ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের সেই ক্যামেলিয়া

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫৫ পিএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:০৫ এএম
রবীন্দ্রনাথের সেই ক্যামেলিয়া
ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে জানুয়ারিতে ফোটা ক্যামেলিয়া ফুল। ছবি: লেখক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফুল অসম্ভব ভালোবাসতেন। দেশ-বিদেশের যেখানেই যেতেন, সেখান থেকে অপরিচিত গাছ এনে লাগাতেন শান্তিনিকেতনে। অনেক বিদেশি ফুলের তিনি মিষ্টিমধুর বাংলা নামও দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যামেলিয়া ফুলের কোনো বাংলা নাম দেননি। ক্যামেলিয়া আসলে এ দেশের ফুল না, এমনকি ভারতবর্ষেরও না। 

এই ফুলগাছের আদি নিবাস চা-গাছের মতোই চীনদেশে, জাপানে না। চীনদেশেই এগারো শতকে প্রথম ক্যামেলিয়ার চাষ শুরু হয়। দার্জিলিংয়ের মংপুতে গৌরী দেবীর বাড়িতে প্রথম দেখাতেই ক্যামেলিয়া ফুলের রূপে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়েছিলেন। উজ্জ্বল চকচকে গাঢ় সবুজ পাতাওয়ালা ঝোপ ঝোপ গাছে গোলাপের মতো লাল রঙের ফুটে থাকা ফুলগুলোর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ঢাকায় বলধা গার্ডেনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বলধা গার্ডেনে রয়েছে খাঁচার মতো ঘেরা দেওয়া লাল ও সাদা ফুলের অনেক প্রাচীন ক্যামেলিয়াগাছের একটি ছোট্ট বাগান, যাকে বলা হয় ক্যামেলিয়া হাউস। সেখানেও অনেক ফুলের ভিড়ে ক্যামেলিয়া কবিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২৭ শ্রাবণ তার বিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি লেখেন। চিত্রকল্পময় দীর্ঘ সেই কবিতাটিতে উঠে এসেছে এক সাঁওতাল মেয়ের সাজসজ্জায় ক্যামেলিয়া ফুল, সে এক অদ্ভুত রোমান্টিকতা! বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, ‘বাবু, ডেকেছিস কেনে?’/ বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া/ সাঁওতাল মেয়ের কানে,/ কালো গালের উপর আলো করেছে।/ সে আবার জিজ্ঞেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে।’/ আমি বললেম, ‘এইজন্যেই।’ পরবর্তীকালে ক্যামেলিয়া কবিতাটির ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সজল সমাদ্দার। ইংরেজ কবি শার্লট এলিজাবেথ টোনা ১৮৩৪ সালে ক্যামেলিয়া ফুলকে নিয়ে ‘দ্য হোয়াইট ক্যামেলিয়া জাপোনিকা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। জাপানে ক্যামেলিয়া ফুল জনপ্রিয়। এ ফুলের ছবি দিয়ে সে দেশে ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়েছে।

সেই ক্যামেলিয়া ফুল আমি প্রায় দশ বছর আগে দেখি বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশের ক্যামেলিয়া হাউসে। বহুদিন পর আবার সেই ক্যামেলিয়ার দেখা পেলাম ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের নার্সারিতে। গাছ আলো করে শীতের দিনে সুন্দরের ওম ছড়াচ্ছে লাল রঙের ক্যামেলিয়া ফুলগুলো। দেখতে গোলাপের মতো আর পাতা দেখতে চা-গাছের পাতার মতো। চা-গাছ ও ক্যামেলিয়াগাছ দুই সহোদরা, একই থিয়েসী পরিবারের, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Camellia japonica. এই গাছ ছোট বৃক্ষ বা গুল্ম-প্রকৃতির। গাছ ২ থেকে ৬ মিটার লম্বা হয়। পাতা মসৃণ, চকচকে ও গাঢ় সবুজ, নিচের পিঠ হালকা সবুজ, পাতার অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ, পাতার কিনারা খুব সূক্ষ্মভাবে খাঁজ কাটা। 

