আজ আমি বাসায় একা।
এটা আমার জন্য অভূতপূর্ব। ভয়েরও। আমি জানি না রাতটা কীভাবে কাটবে। কোন আতঙ্ক অপেক্ষা করছে আমাকে কাবু করে দেওয়ার জন্য!
আমি অতটা ভিতু নই। কিন্তু আমার ছোট্ট এই জীবনে এমন কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি যে, ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। এখন হঠাৎ হঠাৎ সময়ে-অসময়ে সেসব ঘটনা মনে হলে আমি আঁতকে উঠি। আর ভয় পেলে বোধ হয় মানুষের গলাও শুকিয়ে যায়। গলা শুকানোর সঙ্গে আমার আরেকটা উপসর্গ যোগ হয়-মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা অনুভূতি খেলা করে। যেন একটা সাপ আমার পিঠ বরাবর নামছে-উঠছে।
আজ রাতে আমি একা। সেই অনুভূতিগুলো আস্তে আস্তে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বেশির ভাগ আতঙ্কের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে হোস্টেলে। আমাদের কলেজটা পাহাড়ি এলাকায়। হোস্টেলের অবস্থান কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তখন আমি মাত্র হোস্টেলে উঠেছি। বেশি কিছু জানা ছিল না।
একদিন শহর থেকে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। হোস্টেল গেটের অন্তত আধা কিলোমিটার আগে রিকশা ছেড়ে দিয়েছি। এই জায়গাটা বেশ উঁচু। রিকশা উঠতে চায় না। আমি হাঁটা ধরলাম। মিনিট বিশেক হাঁটলেই হোস্টেলে পৌঁছে যাব।
শীতকাল। ঘন কুয়াশায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। মাফলারটা মাথায় আর গলায় ভালো করে পেঁচিয়ে নিলাম। অন্ধকারে সাবধানে হাঁটছি। একটু ভয়ও করছে। কিছুটা সামনে রাস্তার পাশে একটা আগুনের কুণ্ডলী দেখা গেল। নিশ্চয়ই কেউ আগুন পোহাচ্ছে। নিমেষেই ভয় দূর হয়ে গেল আমার। আমি এগিয়ে গেলাম কুণ্ডলীর দিকে।
ভাপা পিঠার দোকান। এক বৃদ্ধ মহিলা মাটির চুলায় পিঠা বানাচ্ছেন। পাটালি গুড়ের ঘ্রাণ আর পিঠার ভাপে মুগ্ধ হয়ে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।
মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘পকেটে কত টাকা আছে?’
আমি বললাম, ‘আছে। পিঠার দাম কত?’
‘একটা দশ টাকা।’
‘আমাকে একটা দেন।’
‘দাঁড়াও, বানিয়ে দিচ্ছি।’
মাটির পাত্রে পিঠার উপকরণ সাজালেন মহিলা। চালের গুঁড়া, নারকেল আর পাটালি গুড়। আমি বললাম, ‘গুড় একটু বাড়িয়ে দিয়েন।’ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন তিনি। আমার বুকটা ধক করে উঠল। এই হাসিটা অন্য রকম। স্বাভাবিক নয়। চোখ-মুখ কিছুই স্বাভাবিক নয়।
হঠাৎ আমার মনে হলো, মহিলা এতক্ষণ যে পিঠাগুলো বানালেন সেগুলো কই? আশপাশে কোনো ক্রেতাকে তো দেখছি না! ঝোঁকের বশে আমি বলেই ফেললাম, ‘আপনার আগের পিঠাগুলো কই?’
মহিলা আবার অস্বাভাবিক মুচকি হেসে বললেন, ‘বেচা হয়ে গেছে। দশ টাকা করে।’
একটা ঢোক গিলে আমি বললাম, ‘কারা কিনল?’
রাস্তার পাশের জঙ্গলের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে মহিলা বললেন, ‘ওরা।’
সঙ্গে সঙ্গে ঝম ঝম শব্দ শুনতে পেলাম আমি। জঙ্গলের দিক থেকে আসছে। যেন নূপুর পরে হেঁটে যাচ্ছে কেউ।
এখানে অতিপ্রাকৃত কিছু একটা ঘটছে- এটা মনে হতেই আমি লক্ষ করলাম, চুলায় ফুঁ দিচ্ছেন তিনি, মুখ থেকে আগুন বেরিয়ে জ্বলে উঠছে চুলা!
