প্রকৃতির সঙ্গে বিশ্বকবির বোঝাপড়া আজীবনের। তিনি এমন এক সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের পক্ষে কথা বলতেন যখন বিশ্বে পরিবেশ আন্দোলন দানাই বাঁধেনি। তিনি বরাবরই প্রগতি ও সংরক্ষণের মাঝে সম্মিলন তথা ভারসাম্য বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন। নিরন্তর তাই লিখেছেন, বলেছেন এবং বাস্তবানুগ নানা সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সেই ভারসাম্য রক্ষার জন্য। গত শতাব্দীর শুরুতেই তিনি পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। পূর্ব বাংলায় তিনি এসেছিলেন পারিবারিক জমিদারি এস্টেট পরিচালনার উদ্দেশ্যে। তিনি বেশির ভাগ সময় নদী ও বিলে নৌকায় ভ্রমণ করতেন। ‘পদ্মা বোটে’ তিনি প্রায়ই রাতও কাটাতেন। নৌকায় চলার সময় চারপাশের প্রকৃতি ও জীবন তার চোখে নতুন করে ধরা পড়ত। নদীর কিংবা চলন বিলের পাড়ে নৌকা থামিয়ে রাত কাটাতেন। ওপরে তারায় ভরা উন্মুক্ত আকাশ। পাড়ে নিস্তব্ধ প্রকৃতি। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ভোরে পাখির কিচিরমিচির। সকালে গৃহিণীরা আসতেন বাসনকোসন মাজতে। স্নান করতে। আর সংসারের নানা দুঃখ ও সুখের আলাপ করতেন তারা। কবির মন ভরে যেত প্রকৃতি ও মানুষের এই সম্মিলনের অনুভবে। সেই অনুভবের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তার লেখা গানে, কবিতায়, ছোট গল্প, চিঠিতে, উপন্যাস ও নাটকে। তাই তো তার লেখায় নদী ও নারীর এতটা প্রাধান্য।...
বিশ্বকবির প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যের গভীরতা খুঁজে পাওয়া যায় তার সাহিত্য কর্মে। তার লেখা গানে, ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো/ ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো’। যে উচ্ছল প্রকৃতির সন্ধান মেলে এই গানে তা আমাদের মনোজগতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। প্রকৃতি ও পৃথিবীকে সংরক্ষণের আহ্বানে ভরা তার ‘প্রকৃতি পর্যায়ে’র লেখাগুলো। তিনি শুধু লিখেই ক্ষান্ত হননি। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার নানা সামাজিক উদ্যোগও নিয়েছেন পূর্ববাংলায় এবং ‘শান্তিনিকেতনে’। পুরো ‘শান্তিনিকেতন’ তিনি গড়ে তুলেছেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের ধারণা থেকে। আর এর মাধ্যমে তিনি প্রকৃতি ও মানুষের গভীর সম্পর্কের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গাছের শীতল ছায়ায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান, প্রকৃতির কোলে নববর্ষ উদযাপন, পৌষ মেলা ছাড়াও আরও কত উদ্যোগই না নিয়েছেন। প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে জীবনচলা ও শিক্ষাদানের লক্ষ্যে। সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে আজও তার এই প্রকৃতিপ্রেমের উদাহরণ অনুসরণ করে চলেছে। তার এই প্রকৃতিপ্রেমের দর্শনের তল খুঁজতে হলে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিবান্ধব স্থাপত্য কাঠামো, শান্তিনিকেতনের বাসিন্দাদের প্রতি তার অনুরাগ, পূর্ববাংলার খেটে খাওয়া কৃষক-প্রজাদের প্রতি তার যে প্রীতির বন্ধন, শান্তিনিকেতনে হালকর্ষণ উৎসবের সূচনা, জলসেচের জন্য পুকুর খনন, শান্তিনিকেতনে সমবায় গঠন, গ্রামীণ মেলার আয়োজন, ‘অরণ্য দেবতায়’ প্রতিফলিত তার বৃক্ষপ্রেম, পূর্ববাংলায় পতিসরে প্রজাদের জন্য আধুনিক কৃষির প্রবর্তন, পতিসরে গ্রামীণ সমবায় ব্যাংক, স্কুল এবং চিকিৎসালয় স্থাপনের উদ্যোগের পেছনে তার প্রান্তজনের প্রতি দায়বোধের ও ‘লোকহিত’ চিন্তার অনুসন্ধান করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