ডালে পাতার কোল থেকে সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় কুঁড়ি বের হয় বা ফুল ফোটে। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ফুল ফোটে। ফুলের পাপড়ির রং নির্ভর করে জাতের ওপর। ফুলের মাঝখানে তিন খাঁজবিশিষ্ট একটি গর্ভমুণ্ডসহ স্ত্রীকেশর থাকে ও তার চারপাশে সুতার মতো অসংখ্য পুরুষকেশর থাকে। পাখি ও প্রজাপতিরা পরাগায়ন ঘটায়। পরাগায়নের পর ফল হয়। ফল গ্লোবাকৃতি, ফলের ভেতরে দুটি বাদামি রঙের বীজ থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফল পাকে। বীজ থেকে চারা হয়। বিশ্বে ক্যামেলিয়ার শত শত জাত রয়েছে। আমাদের দেশে লাল, গোলাপি ও সাদা রঙের ফুলের ক্যামেলিয়ার তিনটি জাত চোখে পড়ে। ছায়াঘরের ভেতরে ক্যামেলিয়ার চাষ ভালো হয়।

বাংলার নামে কাঠঠোকরা

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:২০ এএম
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:২১ এএম
বাংলার নামে কাঠঠোকরা
ছবি: লেখক

পাখির নাম ‘বাংলা-কাঠঠোকরা’! বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সহজেই এর দেখা মেলে। পার্বত্য এলাকা ছাড়া ভারতের অনেক জায়গাতেই আপনি এ পাখি দেখতে পাবেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এ পাখির দেখা মিলবে না সহজে। 

আমাদের পাশের দেশ মায়ানমার, নেপাল ও ভুটানেই নেই এ পাখি। আমরা তাই সাদরে এর নাম রেখেছি ‘বাংলা-কাঠঠোকরা’। আমাদের আর দোষ কী; প্রাণীর আন্তর্জাতিক নামকরণের জনক ‘কার্ল লিনে’ নিজেই এর নামে ‘বেঙ্গল’ কথাটা জুড়ে দিয়েছিলেন। তাই বাংলা-কাঠঠোকরার আন্তর্জাতিক নাম হয়েছে ‘ডাইনোপিয়াম বেঙ্গলেন্স’। 

বাংলার বৃক্ষঘেরা পাড়াগাঁয়েই শুধু নয়; কংক্রিটের এই কঠিন নগরীতেও আপনি বাংলা-কাঠঠোকরার দেখা পাবেন। হয়তো দেখতে পাবেন প্রাচীন কোনো পথতরুর কাণ্ড আঁকড়ে ধরে সে নীরবে বসে আছে। বৃষ্টি নামলে প্রায়ই দেখবেন, মাটি ছেড়ে পিঁপড়ার দল পড়িমরি করে গাছের গা বেয়ে ওপরে উঠছে। পিলপিল করে গাছ-বাওয়া ওই পিঁপড়া বাহিনীই হলো অপেক্ষমাণ কাঠঠোকরার জন্য ধাবমান আহার্যের অসামান্য এক কনভেয়র বেল্ট। পাতাভুক কীটপতঙ্গ দমন করতে পৃথিবীতে যেমন পিঁপড়ার দরকার আছে; পিঁপড়ার বাড়বাড়ন্ত রোধ করার জন্য তেমনই প্রয়োজন রয়েছে কাঠঠোকরার। 

তাই বিশ্বের তাবৎ বনে ও বাগানে সারা দিনমান কীটপতঙ্গ ও পিপীলিকা দমনের কাজটি করে যায় কাঠঠোকরাদের বিশাল বাহিনী। পৃথিবীতে আছে ২৫৬ প্রজাতির কাঠঠোকরা এবং বাংলাদেশের মতো ছোট্ট এই দেশেও রয়েছে ২০টি প্রজাতির বসবাস। আমাদের জন্য আরও আকর্ষণীয় সংবাদ, বাংলাদেশেই বাস করে বিশ্বের বৃহত্তম ও ক্ষুদ্রতম কাঠঠোকরা। বিশ্বের অতিকায় কাঠঠোকরাদের অন্যতম হলো বাংলাদেশের পাহাড়ি-বনের এক বিরল বাসিন্দা, যার বাংলা নাম ‘বড় মেটেকুড়ালি’। খুদেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তিলা কুটিকুড়ালি’ ও ‘ধলাভ্রু কুটিকুড়ালি’ এবং এই দুটি প্রজাতিরই বসবাস আমাদের পাহাড়ি-বন ও সুন্দরবনে। 