আমি বোধ হয় একটা চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু চিৎকারটা বের হয়েছে বলে মনে হয়নি। পিঠের ওপর সাপের আনাগোনাও টের পেয়েছি।
রাতে সিকিউরিটির লোকজন রাস্তার পাশ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছে। পরদিন সকালে এই ঘটনা ঘটার কারণ আদ্যোপান্ত জানতে পারলাম।
আমাদের হোস্টেল ডাইনিংয়ের বাবুর্চি ছিলেন এই মহিলা। দুই পায়ে নূপুর পরতেন। মৃগী রোগ ছিল তাঁর। হোস্টেলের ছাত্রদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ওষুধ কিনতেন। সাহায্য নেওয়ার ধরনটা ছিল ব্যতিক্রম। দশ টাকা নিতেন। কমও না, বেশিও না।
কিন্তু তিনি বাঁচতে পারেননি। রান্না করার সময় হঠাৎ মৃগী রোগ দেখা দিয়েছিল। আগুনে পুড়ে মারা যান তিনি।
এরপর হোস্টেলের আশপাশে তাঁকে অনেকেই দেখেছে নানান বেশে। বেশির ভাগ সময় ভাপা পিঠা বানান তিনি। একাকী পথ চলার সময় তিনি দেখা দেন। নূপুরের শব্দও শোনা যায়। ঝম ঝম।
আমাদের হুজুর স্যার বলেন, এটা আসলে জিন। জিনেরা নানান আকৃতি ধারণ করতে পারে-মানুষ, বিড়াল, কুকুর, সাপ। এই জিনটা বাবুর্চি মহিলাকে বেছে নিয়েছে। জিনেরা বাস করে পাহাড়ে, গর্তে, খোলা মাঠে, তিন রাস্তার মোড়ে আর মানুষের বাসাবাড়িতে। ভালো জিন ছাদে অবস্থান করে মানুষকে পাহারা দেয়। খারাপ জিন থাকে বাথরুমে।
আজ সব কথা আমার হুড়মুড়িয়ে মনে আসছে। আজ রাতে বাসায় আমাকে একা থাকতে হবে।
বাবার এক বন্ধু মারা গেছেন সকালে। তাঁর বড় ছেলে বিদেশ থেকে আসতে রাত হবে। সকালে জানাজা। মা-বাবা গেছেন ও বাড়িতে। একা থাকতে যে আমার এত ভয়, মা-বাবা তো জানেন না। আমিও-বা কী করে বলি। কলেজে পড়ি আমি। এসব কথা কি বলা যায়?
দোয়া-দরুদ যা মুখস্থ আছে, সব পড়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসবে না জানি। তবু চেষ্টা করতে থাকলাম। প্রথম চেষ্টা উল্টো থেকে ভেড়া গোনা-দশ, নয়, আট...।
না, ঘুম আসছে না। এপাশ-ওপাশ করছি। খাটের শব্দেও আঁতকে উঠছি। বাথরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু হুজুর স্যার যে বললেন বাথরুমে খারাপ জিন থাকে!
উপায় নেই। বিসমিল্লাহ পড়ে বাথরুমের লাইট জ্বালালাম। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে ওঠার জোগাড়। আচ্ছা, এটা আমি তো! নাকি জিন! আমাদের বাড়িতে জিন থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? ভাবতে ভাবতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। এবার মনে পড়ল, আমাদের বাড়িটা তিন রাস্তার মোড়ে! সর্বনাশ, জিন তো থাকবেই! ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে আপাদমস্তক কাঁথায় ঢেকে ফেললাম নিজেকে।একটু তন্দ্রা এসেছিল মনে হয়। খস খস শব্দে সেটাও ছুটে গেল। খাটের নিচ থেকে শব্দটা আসছে। কেউ যেন পা ঘষে ঘষে হেঁটে যাচ্ছে। আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। কী হতে পারে? ইঁদুর-বিড়াল তো এভাবে হাঁটে না। বিড়াল! জিনেরা বিড়ালের বেশ ধরতে পারে। কাঁথা মুড়িয়ে নিজেকে আরও লুকানোর চেষ্টা করলাম। না, বিড়াল হতে পারে না। বিড়াল নিঃশব্দে হাঁটে। অন্য কিছু। সাহস করে উঠে লাইট জ্বালালাম। দুরু দুরু বুকে উঁকি দিলাম খাটের নিচে। নিজেকে বোকা মনে হলো। ফ্যানের বাতাসে ফুলে ওঠা একটা পলিব্যাগ এদিক-ওদিক ছুটছে।
মনে মনে হাসলাম কিছুক্ষণ। মনের বাঘকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বাসায় কি লেবু আছে? দরকার। গলা শুকিয়ে এসেছে। লেবুর শরবত খাওয়া দরকার। আরও একটা কারণে লেবু থাকা উচিত। বাসায় লেবু থাকলে জিন আসে না। হুজুর স্যার বলেছেন।
ফ্রিজ খুলে লেবু খুঁজছি। ঝুম ঝুম শব্দে কান খাড়া হয়ে গেল। নূপুরের শব্দ। কোত্থেকে আসছে?
ভয় ছাড়িয়ে চিন্তার জট লেগে গেল। মাথাটা ঘুরে উঠল হঠাৎ। তাল সামলানোর আগেই কলিংবেল বেজে উঠল। এত রাতে কে এল আবার। আমার চিন্তা কাজ করছে না। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন। বাবার বন্ধু। যিনি আজ সকালে মারা গেছেন। আর বাবুর্চি মহিলাটা।
ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলাম আমি। বাবা-মা উঠে এসে বললেন, ‘কী রে, এত রাতে দরজা খুলেছিস কেন?’
জাহ্নবী