রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফুল অসম্ভব ভালোবাসতেন। দেশ-বিদেশের যেখানেই যেতেন, সেখান থেকে অপরিচিত গাছ এনে লাগাতেন শান্তিনিকেতনে। অনেক বিদেশি ফুলের তিনি মিষ্টিমধুর বাংলা নামও দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যামেলিয়া ফুলের কোনো বাংলা নাম দেননি। ক্যামেলিয়া আসলে এ দেশের ফুল না, এমনকি ভারতবর্ষেরও না।
এই ফুলগাছের আদি নিবাস চা-গাছের মতোই চীনদেশে, জাপানে না। চীনদেশেই এগারো শতকে প্রথম ক্যামেলিয়ার চাষ শুরু হয়। দার্জিলিংয়ের মংপুতে গৌরী দেবীর বাড়িতে প্রথম দেখাতেই ক্যামেলিয়া ফুলের রূপে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়েছিলেন। উজ্জ্বল চকচকে গাঢ় সবুজ পাতাওয়ালা ঝোপ ঝোপ গাছে গোলাপের মতো লাল রঙের ফুটে থাকা ফুলগুলোর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ঢাকায় বলধা গার্ডেনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বলধা গার্ডেনে রয়েছে খাঁচার মতো ঘেরা দেওয়া লাল ও সাদা ফুলের অনেক প্রাচীন ক্যামেলিয়াগাছের একটি ছোট্ট বাগান, যাকে বলা হয় ক্যামেলিয়া হাউস। সেখানেও অনেক ফুলের ভিড়ে ক্যামেলিয়া কবিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২৭ শ্রাবণ তার বিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি লেখেন। চিত্রকল্পময় দীর্ঘ সেই কবিতাটিতে উঠে এসেছে এক সাঁওতাল মেয়ের সাজসজ্জায় ক্যামেলিয়া ফুল, সে এক অদ্ভুত রোমান্টিকতা! বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, ‘বাবু, ডেকেছিস কেনে?’/ বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া/ সাঁওতাল মেয়ের কানে,/ কালো গালের উপর আলো করেছে।/ সে আবার জিজ্ঞেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে।’/ আমি বললেম, ‘এইজন্যেই।’ পরবর্তীকালে ক্যামেলিয়া কবিতাটির ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সজল সমাদ্দার। ইংরেজ কবি শার্লট এলিজাবেথ টোনা ১৮৩৪ সালে ক্যামেলিয়া ফুলকে নিয়ে ‘দ্য হোয়াইট ক্যামেলিয়া জাপোনিকা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। জাপানে ক্যামেলিয়া ফুল জনপ্রিয়। এ ফুলের ছবি দিয়ে সে দেশে ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়েছে।
সেই ক্যামেলিয়া ফুল আমি প্রায় দশ বছর আগে দেখি বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশের ক্যামেলিয়া হাউসে। বহুদিন পর আবার সেই ক্যামেলিয়ার দেখা পেলাম ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের নার্সারিতে। গাছ আলো করে শীতের দিনে সুন্দরের ওম ছড়াচ্ছে লাল রঙের ক্যামেলিয়া ফুলগুলো। দেখতে গোলাপের মতো আর পাতা দেখতে চা-গাছের পাতার মতো। চা-গাছ ও ক্যামেলিয়াগাছ দুই সহোদরা, একই থিয়েসী পরিবারের, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Camellia japonica. এই গাছ ছোট বৃক্ষ বা গুল্ম-প্রকৃতির। গাছ ২ থেকে ৬ মিটার লম্বা হয়। পাতা মসৃণ, চকচকে ও গাঢ় সবুজ, নিচের পিঠ হালকা সবুজ, পাতার অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ, পাতার কিনারা খুব সূক্ষ্মভাবে খাঁজ কাটা।
ডালে পাতার কোল থেকে সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় কুঁড়ি বের হয় বা ফুল ফোটে। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ফুল ফোটে। ফুলের পাপড়ির রং নির্ভর করে জাতের ওপর। ফুলের মাঝখানে তিন খাঁজবিশিষ্ট একটি গর্ভমুণ্ডসহ স্ত্রীকেশর থাকে ও তার চারপাশে সুতার মতো অসংখ্য পুরুষকেশর থাকে। পাখি ও প্রজাপতিরা পরাগায়ন ঘটায়। পরাগায়নের পর ফল হয়। ফল গ্লোবাকৃতি, ফলের ভেতরে দুটি বাদামি রঙের বীজ থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফল পাকে। বীজ থেকে চারা হয়। বিশ্বে ক্যামেলিয়ার শত শত জাত রয়েছে। আমাদের দেশে লাল, গোলাপি ও সাদা রঙের ফুলের ক্যামেলিয়ার তিনটি জাত চোখে পড়ে। ছায়াঘরের ভেতরে ক্যামেলিয়ার চাষ ভালো হয়।