খুদে ও অতিকায় ওই দুই ‘এক্সট্রিম’ বা প্রান্তিক কাঠঠোকরার মাঝামাঝি অবস্থান হলো আমাদের বাংলা-কাঠঠোকরার। এর চঞ্চু থেকে লেজের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত মাপলে ১০-১১ ইঞ্চি হয়। অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে সে কুটিকুড়ালির দ্বিগুণ আর মেটেকুড়ালির অর্ধেক। বনের বাইরে মেটেকুড়ালি ও কুটিকুড়ালি দেখার আশা অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও আপনি বাংলা-কাঠঠোকরার দেখা এ দেশের বনে, বাগানে ও লোকালয়ে সমানভাবে পাবেন। শীতকালে সহজেই দেখতে পাবেন এই পাখি তার অবিশ্বাস্য লম্বা লাল জিহ্বা দিয়ে খেজুরগাছের কাটা অংশ থেকে চেটে চেটে রস খাচ্ছে। 

মাথায় উজ্জ্বল সিঁদুরে টোপর আর পিঠে আগুন-রং পালকের জন্য বাংলা-কাঠঠোকরা আমাদের চোখে পড়েও বেশ সহজে। পিঠের এই আগুন-রং পালকের জন্যই এর চলতি ইংরেজি নাম ‘ফ্লেমব্যাক’ এবং পুরো নাম ব্ল্যাক-রাম্পড ফ্লেমব্যাক। ফ্লেমব্যাক নামে কাঠঠোকরা আছে পৃথিবীতে ১৪ আর বাংলাদেশে চার প্রজাতির। এর মধ্যে দুটি ফ্লেমব্যাক, বাংলা-কাঠঠোকরা ও বড় কাঠঠোকরা, এ দেশের লোকালয়েও আসে বলে আমজনতার পরিচিত পাখি। অন্য দুটি প্রজাতি- পাতি কাঠঠোকরা ও হিমালয়ী কাঠঠোকরা, বনে বাস করে বলে সচরাচর লোকের চোখে পড়ে না এবং দেখতে অনেকটা বাংলা-কাঠঠোকরার মতো বলে দক্ষ পাখিদর্শক ছাড়া কেউ আলাদা প্রজাতি বলে উল্লেখ করে না।

বসন্তকালে বাটালের মতো মজবুত চঞ্চু দিয়ে গাছের কাণ্ড কিংবা শাখায় কোটর কেটে সুরক্ষিত একটি বাসা বানায় বাংলা-কাঠঠোকরা। আর সব পাখির মতোই এরা এ বাসাটিকে ডিম দেওয়া ও ছানা পালনের জন্য অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করে; বসবাসের জন্য নয়। মাত্র এক মাসের মধ্যে এরা ছানা নিয়ে সদ্যগড়া সে আঁতুড়ঘরটি ছেড়ে চলে যায়। তখন দোয়েল ও শালিকের মতো পাখি এসে এই পরিত্যক্ত কোটর দখল করে। প্রজননের জন্য এদের কোটরের প্রয়োজন হলেও এরা নিজে কোটর বানাতে পারে না। কাঠঠোকরা না থাকলে এদের মতো অনেক পাখিরই বংশ রক্ষা কঠিন হয়ে যেত। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পিঁপড়া ও কীটপতঙ্গ দমন ছাড়াও কাঠঠোকরাদের আরও একটা কাজ রয়েছে; তা হলো নিরীহ পাখিদের জন্য আঁতুড়ঘর সরবরাহ করা। দুটো কাজই সারা জীবন সযত্নে করে যায় কাঠঠোকরা; মৃত্যুর এক দিন আগেও অবসরে যায় না।

টিয়াঠুঁটির রূপের বাহার

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:০৮ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:০৯ এএম
টিয়াঠুঁটির রূপের বাহার
মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফুটেছে টিয়াঠুঁটি ফুল। ছবি: লেখক

একটানা বর্ষা না হলেও হচ্ছে থেমে থেমে। মাঝে মাঝেই হচ্ছে। আর এতেই যেন হয়েছে টিয়াঠুঁটি গাছের পোয়া বারো। লকলক করে বেড়ে উঠছে। ঝোপঝাড় করে ঝাঁপিয়ে দিচ্ছে বাগানগুলো। বর্ষাকালে টিয়াঠুঁটির আলো ঝরঝর ফুলে ফুলে ভরা গাছগুলোর রূপ যেন ‘অধরা দিয়েছে ধরা ধূলির ধরণীতে’। প্রগাঢ় সবুজের মাঝে লম্বা চিকন ডাঁটির মাথায় ফোটা ফুল আর ফুলের মঞ্জরিপত্র, পুরো পুষ্পমঞ্জরিটি যেন এক আলোকবর্তিকা। 

