![রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় দরকার আন্তর্জাতিক সহায়তা](uploads/2024/02/22/1708572894.Editorial.gif)
বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি এখন রোহিঙ্গা সংকট। মায়ানমারে গৃহযুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ক্রমাগত জটিল আকার ধারণ করেছে। রাখাইনে জান্তা বাহিনী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি জটিল করেছে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়া। ক্যাম্পগুলোতে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। গত রবিবার সকালে কিছু লোক নাফ নদের ওপারে জড়ো হয়েছেন, এমন কয়েকটি ভিডিও খবরের কাগজের প্রতিনিধির হাতে পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের ব্যবস্থাপনা খুব জটিল হয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে মায়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নারিনজারা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সেখানে গ্রামগুলোতে দফায় দফায় বিমান হামলা চলে।
এ সময় গ্রামগুলোর অনেক বাড়িতেই আগুন ধরে যায়। এ ছাড়া রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তাওরেতে অবস্থিত ওয়েস্টার্ন মিলিটারি কমান্ডের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে আরাকান আর্মি। মূলত এখান থেকেই রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা ও নৌ-হামলার নির্দেশনা দিয়ে থাকে জান্তা সেনা কর্তৃপক্ষ।
রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা দিনে দিনে বাড়ছে। কারণ একটা সর্বস্ব হারানো জাতির আর কোনো পিছুটান নেই। ১২ লাখ রোহিঙ্গা ঠাসাঠাসি করে ক্যাম্পে বসবাস করে। এদের মধ্যে দ্রোহ-ক্ষোভ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মায়ানমারের সাম্প্রতিক গৃহযুদ্ধের কারণে সেই সম্ভাবনায় আপাতত আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। মায়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে গেছে। এমনিতেই তারা এক ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। এই নাজুক পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ। রাখাইনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় এখন বাংলাদেশকে মায়ানমারের জান্তা সরকারের পাশাপাশি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু করার তাগিদ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তবে এই প্রস্তাবের আইনি কোনো ভিত্তি নেই। আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ পূর্ণাঙ্গরূপে গ্রহণ করলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
২০১৭ সালে ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সে সময় বিপুল আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ডলারের সহযোগিতা দিয়েছে বলে জানায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি যেন বিশ্বের মনোযোগ হারিয়ে না যায়। রোহিঙ্গা সংকটের দিকে যেন বিশ্বের মনোযোগ বজায় থাকে। বিশ্বব্যাংক এ বছর রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটির জন্য ৭০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অঙ্গীকার করলেও প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কমছে ২০১৯ সাল থেকেই। ডব্লিউএফপি জানায়, ২০২৩ সালের আগে প্রতিজন রোহিঙ্গার জন্য খাদ্যের বাজেট ছিল ১২ ডলার। সেটি কমে এখন ১০ ডলার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, খাদ্যসংকটের খারাপ প্রভাব পড়ায় রোহিঙ্গারা কাজ খুঁজতে ক্যাম্পের বাইরে যেতে চাইছে এবং নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরাও পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, রোহিঙ্গারা আসার পর থেকেই মাদক, চোরাচালান যেমন বাড়ছে, তেমনি বেড়েছে অস্ত্রের ব্যবহারও। তথ্যমতে, ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার প্রয়োজনীয় খাবার খেতে পারে না। শিবিরে ৪০ শতাংশের মতো শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানবিকতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা উচিত। প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা যেভাবে সহায়তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বলেছে, পরবর্তী সময়ে সে কথা রাখেনি। এটা বাংলাদেশের অভিযোগ। আমাদের দাবি থাকবে, তাদের কথা অনুযায়ী বাংলাদেশ যে মানবিকতা দেখিয়েছে, সেটার প্রতি যেন তারা সম্মান দেখিয়ে সহযোগিতা আরও বাড়ায়। পাশাপাশি সংকট সমাধানেও ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহযোগিতা চেয়েছে সেই তুলনায় পাচ্ছে কম। প্রয়োজন এবং প্রকৃত সহায়তা দুটোর মধ্যে পার্থক্য দিন দিন বাড়ছে।’
মায়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশিরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। সেখানকার গোলা এ দেশের ভূখণ্ডে পড়ে বাংলাদেশি নাগরিক মারা যাচ্ছে। এটা স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ ক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া, সীমান্তবর্তী বাংলাদেশিরা যেন দেশটির গৃহযুদ্ধের শিকার না হয়। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো যেন স্থানীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি না হয়, সেদিকটাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খেয়াল রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও সহযোগিতা দিয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।