প্রথমে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম ফুলদি গ্রামে একটি ডোবায় কয়েকটি দল-পিপি পাখি দেখে। কিন্তু পরে সে আনন্দ কিছুটা মলিন হয়ে গেল। বহু বছর পর গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার এই নিভৃত গ্রামে এসেছি। উঁচু উঁচু টিলার মাঝে জলাবদ্ধ জমিনে এতগুলো দল-পিপি দেখে খুশিই হতাম, যদি পাখিগুলো কোথাও দুদণ্ড নির্বিঘ্নে বসতে পারত।
দল-পিপিরা বারবার উড়ে ডোবার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে বসছে। বসতে না বসতেই আবার উড়াল দিয়ে সেখান থেকে তাদের পালাতে হচ্ছে। তার কারণ চারদিকেই লোকজন যাতায়াত করছে। মানুষ থেকে দূরে থাকার তাগিদেই ওরা এত ওড়াউড়ি করছে। আসলে এ পাখি সারা জীবনই হেঁটে বেড়ায়; উড়তে চায় না সহজে।
মাত্র দুই দশক আগেও এখানে জনবসতি বেশি ছিল না। ছিল অনেক পাখি। পাখি এখনো কিছু আছে; কিন্তু শান্তিতে আর নেই। এখানে নতুন নতুন বসতবাড়ি আর খেতখামার হচ্ছে। উঁচু-নিচু জমিন সমান করে বাড়িঘর গড়ছে লোকে; ঝোপঝাড় কেটে কিংবা পুড়িয়ে সবজি বাগান বানাচ্ছে। বাদার পানি পাম্প করে ফেলে দিয়ে চলছে ইরি চাষ।
হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা, কলমি ও দলপানায় ভরা ডোবাগুলো। এই অবহেলিত ডোবাই ছিল দল-পিপি, ডাহুক ও রাঙ্গাচ্যাগা পাখির পৈতৃক নিবাস। ঠিকানা হারানো দল-পিপিরা তো তবু এখানে ওড়াউড়ি করে প্রাণ রক্ষা করছে; রাঙ্গাচ্যাগা ও ডাহুক মোটেও আছে কি না, তা জানিনে। জানি না দল-পিপিইবা এভাবে আর কতদিন টিকে থাকবে!
এখানে দল-পিপির দলে চারটি বাড়ন্ত ছানাও দেখলাম। মানুষ দেখে ছানাগুলো ওড়াউড়ি না করে ঘাসের ভেতর লুকিয়ে পড়ছে। ছানাগুলো দেখে মনে হয়, এখানে এই পাখির প্রজননের স্থানগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়নি এবং ছানাখেকো জীবেরও বাড়বাড়ন্ত হয়নি এখনো। খয়েরি রঙের ছানাগুলো আকারে সাবালক পাখির প্রায় সমান হয়ে গেছে।
দল-পিপি ছানার জীবনে বিপদের শেষ নেই। ওদের জীবন অন্য পাখির ছানার মতো শুরু হয় না নিরাপদ নীড়ে, মা-বাবার উষ্ণ পালকের তলে। ডিম থেকে বেরিয়েই জলজ উদ্ভিদের ওপর হেঁটে হেঁটে ওদের খাবার খুঁজে খেতে হয়। শত্রু কাছে এলে তীক্ষ্ণকণ্ঠে ডাক দিয়ে ছানাকে সতর্ক করে বাবা-পাখি। ওইটুকু সাহায্য নিয়েই ছানাগুলো সাপ, গুইসাপ, বিড়াল, বাজ ও চিলের কবল থেকে দৌড়ে প্রাণ রক্ষা করে। তা না পারলে সেটাই হয় তাদের জীবনের অন্তিম দিন।
দল-পিপি ছানার সঙ্গে মা-পাখির সম্পর্কটা মোটেই গভীর নয়। ডোবার পানিতে ভেসে থাকা পাতার বাসায় চারটি ডিম দিয়ে মা-পাখি বিদায় নেয়। ডিমে তা দেওয়া আর ছানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুরোটাই বাবার দায়িত্ব। বিপদে পড়লে ডানার নিচে ডিম ও ছানা নিয়ে সে দৌড়ে পালায়। এই কাজের জন্য তার ডানার হাড় ধনুকের মতো বাঁকানো থাকে।
ডিম দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ করে না স্ত্রী দল-পিপি। তা করলে দল-পিপির বংশ রক্ষা হতো না। বছরে মাত্র চারটি ডিম দিলে কয়টি ছানাইবা বাঁচত! হয়তো একটিও না। তাই প্রতিটি পরিশ্রমী স্ত্রী বছরে দুই অথবা তিনটি পুরুষের বাসায় ডিম দেয়। বছরে ১২টি ছানা হলে তবে তার দু-একটি অন্তত সাবালক হওয়ার সুযোগ পাবে।
কিন্তু বছরে দু-তিনবার ডিম দেওয়াটা সহজ কাজ নয়। তাই পাখির জগতে এই কঠিন প্রজননব্যবস্থাটা তেমন জনপ্রিয় নয়। বাংলাদেশের দল-পিপি, নেউ-পিপি ও রাঙ্গাচ্যাগা এ কাজটি করতে পারে বলে বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত। এই তিন প্রজাতিই বাস করে এ দেশের বিল ও বাদায়, যেখান থেকে এরা দ্রুত উৎখাত হয়ে যাচ্ছে লোকের চাপে।
তবু ফুলদি গ্রামে চারটি ছানা সাবালক হওয়ার পথে রয়েছে দেখে আশান্বিত হওয়া যায়। মানুষ দেখলে ছানাগুলো ছুটে পালাচ্ছে; আবার পরক্ষণেই বেরিয়ে এসে খাবারের তালাশ করছে। টিকে থাকার জন্য কী অদম্য আকাঙ্ক্ষা, শ্রম আর অধ্যবসায় এদের। আহা, পূর্ণ হোক নবীনের এই আকাঙ্ক্ষাটুকু!