শ্রাবণের এক দিনে মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতরে টিয়াঠুঁটির এই রূপ দেখা গেল, প্রশাসনিক ভবনের পিছনে একফালি বাগানে। ডাঁটির আগায় ফুটে আছে অসংখ্য ফুল। কিন্তু এ ফুলগুলোর চেহারা একটু অন্য রকম। মনে করার চেষ্টা করলাম, এরকম ফুল কি আর দেখেছি কোথাও? দেখেছি তো বটেই, কিন্তু সে টিয়াঠুঁটি ফুলের সঙ্গে এগুলো তো মিলছে না, পাতাও না। গত বছর গ্রীষ্মে দেখেছিলাম সাভারে ডিসি নার্সারিতে। এ বছর বর্ষায় দেখলাম ফার্মগেটে তুলা ভবনের সামনে। 

সারি করে লাগানো সেসব টিয়াঠুঁটি গাছের ফুলের রং কমলা বা উজ্জ্বল কমলা, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার উদ্যানে ফোটা টিয়াঠুঁটির ফুলগুলো হলদে আর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফোটা ফুলগুলো ঘিয়া থেকে হলুদাভ। সব টিয়াঠুঁটি গাছের পাতাই একহারা সবুজ। কিন্তু গাজীপুরের কালীগঞ্জের ফুলদি গ্রামে তাসমিয়া রিসোর্টে দেখা পেয়েছিলাম আবার অন্য আরেক রকম টিয়াঠুঁটি গাছের। সে গাছগুলোর পাতা সবুজ ও সাদাটে ছোপায় বিচিত্রিত। এ জন্য ওগুলোর নাম হয়েছে বিচিত্র টিয়াঠুঁটি বা ভেরিগেটেড প্যারাকিট ফ্লাওয়ার। 

সেখানে শুধু গাছই দেখেছিলাম, ফুল দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এবারের বৃক্ষমেলায় সে সুযোগ হয়েছিল। বিচিত্র টিয়াঠুঁটির কিছু ফুলসহ গাছের দেখা পেয়েছিলাম এবার বৃক্ষমেলায় বৃক্ষায়ন গার্ডেনিং নার্সারিতে। ফুলগুলোর রঙ ছিল প্রায় সাদা। এসব দেখে মনে হলো, টিয়াঠুঁটির এত রূপের বাহার হয়েছে তার একাধিক জাত-বৈচিত্র্যের কারণে। ঠিক কতগুলো জাত আমাদের দেশে আছে তার কোনো তথ্য নেই। কোন জাতের কি নাম, তাও জানা নেই। টিয়াঠুঁটির ইংরেজি নাম প্যারাকিট ফ্লাওয়ার বা প্যারটস ফ্লাওয়ার। 

টিয়াঠুঁটি গাছ হেলিকোনিয়েসি গোত্রের হেলিকোনিয়া গণের একটি গাছ। বার্ড অব প্যারাডাইস বা স্বর্গের বুলবুলিও এ গণের একটি গাছ, যা সচরাচর দেখা যায় না। এ দেশে হেলিকোনিয়া গণের সাতটি প্রজাতির গাছ আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় Heliconia psittacornum I Heliconia rostrata প্রজাতির গাছ। টিয়াঠুঁটি প্রথমোক্ত গণের গাছ। দ্বিতীয় প্রজাতির গাছকে বাংলায় বলে চিংড়িনমি ফুল, ইংরেজি নাম হ্যাঙ্গিং লবস্টার ক্ল। ফুলের অদ্ভুত গড়নের জন্য এটিও বাহারি গাছ হিসেবে এখন বাগানে লাগানো হচ্ছে।

টিয়াঠুঁটি গাছ বর্ষজীবী বিরুৎ স্বভাবের, এক বছরের বেশি বাঁচে না। গাছের গোড়ায় মাটির নিচে কন্দ থাকে, সেখান থেকে গাছ জন্মে। গাছ প্রায় এক থেকে দেড় মিটার লম্বা হয়, জাতভেদে খাটো গাছও দেখা যায়। পাতা সরল ও দেখতে অনেকটা কলাপাতার মতো। তবে কলাপাতার চেয়ে শক্ত ও ছোট। কলাপাতার মতো এ পাতার বোঁটার সঙ্গে একটি পত্রখোল থাকে। 

পাতা মসৃণ ও চকচকে। একটি গাছ থেকে একটি শক্ত নলের মতো পুষ্পদণ্ডের মাথায় বৃশ্চিকাকার বা বিছার মতো মঞ্জরিতে ফুল ফোটে। ফুলের বৃতি বা মঞ্জরিপত্র দেখতে অনেকটা নৌকার খোলের মতো, ঠিক কলার মোচায় যে রকম খোল থাকে, সে রকম। খোলের মধ্য থেকে ৬টি লম্বা কাঠির মতো ফুল বেরিয়ে আসে। খোল বা মঞ্জরিপত্র একটির পর আর একটি প্রায় ২ সেন্টিমিটার ব্যবধানে বিপরীতমুখীভাবে থাকে। প্রতিটি ফুলে থাকে ৫টি পুরুষ কেশর ও একটি স্ত্রী কেশর। ফুলে পরাগায়নের পর ফল হয়। 

বসন্তকাল থেকে শুরু করে বর্ষাকাল পর্যন্ত ফুল ফুটতে থাকে। কিছু কিছু জাতের গাছে প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। সিলেটের জঙ্গলে দেখেছি এ গণের গাছকে বন্যভাবে জন্মাতে। তবে অধিকাংশ সময়ে এসব গাছ টবে ও বাগানে লাগানো হয় শোভাবর্ধক হিসেবে। বর্ষার প্রকৃতিতে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে টিয়াঠুঁটিও তার রূপের বাহার ছড়িয়ে দেয়। ছায়া ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় এ গাছ ভালো জন্মে। 

আদি নিবাস ব্রাজিলের বাদল বন। বিশেষ করে আমাজনের উত্তরাংশ থেকে এ গাছ এখন পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থায়িত্বকাল বেশি হওয়ায় এখন ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার ফুল হিসেবে টিয়াঠুঁটির কদর বাড়ছে। কাটা ফুল ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত ফুলদানিতে সতেজ থাকে। গোড়ার মোথা কেটে ভাগ করে মাটিতে পুঁতে দিলে সহজেই তা থেকে এর গাছ জন্মে। গাছ বেশ কষ্ট সইতে পারে।

দেশি নীল রবিন

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৯ পিএম
আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৫২ পিএম
দেশি নীল রবিন
ছবি: লেখক

খুব ভোরে পাখি দেখতে বেরিয়েছি ঢাকার জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। এক পুকুরের ধারে জারুল বনের এক পাশে থাকা শীতলপাটি গাছের ঝোপে এ পাখি অনিয়মতিভাবে আসে। কোনো বছর দেখা যায়, আবার কোনো বছর দেখা যায় না। হিমালয়সহ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট পাখি নীল রবিন। মেয়েপাখির রং শুকনো পাতার মতো হালকা বাদামি। তাই সহজে চোখে পড়ে না।

সেদিন দেখা গেল, মেয়েপাখিটি খুব সাবধানে শীতলপাটির ঝোপ থেকে বের হয়ে শুকনো জারুল পাতা উল্টিয়ে খুঁটে খুঁটে পোকা খাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পাখিটি দেখলাম। সে ঝোপের আড়ালেই বেশি থাকতে ভালোবাসে। সেদিন ছেলেপাখির দেখা পাইনি।

দেশি নীল রবিন আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে বছরে দুবার। কখনো কখনো এরা বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি করে। যাত্রাবিরতির সময় এরা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে আশ্রয় নেয়। থাকে সপ্তাহখানেক।

অন্য একদিন জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গিয়েছি। পিচঢালা পথের ওপর পড়ে থাকা একটি পাইপের ওপর বসা পুরুষ নীল রবিন দেখতে পাই। তার ছবি তুলে নিই কয়েকটা। ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে উড়ে এসে সবে বসেছে। খানিক বাদেই সে চলে গেল ফুলবাগানে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তার শিকার ধরার কৌশল ও চালচলন পর্যবেক্ষণ করলাম। 

প্রায়ই সে পানি জমে থাকা জায়গাতে আসে পোকা ধরতে। ফুলের টবেও যায়। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই ব্যস লাফিয়ে অথবা উড়ে গিয়ে ঝোপ বা পাতার আড়ালে চুপ করে বসে থাকে। নড়াচড়া করে না একটুও। পোকা ধরা এবং হাঁটার সময় লেজ নাড়ায় ঘন ঘন। দুই ডানা ঝাপটায়। যার ফলে ডানার নীল রং আরও ভালোভাবে দেখা যায়। এই দৃশ্য খুবই উপভোগ্য।

নীল রবিন সাধারণত মিশ্র ও পাতাঝরা বনের তলে, ফুলবাগানে ও চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে ভূমিতে শেওলা, শুকনো ঘাস, লাইকেন, পশম ও পালক দিয়ে বাটির মতো বাসা বানায়। ডিম পাড়ে। ডিম দেখতে নীল। সংখ্যায় তিন থেকে পাঁচটি। ছেলেপাখির পিঠের দিক নীল, নিচের দিকে কমলা, ভ্রূরেখা সাদা। কানঢাকনি কালো। গলা ও বুক উজ্জ্বল তামাটে। মেয়েপাখির পিঠ জলপাই বাদামি। গলা সাদা, দেহতল পীতাভ। নেপাল, মায়ানমার ও হিমালয়ে এরা বাসা করে জুলাই মাসের দিকে। ছানারা উড়তে শিখলে আবার পরিযায়ী হয়। এ পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Larvivora brunnea; ইংরেজি নাম Indian blue Robin।

হারিয়ে যাচ্ছে চালমুগরা

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৪ পিএম
আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৯ পিএম
হারিয়ে যাচ্ছে চালমুগরা
মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে চালমুগরা গাছে ফল ধরেছে। ছবি: লেখক

প্রচণ্ড খরতাপে যখন গায়ে জ্বালা ধরে, তখন ইচ্ছে করে জাদুমন্ত্রে বৃষ্টি নামিয়ে দিই, না পারলে কোনো গাছের ছায়ায় ছুটে যাই। দাহদিনে শান্তির এক পরম জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম কমলগঞ্জে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে। বনের পথে গাছের ঘন ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, এ যেন অন্য দেশ, অন্য কোথাও। এমন হিমেল পরশ পাব কোথায়?

উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের পাশে নানা রকমের গাছগাছড়া দেখতে দেখতে একসময় হাজির হলাম লাউয়াছড়া ফরেস্ট অফিসের রেস্ট হাউসে। তার সামনে এক বিশাল চালমুগরাগাছ। অনেক উঁচুতে কচি ফল ধরে আছে। জানা গেল, গাছটা সিলেটের অরণ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায়। আছে কক্সবাজারেও। গাছটি অনেক ভেষজ গুণে গুণান্বিত। কী সে গুণ, তা আর জানা হলো না। ছবিও তোলা হলো না। ফিরে এলাম ঢাকায়। তবে ফিরে আসার আগে জেনে এলাম, সিলেটের লোকেরা এ গাছকে বলে ডালমুগরা।

পয়লা শ্রাবণে ছুটে গেলাম মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের এ রকম জনমানবহীন দৃশ্য এর আগে আর কখনো চোখে পড়েনি। একটা সেকশনের মধ্যে নামফলকে চালমুগরা গাছের নামটা দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ি। একটু খুঁজতেই পেয়ে যাই গাছটা। মাঝারি আকারের বৃক্ষ, প্রায় দশ-বারো মিটার লম্বা, কাণ্ড সোজা—সরল ও গোলাকার। গাছে দোলানো ঝোলানো ডালপালা। ডালের দুই পাশে সাজানো চকচকে সবুজ লম্বা লম্বা আয়তাকার পাতা, পাতার কিনারা সমান, তবে সামান্য ঢেউখেলানো, অগ্রপ্রান্ত সুচালো, শাখার দুই পাশে পাতাগুলো বিপরীতভাবে সজ্জিত, একেবারে আগায় বা শীর্ষে একটি পাতা, শিরা স্পষ্ট দেখা যায়। শাখায় শাখায় দুলছে গোল গোল বলের মতো নস্যি রঙের ফল। কোনো ডালে কোনো ফুল নেই, ফুল ফোটা শেষ হয়ে গেছে আরও আগেই। গ্রীষ্ম-বর্ষা ফুল ফোটার সময়। ফুলের রং হালকা হলুদ, কখনো একক আবার কখনো কয়েকটা ফুল থোকায় ফোটে, ফুলে ঘ্রাণ আছে। 

ফল পাকবে আরও পরে, সাধারণত হেমন্তের দিকে পরিপক্ব হয়। ফল সুগোল, শক্ত কাঠের মতো পুরু খোসা, বাদামি। ভেতরে ভুট্টার দানার মতো কয়েকটা বীজ থাকে। পরিপক্ব হলে সেসব ফল সংগ্রহ করে বীজ বের করা হয়। বীজ পিষে তেল বের করা হয়। চালমুগরা তেল অত্যন্ত ঔষধি গুণসম্পন্ন। এ গাছের আর কোনো অংশকে ঔষধার্থে ব্যবহারের পরামর্শ প্রাচীন বৈদ্যরা দেননি। চক্রপাণি দত্ত তার প্রণীত ‘চক্রদত্ত সংগ্রহ’ গ্রন্থে অর্শরোগে চালমুগরার তেল পান করার উপদেশ দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এও বলা হয়েছে যে, যেভাবে তিল থেকে তেল বের করা হয়, সেভাবে চালমুগরার বীজও পিষে নিলে তেল পাওয়া যায়। চালমুগরার তেল বিভিন্ন চর্মরোগ, বাত ও দেহের কোনো স্থানে থেঁতলে গেলে সেখানে মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়। 

তেল মালিশ করলে চুলকানি থাকলে তাও সেরে যায়। এমনকি মাথার খুশকি দূর করতে চালমুগরার তেল মাথায় মাখা হয়। অতীতে কুষ্ঠরোগ হলে রোগীকে একঘরে করে রাখা হতো। তাকে ঘৃণার চোখে দেখত সমাজ। এমনকি কুষ্ঠরোগীকে সে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতো। কিন্তু সে যাবে কোথায়? শেষে গ্রামীণ বৈদ্যরাই তাকে চালমুগরার তেল ব্যবহারের নিদান দিতেন। বলতেন, কুষ্ঠরোগের প্রাথমিক অবস্থায় চালমুগরার তেল গরম করে তাতে সামান্য মৌ-মোম মিশিয়ে মলমের মতো করে লাগালে ও চালমুগরার তেল ১০ ফোঁটা মাত্রায় দুই বেলা খেলে কুষ্ঠরোগের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এ উপদেশ দিয়েছেন আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তার ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ বইয়ের পঞ্চম খণ্ডে। 

চালমুগরার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Hydnocarpus kurzii ও গোত্র Flacourtiaceae। এ গাছ চিরসবুজ প্রকৃতির, অর্থাৎ শীতে এর পাতা ঝরে না। কাঠ খুব শক্ত, কাঠের ভেতরের রং সাদা, বাইরের রং হলদে, বাকল ধূসর। গাছের আদি নিবাস ভারতবর্ষ ও মায়ানমার। সে অর্থে গাছটি আমাদের দেশি। তবে চালমুগরাগাছ সমতলের চেয়ে ত্রিপুরা, খাসিয়া পাহাড় বা সিলেট অঞ্চল, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা, কক্সবাজারের অরণ্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, ইয়াঙ্গুন প্রভৃতি এলাকায় ভালো জন্মে।

চালমুগরাগাছ এত ঔষধি গুণের হলেও তার ব্যবহার সেভাবে এখন আর হয় না। অকম্মা গাছের খাতায় চলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বন থেকেও সে হারিয়ে যাচ্ছে। এ গাছকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এর প্রকৃত আবাসস্থলে চারা লাগাতে হবে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সমতলে না লাগিয়ে পাহাড়ের মধ্যদেশ থেকে পাদদেশ পর্যন্ত চালমুগরাগাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে।

‘বাঘ বিধবা’ সোনামণির কষ্টকাহিনি

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৪, ১০:২০ এএম
আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৪, ১০:২০ এএম
‘বাঘ বিধবা’ সোনামণির কষ্টকাহিনি
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের সোনামণির দিন কাটে একাকিত্বে আর সংকটে। ছবি: খবরের কাগজ

সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার আলোচিত এক মুখ সোনামণি। যার দুই স্বামীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাঘের আক্রমণে দুই স্বামী নিহত হওয়ার পর থেকে ‘অপয়া’, ‘অলক্ষ্মী’, ‘স্বামীখেকো’ অপবাদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে সোনামণিকে। কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেও তাকে খেতে দেওয়া হয় সবার শেষে।

বর্তমানে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ বাজারের পেছনে জেলেপাড়ায় বসবাস তার। দুই স্বামীর সংসারে চার সন্তান থাকলেও সোনামণির দেখভাল করেন না তাদের কেউই। বলতে গেলে একাকী জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই কোনো সমাধান। 

