![সরবরাহ বাড়াতে ডলারের দর ছাড়ুন](uploads/2024/02/18/1708231813.Editorial.gif)
নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ‘চাপ’ বা ‘নিয়ন্ত্রণমূলক দর’ ধরে রাখতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভয় হলো, ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ না করলে টাকার একটি ‘ফ্রি ফল’ বা মুক্ত দরপতন হয়ে যেতে পারে, যেটি অর্থনীতির প্রকৃত সক্ষমতার চেয়েও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটি হতে দেওয়া ঠিক হবে না, এমন ধারণা থেকেই নিয়ন্ত্রণমূলক রাখা হয়েছে বিনিময় হার। এখানেই সমালোচকদের আপত্তি। বলা হচ্ছে, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার না হওয়ায় ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। বাজারে মার্কিন ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সংকট এখনো রয়েছে। এ পরিস্থিতিকে সংশ্লিষ্টরা দেখছেন ‘টাইট’ অবস্থা হিসেবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলার পাওয়া যাচ্ছে, তবে দরটা বেশি। কারণ হিসেবে বলছেন, ডলারের দর সমন্বয় না হওয়া বা সমন্বয় না করা। বাজারের বাস্তবতায় এক ডলারের বিপরীতে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তা পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণেই আমদানিতে ডলারের দর নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১৩ থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। প্রকৃত বাজারদরের এ বাস্তবতা বা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত দরের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় মূল্যের পার্থক্যকে বলা হচ্ছে ‘গ্রে এরিয়া’। এই ‘গ্রে এরিয়া’ দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন সমালোচকরা। এদিকে ক্রমবর্ধমান আমদানি চাহিদার বিপরীতে সামনের দিনগুলোতে ডলারের প্রয়োজন আরও বাড়বে।
গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারির ৩১ তারিখে এক ডলার পাওয়া যেত ৮৬ টাকায়। ২০২৪ সালের জানুয়ারি শেষে এক ডলারের বাজারদর ১২৬ টাকায় পৌঁছেছে। দুই বছর ধরে চলমান ডলারসংকটে দেশের আমদানি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি এর ফলে মূল্যস্ফীতিও তীব্র হয়েছে। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি মূল্য এবং পশু ও প্রাণিজ সম্পদের খাদ্যের দামেও এর প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিতে ব্যাংকে ডলারের অভাব নেই। টাকা দিলেই ডলার পাওয়া যাচ্ছে। দর বেশি। এভাবেই চলছে আমদানি। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো ভয়ে আছে যে, ডলারের দর ছেড়ে দিলে টাকার দরপতন হবে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। তাই একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জারি করে রেখেছে।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে সর্বশেষ ডলারের ক্রয় দর নির্ধারণ করে দিয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা (রেমিট্যান্স) এবং বিক্রয় দর ১১০ টাকা। বাস্তবতা হলো, ডলার কিনতে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা ও ব্যাংকগুলোর নিজেদের দেওয়া প্রণোদনা মিলিয়ে ৫ শতাংশ বাড়তি দিয়ে আসছে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কোনো কোনো সময় বেশি দরেও ডলার কিনে ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করছে। এতে ডলার ক্রয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ জন্য বিক্রিতেও ডলারের দর বেশি নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। অভিযোগ আছে, আমদানিতে ব্যাংকে ডলারের দর নেওয়া হচ্ছে ১২৫-১২৬ টাকা পর্যন্ত। ব্যাংকাররা বলছেন, অনানুষ্ঠানিক বাজার বা কার্ব মার্কেটেও ডলারের বিনিময় হার একটু নমনীয় দেখা যাচ্ছে। আন্তব্যাংক বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হলে পরিস্থিতি ‘টাইট’ থাকবে। গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ মোট ২১০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স ও ৫৭২ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় পেয়েছে। ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতিরও সামান্য উন্নতি ঘটেছে। এটিই তাদের সাফল্য। কারণ রিজার্ভ আর ক্ষয় হয়নি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, “এটি আশাব্যঞ্জক খবর যে, জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। তবু পরিস্থিতি একটু ‘টাইট’ আছে। এখনো ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরে ডলারের দরে বড় পার্থক্য রয়েই গেছে। রিজার্ভ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন ভারসাম্যে চাপ অব্যাহত আছে। চলতি হিসাবের উন্নতি হলেও সরকারের আর্থিক হিসাব এখনো নেতিবাচক। চলতি হিসাবে উন্নতি যেটা দেখা যাচ্ছে সেটি আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”
ইউএস ফেড খুব তাড়াতাড়ি সুদহার কমাচ্ছে না। তাই ডলার শক্তিশালী হচ্ছে। সে হিসাবে আগামীতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে পূর্ব থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘায়িত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ভোক্তা পর্যায়ে ও দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে। এ বিষয়টি সরকারকে মাথায় নিয়ে এগোতে হবে। আমদানিতে চাহিদার ছাড় দিলে ডলারের চাহিদা বাড়বে। বাফেদা ও এবিবির সর্বশেষ দেওয়া ডলারের দর বাজারে কার্যকর করতে হবে। ডলার বাজারের নৈরাজ্য থামাতে এবং সরবরাহ বাড়াতে ডলারের সঠিক দরে ছাড়ার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।