রাজশাহী নগরপ্রান্তে পদ্মা নদীতে জেগেছে অনেক চর। সেখানে বসেছে চকাচকির মেলা। বিনোদনে ব্যবহৃত নৌকাগুলো শোরগোল করে পাশ দিয়ে চলে যায়, চকাচকি কিন্তু নির্বিকার। তারা কেউ পানিতে মুখ ডুবিয়ে খাবার খাচ্ছে, কেউ কেউ পানিকাদায় দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
নির্ভীক এই চকাচকিগুলো দেখে মনে হলো, এদেশ সত্যই উন্নত হয়েছে। দেশের মানুষ এখন হাতের কাছে চকাচকি পেলেই তা মেরে রান্নাঘরে নেওয়ার কথা ভাবে না। তাই মানুষ কাছে এলে চকাচকিগুলো তড়িঘড়ি উড়ে পালাবার কথাও ভাবছে না। বিগত শতাব্দীতে বাংলাদেশে এমন দৃশ্য আমরা খুব কমই দেখেছি।
শত বছর আগে পদ্মায় চকাচকি দেখে রবিঠাকুর লিখেছিলেন: ‘আজ কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখীর মেলা!’ তার আমলে ছেলে পাখিটিকে ‘চখা’ আর মেয়েকে ‘চখী’ বলা হতো। পরে অবশ্য ছেলেমেয়ে সবারই নাম হয়েছে চকাচকি। ভালোই হয়েছে। বুনোপাখিদের ছেলেমেয়ের আলাদা নাম রাখলে খামোখা জটিলতা বাড়ে।
গেরুয়া-পালকে মোড়া সুদর্শন এই হাঁসের পোশাকি নাম খয়রা-চকাচকি, ইংরেজিতে ‘রাডি শেলডাক’। বাংলাদেশে আরও এক প্রজাতির চকাচকি আছে, নাম পাতি-চকাচকি। নদীচরে ও হাওর-বিলে পাতি-চকাচকির চেয়ে খয়রা-চকাচকির সংখ্যা অনেক বেশি। লোকে তাই চকাচকি বলতে খয়রা-চকাচকিই বোঝে।
পদ্মার পানি ও চরের কাদামাটিতে চকাচকির আহার্যের অভাব নেই।
চকাচকি সর্বভুক, ঘাস-পাতা থেকে শুরু করে পানিতে ভেসে চলা অদৃশ্য অণুজীব পর্যন্ত সবই সে খেতে পারে। মানুষের আনাগোনা বেশি হলে দিনে নিদ্রা দিয়ে সে নিশুতি রাতে ভোজনে নামে। রাতের আঁধারে খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করে।
মাছের অভাবে এ দেশের জলাশয়ে বক, পানকৌড়ি ও মাছরাঙার মতো অভুক্ত থাকে না চকাচকি। শীতে সংকীর্ণ পদ্মা ও যমুনার ঘোলাপানিতে আজও চকাচকির মতো কাদা-ছাঁকা হাঁসের জন্য আহার্যের প্রাচুর্য আছে। আজও তাই এসব নদীচরে চকাচকির মেলা দেখার ভাগ্য হয় আমাদের।
আগে ধনীরা শীতের দিনে নদীতে নেমে বন্দুক দিয়ে হাঁস শিকার করে বেড়ানোকে আভিজাত্যের অঙ্গ মনে করতেন। আসলে সেটা ছিল বিদেশি সাহেবদের অতিপ্রাচীন শৌখিনতারই অনুকরণ। বন্দুক ঘাড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সেদিনের মানুষ নিজেদেরকে নকল-সাহেব বা নব্য-নবাব মনে করতে পারতেন।
সেই মেকি-সাহেবদের যুগ শেষ হয়েছে। আজ আর মানুষের ভয়ে নদীর চরে চকাচকিরা ছোটাছুটি করে না। ছবি তোলার জন্য আমরা ক্যামেরা তাক করলেও চকাচকিগুলো তেমন বিচলিত হলো না। সাদাটে শির উঁচু করে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করল, তারপর আহারে মন দিল।
তবে দেশের সবখানেই যে চকাচকিরা সমান নিরাপদে আছে, তা কিন্তু নয়। বিষ দিয়ে হাঁস মারার নতুন এক কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে উপকূলের কাদাচরে ও হাওরে। নতুন এই ‘শিকার’ পদ্ধতিটি পুরোপুরি দেশি টেকনোলজি। এখানে শিকারের বাহাদুরিটুকু নেই, আছে শুধু গোপন-হত্যা, রাতের আঁধারে বস্তাভর্তি মৃতদেহ বহন ও গোপনে হাঁসের লাশ রেস্তোরাঁয় পাচার করা।
আমাদের প্রত্যাশা, এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ দেশের হাওর, বিল ও উপকূল রাজশাহীর পদ্মাচরের মতোই চকাচকির জন্য নিরাপদ হবে। চিরন্তন বাংলার প্রেমের প্রতীক এই চকাচকি হাঁসের মুখে বিষ দিয়ে সেই বিষাক্ত মাংস রেস্তোরাঁয় পরিবেশন করা সম্পূর্ণ বন্ধ হবে।
পৃথিবীর সব চকাচকির একটি বড় অংশ শীতে বাংলাদেশের জলাশয়ে থাকে। শীতের শেষে এদেশ থেকে উড়াল দিয়ে হিমালয় পেরিয়ে মঙ্গোলিয়া গিয়ে এরা পাহাড়ি হ্রদের পাশে বাসা বাঁধে। সেখানে প্রজনন শেষে শরৎকালে এরা আবার এ দেশের নদীচরেই ফিরে আসে। কোটি বছর ধরে চলছে এই আসা আর যাওয়া।
পদ্মার চরে চকাচকির শীতের আবাস গড়ে উঠেছে, এখানে মানুষের বসতি হওয়ার লাখ লাখ বছর আগে। নবাগত হয়ে আমরা কি এই আদি বাসিন্দাদের উৎখাত করতে পারি! বিশেষ করে আমাদের ভালোভাবে পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই তো এদের টিকিয়ে রাখা দরকার।