বাঘ বিধবা সোনামণির বাবার বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। ছোটবেলা থেকে বাবার অভাবের সংসারে বড় একটা বোঝা ছিলেন তিনি। এ জন্য বেশি দিন বাবার ঘরে থাকতে পারেননি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন নিজ বংশীয় এক জেলের সঙ্গে।

ভালো ছেলে হওয়ায় পাত্রকে হাতছাড়া করেননি সোনামণির বাবা। বর শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ গ্রামের জেলেপাড়ার তরুণ রাধাকান্ত সরদার। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম নেয় এক ছেলে। সোনামণি ও তার স্বামীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বেশ ভালোই চলছিল তাদের জীবন ও সংসার। 

সন্তানের বয়স যখন এক মাস, তখন (১৯৯৯ সাল) স্বামী রাধাকান্ত সরদার বন বিভাগ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। সেখানে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারাতে হয় তাকে। বাঘের কবল থেকে রাধাকান্তের লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাননি তার সঙ্গীরা। মর্মান্তিক এই ঘটনায় আকাশ ভেঙে পড়ে সোনামণির মাথায়। তছনছ হয়ে যায় সুখের সংসার। মাত্র এক মাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে বিধবা এই নারীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন তার শাশুড়ি। সমাজের লোকজন সোনামণিকে ‘অপয়া’ বলে আখ্যা দেন। যেন তার অপরাধের(!) কারণেই স্বামীকে বাঘে খেয়েছে।

কষ্টেসৃষ্টে দিন যেতে থাকে হতভাগিনী সোনামণির। কীভাবে সংসার চলবে? এই সংকটের কী সমাধান? সে সময় স্বামীহারা একজন নারীকে সমাজে অবহেলার চোখে দেখা হতো। অভাবী বাবার সংসারেও জায়গা হয়নি তার। সমাজ তাকে ‘অপয়া’ বলে ধিক্কার দিতে থাকে। একপর্যায়ে প্রতিবেশীরা সোনামণির এক মাস বয়সী শিশুসন্তানের কথা ভেবে তার অবিবাহিত দেবর ভুবেন সরদারের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এ সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জম্ম হয়। এতে সোনামণির দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়। পেছনের কালো শোকার্ত অধ্যায় মুছে ফেলে নতুনভাবে সংসার শুরু করেন। 

২০০৩ সালে ভুবেন সরদার বন বিভাগ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। কিন্তু আর ফিরে আসেননি। মন্দ কপাল আর কাকে বলে! প্রথম স্বামীর মতো দ্বিতীয় স্বামীও বাঘের শিকার হন। খুঁজে পাওয়া যায়নি স্বামী ভুবেনের লাশও। 

দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর সোনামণিকে স্থানীয় লোকজন ‘অলক্ষ্মী’ ও ‘স্বামীখেকো’ আখ্যা দিয়ে সমাজ থেকে আলাদা করে দেন। শাশুড়ি তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অকল্যাণ এড়াতে এই ‘অলক্ষ্মী’র মুখ দেখতে না হয়। 

সোনামণি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। সে কারণে কোলের এক মাস বয়সী বাচ্চাসহ শাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেন। তখন আমাকে বাচ্চা নিয়ে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। পরে দেবর আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ সালে বাঘে ধরে তাকেও।’

সোনামণি আরও বলেন, “আমার এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামীরা গেল বাঘের পেটে, সেই সঙ্গে আমাকেও মেরে রেখে গেল। আমার মতো সব ‘বাঘ বিধবা’ নারীর জীবন চলছে অপমানে অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে।” 

স্বামী হারানোর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের সঙ্গে তাদের জীবনে যোগ হয়েছে সামাজিক নির্যাতন ও নিগ্রহ। পরিচিতি জুটেছে ‘অপয়া, ‘অলক্ষ্মী’ ও ‘স্বামীখেকো’ হিসেবে। স্ত্রীর মন্দভাগ্য স্বামীদের বাঘের মুখে ফেলেছে বলে মনে করে এই সমাজ। এই দায় মাথায় নিয়ে বহু ‘বাঘ বিধবা’ অসহায় নারী বাধ্য হন স্বামীর ঘর ছাড়তে। কিন্তু তার পরও বেঁচে থাকতে হয়। সন্তান লালন-পালন করতে হয়। রোজগারের জন্য যুদ্ধ না করে উপায়ই বা কী?। এমন হাজারও সংকটে বিপন্ন অভাগিনী ‘বাঘ বিধবা’রা। তাদের ভাঙাপোড়া জীবনে বিবর্ণ অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু নেই।