দেশে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে খেজুরগাছ। এ গাছ কমে যাওয়ার একটি কারণ হলো অনেকেই বেশ চড়া দামে ইটভাটার মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। তারপর নতুন করে আর কেউ খেজুরগাছ লাগান না। তা ছাড়া গ্রামীণ সড়ক প্রশস্ত করার কারণেও অনেক স্থানে খেজুরগাছ উজাড় হয়ে গেছে। তবে ব্যতিক্রম গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধারমানিক এলাকায় ১০৫ একর জায়গাজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটির অবস্থান। আর এই ফিল্ম সিটিতেই রয়েছে চার শতাধিক খেজুরগাছ। এসব গাছ থেকে প্রতিবছর শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। চলতি বছরেও খেজুরের রসের জন্য প্রায় ৩০০টি খেজুরগাছ প্রস্তুত করা হয়েছে।
খেজুরগাছ আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য লালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। শীতকালে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর অন্যতম উপকরণ খেজুরের রস। খেজুরের রস থেকে তৈরি হয় গুড়। তাই শীতকালে খেজুরগাছের গুরুত্ব বেড়ে যায়। গ্রামে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হলেও তা মাটির কলসে করে শহরাঞ্চলে বিক্রি করতে দেখা যায়। তাই শহরের মানুষের কাছেও খেজুরের রস এবং রস থেকে তৈরি বিভিন্ন খাবার অত্যন্ত প্রিয়।
সাধারণত চার বছর বয়সের পর থেকে খেজুরগাছের রস আহরণ শুরু হয়। গাছ এক বিশেষ পদ্ধতিতে চেঁছে তা থেকে রস নামানো হয়। শীত আসার আগেই খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য শুরু হয় প্রাথমিক প্রস্তুতি। গাছের যত্নে গাছিরা তখন মহাব্যস্ত সময় কাটান; অবহেলায় পড়ে থাকা খেজুর গাছগুলোর কদর বেড়ে যায়।
দেশের প্রতিটি জেলাতেই খেজুরগাছ রয়েছে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে খেজুরগাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। খেজুরের পাতা ও খেজুরের রস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।
একটি পূর্ণ বয়স্ক খেজুরগাছ দিনে দুই থেকে চার লিটার রস দিতে পারে। সপ্তাহে ২-৩ দিন বিরতি দিয়ে এভাবে শীত মৌসুমে প্রায় দুই মাস রস পাওয়া যায়।
কৃষিবিদদের মতে, সাধারণত অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা যায়। একজন গাছি প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত গাছ কাটতে পারেন, যা থেকে ৩০-৩৫ মণ গুড় তৈরি হয়।
খেজুরগাছের পাতা দিয়ে পাটি তৈরি হয়ে থাকে। পাটি তৈরি করতে খেজুরগাছের ‘ডাইগ্যা’ লাগে। মৌসুমে একটি গাছের ২০টি পর্যন্ত ‘ডাইগ্যা’ কাটা যায়। একটি পাটি তৈরি করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। সুতরাং কুটিরশিল্পের উপকরণ হিসেবেও খেজুরগাছের গুরুত্ব রয়েছে।
তাছাড়া খেজুরগাছ বেড়া হিসেবেও কাজে লাগে এবং তা মাটিক্ষয় রোধ করে। খেজুরগাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, আয়ুর্বেদী ওষুধ তৈরিতেও খেঁজুর, খেঁজুরের রস, মাথি এবং খেজুর গাছের শিকড় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
খেজুরগাছের জন্য আলাদা কোনো চাষের জমির প্রয়োজন হয় না। বাড়ির চারপাশে জমির আইল, পুকুরের পাড়, বেড়িবাঁধ, রাস্তা ইত্যাদি স্থানে খুব সহজেই খেজুরগাছ লাগানো যায়।
আমাদের দেশে বিক্ষিপ্তভাবে খেজুরগাছের অস্তিত্ব থাকলেও যশোর, ফরিদপুর ও খুলনা জেলার কিছু অঞ্চলে খেজুরগাছ বেশি দেখা যায়। তবে বর্তমানে খেজুরগাছের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। খেজুরগাছের রস সংগ্রহের জন্য গাছিদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনেকে খেজুরগাছ লাগানো বাদ দিয়ে অন্য ফলের গাছ লাগাচ্ছেন।