শান্তিনিকেতনে তিনি গাছের ছায়ায় পাঠদানের যে ব্যবস্থা করেছিলেন তাতে শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির খুব কাছাকাছি নেওয়ার একটা অভিনব প্রচেষ্টা ছিল। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মনের অজান্তেই প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাবে বলে বিশ্বকবি প্রত্যাশা করেছিলেন। বাস্তবেও সেটি অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল। আজও শান্তিনিকেতনে তার শুরু করা প্রকৃতিপ্রেমের প্রতিফলন স্পষ্টতই চোখে পড়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহের শেষে আসে বর্ষা। নামে স্বস্তির বারির্বষণ। আর বর্ষার এই আগমনকে উদযাপন করতে তিনি শুরু করেন বার্ষিক ‘বর্ষা মঙ্গল’ অনুষ্ঠান। শীতের আয়োজন পৌষমেলার কথা অনেকেরই জানা।
রবীন্দ্রনাথ বরাবরই নদীর সঙ্গে জীবনের তুলনা করতেন। নদীর প্রবাহের মাঝে মানুষের জীবনচলার সম্পর্ক তিনি খুঁজে পেতেন। তাই তো তিনি কলকাতার নগর জীবনে ইটের ওপরে ইটের উপস্থিতিতে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও স্নেহের সম্পর্ক খুঁজে পাননি। পাশাপাশি তিনি গ্রামবাংলায় মানুষে মানুষে প্রাগাঢ় প্রীতি ও বন্ধনের উদাহরণ দিতেন। কী করে নগর ও গ্রামের শিল্প ও সংস্কৃতির বন্ধন আরও সুদৃঢ় করা যায় সে বিষয়টি তাকে বরাবরই ভাবাত। গ্রামবাংলার প্রকৃতির রূপান্তর, বিশেষ করে বর্ষাকালে শুকনো নদীর ফুলেফেঁপে ওঠার দৃশ্য দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। রাস্তার দুপাশে শাল গাছের ছায়ায় দুদণ্ড দাঁড়ানোর মতো প্রকৃতিচিন্তায় তিনি বিভোর হয়ে থাকতেন। সুযোগ পেলেই তিনি শিলাইদহে বাউলদের সঙ্গে সংগীত আড্ডা দিতেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে প্রচুর পরিবেশ ভাবনার খোঁজ মেলে। তার ‘বলাই’ গল্পে বাড়ির সামনে শিমুল গাছটির সঙ্গে এক বালকের যে প্রেম তাতে মানুষ ও প্রকৃতির গভীর বন্ধনেরই কথা বলে। ‘দুইপাখি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ খাঁচায় আবদ্ধ একটি পাখির যে মনোবেদনা, স্বাধীনতাহীনতার দুঃখ তুলে ধরেছেন তাতে প্রকৃতির যাতনার কথাই ফুটে উঠেছে। ‘মুক্ত’ ও ‘বন্দি’ পাখির মনের কথায় প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ সুদূরপ্রসারি সার্বিক স্বাধীনতার মর্মকথাই ফুটিয়ে তুলেছেন।
তিনি লিখেছেন–
‘দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
বুঝাতে নার আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মারে পাখা,
কাতরে কহে, ‘কাছে আয়!’
বনের পাখি বলে- না,
কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
খাঁচার পাখি বলে- হায়,
মোর শকতি নাহি উড়িবার।’
পূর্ববাংলায় এসে তিনি নদীতেই অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। তাই তার চিঠিতে নদীর কথা এসেছে বারে বারে। ভিন্ন ভিন্ন রূপে। বর্তমানে যে হারে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটেছে তার প্রতিফলন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা থেকেই বুঝতে পারছি। বায়ু ও পানিদূষণের মাত্রা দেখেও বুঝতে পারি আমাদের জীবনচলা কতটা বিপন্ন। উপকূলবাসীর জলবায়ু শরণার্থী হওয়ার প্রবণতা থেকেও অনুমান করতে পারি আগামী দিনে আমাদের অস্তিত্ব কতটা বিপন্ন হতে পারে।
এমনি এক বাস্তবতায় আমরা ফিরে যেতে পারি রবীন্দ্রনাথের উদ্দীপনামূলক গানে, কবিতায়, চিঠিতে ও প্রবন্ধে পরিবেশ রক্ষায় নতুন করে শপথ নেওয়ার অভিপ্রায়ে। সাংস্কৃতিক আবরণে প্রকৃতিপ্রেমের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ পরিবেশ রক্ষার যে কালজয়ী আবেদন রেখে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা এক কথায় হৃদয়স্পর্শী। তাই নতুন প্রজন্মকে রবীন্দ্রচর্চার মাধ্যমে যত বেশি পরিবেশ সচেতন করতে পারব ততই এই পৃথিবীর মঙ্গল। আমাদের মঙ্গল হবে। আর সে জন্যই চাই আরও বেশি রবীন্দ্রচর্চা। আরও বেশি পরিবেশপ্রীতি।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক