বাংলায় অনেক প্রজাতির বুনোহাঁসের দেখা মেলে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে দেশের বড় নদ-নদীর জলে, নদীর মোহনায়, হ্রদে, উপকূলীয় এলাকা এবং বৃহত্তর হাওর এলাকায়। এসব বুনোহাঁসের বেশির ভাগই পরিযায়ী। শীতের সময়ে জলচর পাখিশুমারি করতে দেশের নানান প্রান্তে গিয়েছি। সবচেয়ে বেশি গিয়েছি মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে।
হাকালুকি হাওরে অনেক বড় ও মাঝারি বিল রয়েছে। পরিযায়ী বুনোহাঁসেরা বিলের জলে পুরো শীত কাটায়। বিলের জলজ আগাছা খায়। সাঁতরিয়ে বিলের এ-প্রান্তর থেকে ও-প্রান্তরে ছুটে বেড়ায়, জলকেলি করে দলে দলে। কখনো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় এক বিল থেকে অন্য বিল অথবা অন্য কোনো হাওরে। শীতের সময়ে হাওরে পাখি দেখতে ও পাখি গুনতে ভীষণ ভালো লাগে। কাজটি করে আমরা আনন্দ পাই এবং পাখিশুমারির মাধ্যমে জলচর পাখির অবস্থা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিই।
বাংলাদেশের স্বাদু ও নোনা জলের জলাশয়ে দুই ডজনের বেশি বুনোহাঁসের প্রজাতির দেখা মেলে। যেমন- খয়রাচখা, উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, টিকি হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, রাজ শরালি, পাতি শরালি, খুন্তেহাঁস ইত্যাদি। এদের মধ্যে সুন্দর একটি হাঁস হলো নীলশির। পুরুষ হাঁসটির মাথায় নীলচে সবুজ পালক থাকায় একে নীলমাথা হাঁসও বলা হয়ে থাকে। নীলমাথা হাঁস বাংলাদেশে পরিযায়ী হাঁস। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে ভিন্ন। এরা বাংলাদেশে প্রজনন করে না। যে কারণে এদের ছানাদের আমরা দেখতে পাই না।
জার্মানিতে পাখি দেখতে মাঝে মাঝে বের হই। সাধারণত পার্কে, ঘাসের বনে, হ্রদে এবং নদীর তীরেই পাখি দেখতে যাওয়া হয়। জার্মানির প্রতিটি শহরে জলাশয়ের কাছে যে পাখিগুলোর প্রজাতি বেশি চোখে পড়ে, তার মধ্যে নীলশির অন্যতম। বাংলাদেশে নীলশির পরিযায়ী হয়ে যায়। একটি নীলশির হাঁস দেখতে বাংলাদেশে আমাদের কতই না কষ্ট করতে হতো। বিশেষ করে শীতের সময় পরিযায়ী পাখিশুমারির সময় হাকালুকি হাওরে হাজার হাজার বুনোহাঁসের মধ্যে একটি নীলশির দেখতে পেতাম। আমাদের দীর্ঘদিনের পাখিশুমারির সঙ্গী ও পাখি পর্যবেক্ষক পল থমসন হাকালুকি হাওরে নীলশির হাঁস বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজে বের করতেন। তার সঙ্গে হাওরে পাখিশুমারি করতে গিয়ে এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
ইউরোপে নীলশির আমাদের পায়ের কাছে ঘুরে বেড়ায়। ঘর থেকে একটু বের হলেই নীলশির দেখা যায়। প্রায়ই এক জোড়া নীলশির আমার বাসার কাছে উড়ে আসে। গত গ্রীষ্মে জার্মানির হ্যানোভার শহরের একটি হ্রদে গিয়েছিলাম জলচর পাখি দেখতে। খুব বড় হ্রদ। চারপাশে সবুজ। তবে পরিবেশবান্ধব বোটিং ও সাঁতার কাটার জন্য হ্রদটি উন্মুক্ত। সেই হ্রদের কাছে গিয়ে প্রথম দেখা পাই কয়েকটি ছোট্ট ছানাসহ একটি নীলশির। কয়েক ডজন মিউট সোয়ান এবং পাতিকুটও ছিল। পাতিকুটের ছানাগুলো তখনো বাসা ছাড়েনি। নীলশিরের ছানাগুলো বাসা ছেড়েছে।
দেখলাম নীলশিরের ছানাগুলো মায়ের সঙ্গে সাঁতার কাটে ও জলজ আগাছা খায়। সাঁতরে সামান্য দূরে যেতেও ভয় পায় ছানারা। মানুষ খুব কাছাকাছি চলে এলে ছানারা হ্রদের কিনারে আবডালে লুকিয়ে পড়ে। তবে ধীরে ধীরে একদিন ওদের ভয় কেটে যাবে। একদিন ওরাও হয়তো পরিযায়ী হয়ে আমাদের হাকালুকি হাওরে যাবে।
লেখক: পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার
[email protected]