তবে এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটি ব্যতিক্রম। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটক থেকে শুরু করে দুই পাশের দীঘির পাড়ে সারি সারি ছোট-বড় খেজুরগাছ। কয়েক মাস ধরে চারজন গাছি ও তিনজন সহকারী এসব খেজুরগাছ রস সংগ্রহের উপযোগী করে তুলছেন। শিগগিরই শুরু হবে রস বাজারজাত ও গুড় উৎপাদন কার্যক্রম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটির ইনচার্জ আব্দুস সোবহান বকুল জানান, ফিল্ম সিটির আয়তন ১০৫ একর। এখান থেকে সরকারি বিধি মোতাবেক ৬০ বিঘা জমি লিজ দেওয়া হয়েছে জনৈক রিজভী আহমেদ মিল্টনকে। লিজ দেওয়া জমিতে রিজভী আহমেদ রোপণ করেছেন চার শতাধিক খেজুরগাছ, যার বেশির ভাগই এখন রস উৎপাদনের উপযোগী হয়ে উঠেছে।
রিজভী আহমেদ মিল্টন খবরের কাগজকে জানান, তিনি ৬০ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন খেজুরগাছ রোপণের জন্য। খাঁটি খেজুরের গুড় তৈরি ও রস সংগ্রহের জন্যই তিনি অন্য ফলের গাছ বাদ দিয়ে খেজুরগাছ রোপণে মনোনিবেশ করেছেন। এই খেজুরগাছ থেকে তিনি উৎপাদন করছেন গুড় ও চাহিদা মেটাচ্ছেন রসের।
রিজভী আহমেদ বলেন, ‘আমি ন্যাচারাল ফুড উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকি। এ জন্য আমি এই জমিটি লিজ নিয়েছি। এখানে চার শতাধিক খেজুরগাছ রয়েছে। চলতি বছর প্রায় তিন শতাধিক খেজুরগাছ রস সংগ্রহ উপযোগী করা হয়েছে। শিগগিরই রস নামানো শুরু হবে। প্রতিদিন ৩০০ লিটার রস পাওয়া যাবে। রস বিক্রি হবে ৬০ টাকা লিটার দরে। বিক্রির পর অবশিষ্ট রস দিয়ে তৈরি হবে গুড়। বাজারে যে ভেজাল বা চিনি মিশ্রিত গুড় পাওয়া যায়, এটা থেকে বেরিয়ে সাধারণ মানুষকে ভালো মানের খাঁটি খেজুরের গুড় খাওয়াতে চাই।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গাজীপুরে খেজুরগাছ খুবই কম। তবে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটিতে এখন সারি সারি খেজুর গাছ। প্রতিদিন সকালে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে খেজুরের রস সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এখানকার খেজুরের রস নির্ভেজাল। পাশাপাশি এখানে মানসম্মত খেজুরের গুড় তৈরি হয়, যা খুবই সুস্বাদু।
একসময় শীত মৌসুম শুরু হতেই বাড়ি বাড়ি চলত খেজুরের রস কিংবা রসের পাটালি গুড় দিয়ে পিঠা তৈরির আয়োজন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে গাছের সংখ্যা অনেক কমে যাওয়ায় এসব আয়োজনও হ্রাস পেয়েছে।
দিন দিন কমে যাচ্ছে খেজুরগাছের সংখ্যা। কয়েক বছর আগেও শীতের সকালে দেখা যেত রসের হাঁড়ি ও খেজুর গাছ কাটার সরঞ্জামসহ গাছিদের ব্যস্ততার দৃশ্য।
গাছিরা যে রস সংগ্রহ করতেন তা দিয়ে ফিরনি, পায়েস এবং খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড় দিয়ে ভাঁপা পিঠা এবং গাঢ় রস দিয়ে খাওয়া হয় মুড়ি, চিড়া, খই ও চিতই পিঠাসহ হরেক রকম পিঠাপুলি। খেজুরের রস পান করলে শরীরের দুর্বলতা দূর হয়। এতে প্রাকৃতিক চিনি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে খেজুরের রস পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সাধারণত খেজুরগাছের বয়স চার বছর হলে রস আহরণ শুরু হয়। পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয় এবং রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়।
রস সংগ্রহের অনুকূল সময় ও আবহাওয়া অগ্রহায়ণ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। ঠাণ্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল পর্যাপ্ত রসের জন্য উপযোগী। এই সময়ে প্রাপ্ত রসের স্বাদও ভালো হয়। পৌষ-মাঘ মাসে (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি) সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের পরিমাণও কমতে থাকে।