়ে হলুদের কারুকাজে ভরা একটা পাখি। সে বলল, ‘দ্বিতীয় পুরস্কার ফসলি বীজ। ফসলের অভাবে মনে হচ্ছে প্রয়োজনমত খাবার জুটছে না।’
সাদা ধবধবে একটা পাখি, মাথায় কালো রঙের চূড়ো তার। সে বলল, ‘তৃতীয় পুরস্কার মোবাইল দেওয়া যেতে পারে, শীতের সময় অতিথি পাখিরা এসে ওদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। মোবাইলটা থাকলে একটু কথাবার্তা বলতে পারবে।’ পাখিটার কথা শুনে ফের হাসে সবাই।’
সিংহ সবাইকে হাসি থামাতে বলে জানায়- সামনের শুক্রবার তারা চড়ুইভাতি খেলতে ফুলেশ্বরী নদীর পাড়ে যাচ্ছে। এই বলে তাদের মিটিং শেষ হয়।
শুক্রবার বেলা ১১টা নাগাদ পশুপাখিরা বাস ভরে ফুলেশ্বরী নদীর পাড়ে এসে দেখে- এমা! এত এত মানুষ ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বরণ করতে। বলছে- ফুলেশ্বরী নদীর পাড়ে তোমাদের স্বাগতম প্রিয় পশুপাখির দল ’
তারা চড়ুইভাতির অনুষ্ঠানে মানুষদেরও নিমন্ত্রণ করে। মানুষে, পশুপাখি মিলে একসাথে রান্না করে, নাচে-গায় আর ভূরি ভোজে মেতে উঠে। সবশেষে নিজেদের জন্য আনা পুরস্কার গাছের চারা, ফসলের বীজ প্রিয় মানুষদের উপহার দেয়। তারা বুঝতে পারে নিজেদের থেকে এগুলো এখন মানুষেরই বেশি প্রয়োজন।
জাহ্নবী