![মূল্যায়ন পদ্ধতির অসংগতি দূর করুন](uploads/2024/02/08/1707367074.Editorial.gif)
নতুন শিক্ষাক্রম মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এখন নানা প্রশ্ন। নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে প্রচলিত মুখস্থবিদ্যানির্ভর পরীক্ষার ক্ষেত্রে এনেছে আমূল পরিবর্তন। শিক্ষার্থীর যোগ্যতাকে মূল ভিত্তি হিসেবে নিয়ে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনার বিকাশের ধারাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়েছে বলে অভিমত শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। তবে এটি চালু হওয়ার এক বছর পরও শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে রয়েছে অস্পষ্টতা। তাদের মতে, আগের নিয়মে লিখিত মূল্যায়নের পাশাপাশি রিপোর্ট কার্ড সংক্ষিপ্ত করা খুবই দরকার। নতুন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্যদের আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। গত সোমবার সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন শিক্ষাক্রমে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তা যথাযথভাবে সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত লোক প্রস্তুত করা এবং নতুন শিক্ষাক্রম মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
নতুন শিক্ষাক্রমে স্তরভিত্তিক মূল্যায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ থাকবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ ভাগ এবং সাময়িকী মূল্যায়ন ৪০ ভাগ। নবম-দশম শ্রেণিতে দুটিই সমান সমান। পাশাপাশি দশম শ্রেণি শেষে যোগ্যতা যাচাইয়ে নেওয়া হবে পাবলিক পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে ৩০ ভাগ শিখনকালীন এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ ভাগ। আর প্রায়োগিক বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন। অপরদিকে ২০২৩ সালের মূল্যায়ন নির্দেশিকায় কিছুটা পরিবর্তন এনে ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা বিবেচনায় বিষয়ভিত্তিক ও আচরণিক দুভাবে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মিল রয়েছে জাপানের শিক্ষাক্রমের। সে দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি পিএইচডি গবেষকের মতে, জাপানে স্কুল পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা আনন্দদায়ক করা হয়েছে। সেটার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও রয়েছে। ঝরে পড়ার হার কম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও গবেষণাকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
নতুন নির্দেশিকার একটি অংশ নিয়ে অভিভাবকদের আপত্তি রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ট্রান্সক্রিপ্ট প্রস্তুতের ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থী শিখনকালীন ও সামস্টিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যে সূচক (ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ) পেয়েছে, সেটি উল্লেখ করা হবে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মূল্যায়নে যদি দুবার বৃত্ত পায়, একবার ত্রিভুজ পায়, তার ট্রান্সক্রিপ্টে ত্রিভুজই থাকবে। আবার যে শিক্ষার্থী তিনটা মূল্যায়নে ত্রিভুজ পাবে, তার ক্ষেত্রেও ত্রিভুজ থাকবে। এটা নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের একটি অংশ মনে করেন, এটি সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। তারা বলছেন, সবার ট্রান্সক্রিপ্টে যদি একই রকম সূচক থাকে, তাহলে সঠিক মূল্যায়ন হবে না। পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পূর্ণ উঠিয়ে দেওয়ার কারণে ছাত্রদের মধ্যে আগের মতো আগ্রহ নেই। তাদের মাথায় ঢুকেছে একটি মূল্যায়নে ত্রিভুজ পেলেই হবে। অন্যগুলোর তো আর হিসাব হবে না। অনেক শিক্ষকও মনে করেন, সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একটি লিখিত মূল্যায়ন দরকার আছে পরীক্ষার আদলে। কারণ উৎসব আকারে মূল্যায়নের জন্য আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের কাজ বুঝিয়ে দিতে হয়।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের মূল্যায়ন পদ্ধতি বোঝার চ্যালেঞ্জটা কমে গেছে। এখন রিপোর্ট কাজ নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এটি যেন অভিভাবকরা সহজে বুঝতে পারেন, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কীভাবে স্বীকৃত হবে, চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে কী করা যায়, সেটি নিয়ে কাজ হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থীর প্রতিটি বিষয় পারদর্শিতার কোন পর্যায়ে আছে, সেটি সাতটি পয়েন্টের একটি স্কেল হবে। এটি রিপোর্ট কার্ডে আছে। এটি আরও সহজবোধ্য করার জন্য কাজ করা হচ্ছে।’
অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন উৎস যেমন ইউটিউব থেকে সংগ্রহ করে তা জমা দিচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যায়ন শেষে গতবার ১১ পৃষ্ঠার রিপোর্ট কার্ড দিতে হয়েছে স্কুলগুলোকে, যা অনেক স্কুলের সক্ষমতার বাইরে ছিল। এবার সেটিকে কমিয়ে ৫ পৃষ্ঠায় আনা হলেও আরও সংক্ষিপ্ত আকারে করতে হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ যাতে বুঝতে পারে, সে ধরনের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। রিপোর্ট কার্ড যাতে অভিভাবকরা সহজে বুঝতে পারেন, সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অংশীজনদের মতামত পর্যালোচনা করতে হবে।