এদেশের জলাশয়ে শীতকালে আজও আসে ঠেঙ্গি পাখিরা। এককালে আরও বেশি আসত। সেকালে গাঁয়ের শিশুরাও এ পাখি চিনত। তারা বলত, ‘ঠেঙ্গি এসেছে, কার্তিক পুজো হবে।’ বুনোহাঁস ছাড়া আর কোনো পরিযায়ী পাখির খবর তারা রাখত না। কিন্তু আদুরে চেহারা আর লম্বা লাল ঠ্যাংয়ের জন্য ‘ঠেঙ্গি’ পাখি ছিল সুপরিচিত।
সরল ও সংক্ষিপ্ত ‘ঠেঙ্গি’ নামই বলে দেয় এ পাখি কতটা পরিচিত ছিল এদেশে। শীতে বিল-বাদাড়ে অস্থায়ী নিবাস গড়তে আসা পাখিদের বাংলা নাম দেওয়ার আগ্রহ কমই দেখা গেছে বাংলাদেশে। ঠেঙ্গির বেলায় তার ব্যতিক্রম হয়েছে; ‘ঠেঙ্গি’ ছাড়াও এর একাধিক নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন লালঠেঙ্গি, লালঠ্যাঙ্গা ও লালড্যাঙ্গা।
পৃথিবীতে একাধিক প্রজাতির ঠেঙ্গি আছে বলে আমাদের দেশে শীতের এই আগন্তুকের পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘কালাপাখ-ঠেঙ্গি’। এর ইংরেজি নাম ‘ব্ল্যাক-উইংড স্টিল্ট’। শুধু এই একটি প্রজাতির ঠেঙ্গিই রয়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এই তিন মহাদেশজুড়ে।
আমাদের ঠেঙ্গি শুধু শীতেই এদেশে বাস করে। গ্রীষ্মে এরা বাংলাদেশ ছেড়ে উত্তরে উড়ে তুন্দ্রা অঞ্চলে গিয়ে দলবেঁধে মাটিতে ডিম দেয়। ডিম থেকে বেরিয়েই তুলোর বলের মতো ছানাগুলো লম্বা লম্বা পায়ে খানাখন্দে হেঁটে পোকা খুটে খায়। গ্রীষ্ম শেষ হলে ছানাপোনাসহ সবাই আবার দক্ষিণে উড়ে আসে।
আমাদের এই ঠেঙ্গি ছাড়া পৃথিবীতে আর আছে মাত্র পাঁচ প্রজাতির ঠেঙ্গি। এর মধ্যে দুটো আমেরিকায় এবং দুটো অস্ট্রেলিয়ায়। পঞ্চমটি আছে শুধুমাত্র নিউজিল্যান্ডে; যার নাম ‘কালা-ঠেঙ্গি’। কালা-ঠেঙ্গি ‘আছে’ বললে বেশি বলা হয়; কারণ সর্বসাকুল্যে ১৬০টি পাখি টিকে আছে; ওরা দাঁড়িয়ে আছে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
নিউজিল্যান্ডের কালা-ঠেঙ্গির তুলনায় বাংলাদেশে অবশ্য অনেক বেশি আছে কালাপাখি-ঠেঙ্গি। আগে আরও বেশি ছিল। সেকালের ফরিদপুর আর বরিশাল জেলায় চান্দার বিল ও আসকর বিলের মতো বিস্তীর্ণ জলাশয়ে শীতে অনেক পরিযায়ী পাখি নামত। সেখানে অনেক ঠেঙ্গির দেখা মিলত।
জোড়া জোড়া লাল চপস্টিকের মতো লম্বা ঠ্যাং লেজের বাইরে রেখে ঝাঁক বেঁধে ওরা উড়ে আসত এবং বিনাবাক্যে নেমে যেত বিলের কাদাপানিতে। বিলের সদ্য-জাগা তীরে কাদা মেখে শুয়ে থাকত পদ্ম ও শাপলার পাতা আর ডগা। সেখানে কাঠির মতো সরু পা চালিয়ে হেঁটে যেত ঠেঙ্গির সারি। মাঝে মাঝে মাথা নামিয়ে সুচের মতো চোখা চঞ্চুর খোঁচায় তুলে আনত কাদায় কিলবিল করা ব্যাঙাচি আর কাঁকড়া-ছানা।
মাছের দিকে নজর দেয় না বলেই ঠেঙ্গির সঙ্গে বিবাদ ছিল না বক, পানকৌড়ি, মাছমুরাল, কুরাঈগল ইত্যাদি মাছশিকারি পাখির। দেহে দুই শ গ্রামের বেশি মাংস নেই বলে পাখি শিকারির কাছেও ঠেঙ্গিরা আকর্ষণীয় ছিল না। তাই বিল-বাদাড়ে ঠেঙ্গির পদচারণা ছিল আর সব পাখির চেয়ে অনেক নির্ভীক।
আমরা আজও বাইক্কা, চটাইন্যা, চরুইল ইত্যাদি বিলে ও উপকূলের চরাঞ্চলে ঠেঙ্গি দেখতে পাই। তবে এখন এ পাখি আমাদের থেকে বেশ দূরে দূরে থাকে। ব্যালে নর্তকীর মতো এর অসাধারণ দুটো পা, মসৃণ পালকের সুকুমার সাদাকালো দেহ ও বড় বড় চোখের কৌতূহলী দৃষ্টি মন ভরে দেখতে হলে এখন লুকিয়ে চুকিয়ে থাকতে হয়।
কে জানে কেন এ পাখি ইদানীং এত ভীতু হয়ে গেছে! সম্ভবত এদেশে এরা আর সেই আগের মতো শান্তি স্বস্তিতে নেই। পাখির আকাল বলে শিকারিরা আজকাল বাছবিচার না করে সব পাখির দিকেই দৃষ্টি দিচ্ছেন। তা ছাড়া অনেক শিকারি এখন বিষ দিয়ে পাখি মারেন বলে ছোট-বড়, ধলা-কালা, গায়ক-নর্তক সবাই সমানভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
বিপদ আরও আছে। সরাসরি বিষ দিয়ে যত পাখি মারা হয়, তার চেয়েও বেশি পাখি মারা পড়ে বিষে আক্রান্ত পোকা-মাকড় খেয়ে। আমাদের ফসলের খেত ও ফলবাগানে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার যেভাবে বেড়েছে, তাতে ঠেঙ্গির মতো পোকা-মাকড়খেকো অনেক পাখিরই এই ছোট্ট দেশটিতে এখন আর সুস্থ থাকার জো নেই।