এ দেশে শীতকালে টুকটুকে লাল একধরনের মৌসুমি ফুল ফোটে, তার উজ্জ্বলতা শীতের হিম সকালে উষ্ণতা নিয়ে আসে। নাম তার স্যালভিয়া। এ ফুলের নামের সঙ্গে মিল রয়েছে স্যালভিয়া হিসপ্যানিকা ওরফে চিয়ার। তবে চিয়ার ফুল লাল না, নীল।
নীলপুষ্পী সেই চিয়া সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছে বাংলাদেশে। চার বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দিনাজপুরের সাবেক উপপরিচালক শামীম আশরাফ আমাকে সে খবর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দিনাজপুর সদর উপজেলার সুন্দরবন ব্লকের কৃষক নুরুল আমিন ২০২০ সালে ৪৫ শতক জমিতে নতুন বিদেশি ফসল চিয়ার চাষ করেছিলেন। শামীম আশরাফ সে বছর জানুয়ারিতে তার চিয়া খেত পরিদর্শনের পর জানিয়েছিলেন, নুরুল আমিন দ্বিতীয়বারের মতো চিয়ার চাষ করেছিলেন।
তার জানামতে, বাংলাদেশে চাষাবাদ শুরু করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান। কানাডা থেকে তিনি বীজ এনেছিলেন। জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশে খাদ্য ফসল হিসেবে বীজের জন্য চিয়ার চাষ হয়ে আসছে। প্রবাদ রয়েছে যে চিয়া বীজ নিয়মিত খাওয়ার কারণে সেসব দেশের যোদ্ধাদের সহজে কেউ যুদ্ধে হারাতে পারত না।
চিয়া শব্দের অর্থ শক্তি। কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎপিণ্ডকে সবল রেখে মানুষকে শক্তি দেয় চিয়া বীজ। তাই স্বাস্থ্যসচেতন অনেকেই এখন চিয়া বীজ অভিজাত দোকান থেকে কিনে পানিতে ভিজিয়ে রোজ খাচ্ছেন। এসব বীজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সেই চিয়া বীজ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে! নতুন সে খবরে চিয়াকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যাই-যাব করতে করতে একসময় সে ফসলটি কাটা হয়ে গেলে আর তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অবশেষে গত বছর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি বিভাগের গবেষণা মাঠে ছোট্ট একটি প্লটে দেখা পেয়েছিলাম চিয়াগাছের। এ বছর মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে শীতকালে চাষ করা আরেকটি চিয়া খেতের দেখা পেলাম। সেন্টারের উপপরিচালক আশুতোষ কুমার বিশ্বাস জানালেন, স্থানীয় মোস্তফাপুর বাজারে চিয়া বীজ বিক্রি হয় ৬০০ টাকা কেজি দরে। সেখান থেকে বীজ কিনেই তিনি চিয়ার চাষ করেছেন। নভেম্বরের ৬ তারিখে বীজ বুনেছিলেন। ফসল কাটতে সময় লাগল প্রায় ১১০ দিন।
বেশ কয়েক প্রজাতির চিয়াগাছ সারা বিশ্বে রয়েছে। চিয়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Salvia hispanica হলেও আসলে স্যালভিয়া ফুলগাছ আর চিয়া ঔষধি গাছ দুটি দুই পরিবারের। চিয়া তুলসী-পুদিনা গোত্রের একটি গাছ, গোত্র ল্যামিয়েসি। মেক্সিকান শব্দ চিয়ান থেকে এর নাম হয়েছে চিয়া, যার অর্থ তৈলসমৃদ্ধ বা তেলা। এর বীজে তেল আছে। এই তেলে রয়েছে হার্ট ভালো রাখার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড। পানিতে ভিজিয়ে তোকমার মতো এই বীজ খাওয়া যায়। পুডিং বা সালাদের সঙ্গেও চিয়া বীজ খাওয়া যায়।
এতে আছে সহজপাচ্য খাদ্য আঁশ ও প্রোটিন। স্বাস্থ্যসচেতন অনেকেই এখন নিয়মিত চিয়া বীজ খাওয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই জনপ্রিয়তার সুযোগে দেশে এখন চিয়া বীজ আমদানি করা হচ্ছে। অথচ এ দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় খুব সহজেই চিয়া বীজ ফলানো যায়। সম্প্রতি দেশের কিছু স্থানে শীতকালে চিয়া বীজ চাষ করে সাফল্য পাওয়া গেছে।
চিয়াগাছ বর্ষজীবী মৌসুমি বিরুৎ, গাছ প্রায় দেড় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কাণ্ড ও ডালে পাতাগুলো বিপরীতমুখীভাবে সাজানো থাকে। পাতা ছোট, ৪-৮ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৩-৫ সেন্টিমিটার চওড়া। একটি ডাঁটির মতো পুষ্পমঞ্জরিতে অসংখ্য ছোট নীল বা নীল-বেগুনি ফুল ফোটে। শিষে ফল শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেলে তার ভেতরে প্রচুর বীজ পাওয়া যায়। বীজ খুব ক্ষুদ্র, কালচে বা গাঢ় চকলেটের মতো রং, চকচকে। বীজ থেকে সহজে চারা হয়। শীতকাল চাষের মৌসুম। পরীক্ষামূলকভাবে চাষে সফলতা পাওয়ায় এখন চিয়াকে নিয়ে গবেষণা ও বিদেশে রপ্তানিযোগ্য ফসল হিসেবে চাষ করে কৃষকরা অধিক লাভবান হতে পারেন।