বৈশাখের এক মাঝ দুপুরে দাবদাহে ছটফট করতে করতে একটু শান্তি চাইলাম শালগাছদের কাছে। কিন্তু কোথায় শান্তি! বনের ওই গাছগুলোও উলঙ্গ হয়ে গায়ে রোদ মাখাচ্ছে, রোদে পুড়ে খাক হচ্ছে।
এখন তো পাতাঝরা শালগাছগুলোতে নতুন পাতা আসার কথা। কিন্তু দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওয়ের মাঝে বীরগঞ্জের ভোগনগর ইউনিয়নে সিংড়া শালবনের শালগাছগুলোতে কোনো নতুন পোশাক নেই। বড়ই বিচিত্র এ দেশের প্রকৃতি। টাঙ্গাইল, সাভার, গাজীপুর আর ঢাকায় জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের শালগাছগুলো যেখানে নবপত্রপল্লবে সুশোভিত, সেখানে সিংড়া শালবনের গাছ এখনো নিষ্পত্র, এখনো বাতাসে বাতাসে ঝরে পড়ছে পুরোনো পাতারা। কোনো ছায়া নেই সে বনের ভেতর।
তবে বনের ভেতর এক আশ্চর্য গাছের দেখা পেলাম, যার ফল হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম শিম। অর্থাৎ শিমগোত্রীয় যত গাছ আছে, সেগুলোর মধ্যে এই গাছের ফল সবচেয়ে বড়। এদের একেকটা ফলের দৈর্ঘ্য ২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
আকাশে গনগনে সূর্য। ওপরে তাকাতেও সাহস হয় না, চোখ জ্বলে। সিংড়া শালবনের বিট অফিসার গয়াপ্রসাদ পাল একটু ছায়া দেওয়ার জন্য একটা বিশাল জারুল গাছের কাছে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘যে গাছ আপনি খুঁজছেন সেটি ওই, গিলা লতার গাছ।’ গাছটির কথা কয়েক বছর আগে শুনেছিলাম দিনাজপুর আরডিআরএস বিশ্রামাগারের জনৈক রিসেপশনিস্টের মুখে। সেখানে একটি ঢাউস গিলা লতার ফল সাজিয়ে রাখা ছিল। দেখেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথা থেকে আনা হয়েছে ওটা? বলেছিলেন, এক বিদেশি সাহেব ঘুরতে গিয়েছিলেন সিংড়া শালবনে। তিনি ওই ফল দেখে সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন। আমরা যত্ন করে শো পিস হিসেবে এখানে রেখে দিয়েছি।
দুষ্প্রাপ্য সেই গিলা লতার গাছ এখন চোখের সামনে। কিন্তু লতা কোথায়? গয়াপ্রসাদকে দেখে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের যুগলপ্রসাদের নাম মনে পড়ল, বনের গাছপালার প্রতি যার ছিল অগাধ মমতা। গয়াপ্রসাদেরও কি তাই? জানালেন, সিংড়া শালবনে নেই, অথবা হারিয়ে গেছে এরূপ ২২ প্রজাতির গাছ এবার লাগানো হয়েছে এ বনে। আটটি শকুন পালন করে ছাড়া হয়েছে। বনটাকে কিছুটা জীববৈচিত্র্যময় করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি যে গাছটিকে গিলা লতা গাছ বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তা দেখে সে গাছকে ঠিক গিলা লতা গাছ বলে মেনে নিতে মন সায় দিচ্ছে না। লতা কোথায়? মূল গিলা লতার গাছ তো দেখছি মোটাসোটা শালগাছের মতোই।
একদিকে হেলে পড়ে লতাটা উঠে গেছে আকাশের দিকে। উঠে আশেপাশের সব গাছের মাথায় মাখামাখি ও জড়াজড়ি করে চলে গেছে দুই-তিনশ হাত দূরে। হয়তো ভবিষ্যতে লতা না কাটলে আরও বহুদূর পর্যন্ত ছড়াবে। এমন বড় আর কাষ্ঠল লতা এর আগে আর চোখে পড়েনি। নিশ্চয়ই সেটা অনেক পুরোনো গাছ, বয়স অনেক। এক গাছ থেকে আরেক গাছে এই লতা বেয়ে সাঁকোর মতো চলাচল করা যায়।
সেটিই করে দেখালেন সিংড়া শালবনের কর্মী মামুন। তরতর করে শাখামৃগের মতো ওপরে উঠে গেলেন লতা বেয়ে, এরপর সেই গাছ থেকে একটা ফল পেড়ে নিয়ে এলেন। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ফলটা। আরও অনেক ফল ঝুলছে গাছে। সবই শুকিয়ে কাঠ, ফেটে বীজ ছড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। ফলটা মেপে দেখলাম, লম্বায় পাক্কা দুই হাত, তেরোটা বীজ গোলাকার চাকতি বা সসারের মতো গিঁটের ভেতরে রয়েছে।
বীজ চ্যাপ্টা গোলাকার, উজ্জ্বল চকচকে বাদামি। পাকা ফল ধরে নাড়ালে ঝনঝন করে বীজগুলো ভেতরে বেজে উঠল। হিন্দুদের অন্নপ্রাশন, বিয়ে ও গায়ে হলুদ- এসব অনুষ্ঠানে এখনো গিলা বীজের ব্যবহার অনিবার্য। অতীতে গিলা ফল ব্যবহার করে দর্জিরা পাঞ্জাবির দুটো হাতায় ভাঁজ ফেলতেন। সে জন্য সে পাঞ্জাবিকে বলা হতো গিলা করা পাঞ্জাবি। এখন এর চল সেভাবে নেই। তবু বাজারে গিলা ফল বানিয়াতি দোকানে পাওয়া যায়।
গিলা লতার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Entada rheedii ও গোত্র ফ্যাবেসি, অর্থাৎ শিমগোত্রীয় গাছ। এদের ফলও শিমের মতো চ্যাপ্টা ও লম্বা। পাতা যৌগিক। কিন্তু ফল যত বড়, পাতা সে রকম বড় না। ঝরে যাওয়া গাছে দেখলাম নতুন কিছু পাতা এসেছে, এসেছে লম্বা শীষে ফুলের কুঁড়িও।
গাছের লতা ছোট ও প্রথম অবস্থায় সরু থাকলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কাষ্ঠল ও মোটা হয়ে যায়। মোটা গুঁড়ির মতো কাণ্ড থেকে যেসব লতা বের হয়, পুরোনো সেসব লতার গড়ন হয় চ্যাপ্টা শিরযুক্ত স্ক্রুর মতো পাকানো। পাকটা থাকে ঘড়ির কাঁটা ঘোরার উল্টো দিকে। বেশ শক্ত লতা। গয়াপ্রসাদ বললেন, ফল গাছে রাখার উপায় নেই, কবিরাজরা মাঝে মাঝে এসেই নিয়ে যায়। মনে হয়, এই গাছটির কিছু ঔষধি গুণ আছে। গাছটি দুষ্প্রাপ্য হলেও তা সংরক্ষণে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।