এ দেশে গ্রীষ্মকাল নিয়ে আসে তীব্র তাপপ্রবাহ, আগুনের হল্কা। তাই বুঝি গ্রীষ্মে ফোটা অনেক ফুলের রঙও হয় উজ্জ্বল, আগুনের শিখার মতো টকটকে লাল, কমলা ও হলুদ। বৈশাখের দিনগুলো রাঙিয়ে দেয় রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়া ও রুদ্রপলাশ, হলুদ রঙের সোনাল আর কনকচূড়া। এর সঙ্গে মাঝ বৈশাখ থেকেই রমনায় ফুটতে শুরু করেছে মাধুরীলতা।
পুষ্পমঞ্জরিতে আগুনের শিখার মতো লাল আর কমলা রঙের মিশেলে অসংখ্য কেশর আড়াল করে ফেলেছে ফুলের পাপড়িগুলোকে। ফোটা ফুলের মঞ্জরিকে দেখলে টুথব্রাশের মতো মনে হয়, তবে তার আকার বেশ বড়। এ জন্য এর এক নাম ব্রাশ ফুল।
মটর বুটের মতো না ফোটা কুঁড়িগুলো পুষ্পমঞ্জরির দণ্ডের ওপর সারি করে গেঁথে আছে। ঘন সবুজ পাতার ঝোপে ফুটতে শুরু করেছে কয়েকটা ফুল। কয়েক দিনের মধ্যেই আরও অনেক ফুল ফুটে আলো করে ফেলবে লতানো গাছের সেই ঝোপটিকে। ফুলে কোনো ঘ্রাণ নেই বটে, তবে ব্যতিক্রমী রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের আনন্দিত করে। এর ইংরেজি নাম মাংকি ব্রাশ ভাইন বা ব্রাশ ফুল, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Combretum rotundifolium ও গোত্র কমব্রিটেসি। বাঁদরের মুখে দাড়ির পশমের মতো এ ফুলের চেহারা বলেই কি এর ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে মাংকি ব্রাশ ভাইন?
সারা বিশ্বে কমব্রিটাম মহাজাতিতে ২৭২ প্রজাতির গাছ আছে। বাংলাদেশে আছে ১১ প্রজাতির গাছ। কিন্তু ১১ প্রজাতির গাছের মধ্যে এই প্রজাতি নেই। ব্রাশ ফুলের গাছ আরোহী লতানো কাষ্ঠল গুল্ম, গাছ বাঁচে অনেক বছর। একবার কোথাও লাগিয়ে দিলে আর একটু-আধটু যত্ন করলে এ গাছ সহজে মরে না। অনেকটা জংলি ধাঁচের। দ্রুত লতিয়ে ছড়িয়ে যায়। প্রতিবছর বেয়াড়া লতাগুলো ছেঁটে না রাখলে আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত বেয়ে যায়। পাতা গাঢ় বা কালচে সবুজ, অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ। লতার দুই পাশে বিপরীতমুখী দুটি করে পাতা ছড়িয়ে থাকে। লতাগুলোর আগায় ফুলের কুঁড়ি আসে। কুঁড়িগুলো একটি পুষ্পদণ্ডের ওপর সুন্দরভাবে সারি করে সাজানো থাকে। কুঁড়ি দেখতে পোড়ামাটি লাল রঙের, ছোট্ট বুটের দানা বা মাছের চোখের মতো।
পুষ্পমঞ্জরির গোড়ার দিক থেকে একটা দুটো করে ফুল ফুটতে শুরু করে, পরে দ্রুত সব ফুল ফুটে যায়। ফুলের পাপড়ির চেয়ে এর জননকেশরগুলো বেশি লম্বা, যা ব্রাশের মতো ঊর্ধমুখীভাবে থাকে। সেগুলো প্রায় তিন সেন্টিমিটার লম্বা, সোনালি লাল রঙ। সব কুঁড়ি ফুটে গেলে পুষ্পমঞ্জরির গড়নটা হয়ে যায় ব্রাশের মতো। মুখে ছোঁয়ালে সে ব্রাশের একটা কোমল পরশ পাওয়া যায়। ফুল ফোটার পর বাসি হলে শুকিয়ে যায়, তখন কেশরগুলো হয়ে যায় লালচে বাদামি।
কোনো গন্ধ নেই ফুলের। তবে উজ্জ্বল রং আকৃষ্ট করে মানুষ ও পতঙ্গদের। বৈশাখ থেকেই গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে, ফুটতে থাকে পুরো গ্রীষ্মকাল ধরে। এমনকি বর্ষাকালেও দুই-একটা ফুল দেখা যায়। এরপর আর ফুল ফোটে না।
এটি একটি শোভাময়ী লতানো ফুলের গাছ। যেকোনো বাগানের প্রবেশপথের ওপরে খিলানের মতো তোরণ করে তার ওপর এ গাছ লতিয়ে দেওয়া যায়। গাছ চিরসবুজ কাষ্ঠল লতানো প্রকৃতির। অনেক বছর বাঁচে। এ গাছের কখনো বীজ হতে দেখিনি, তাই বীজ থেকে চারা করা যায় না। দাবা কলম ও গুটিকলম করে এর চারা তৈরি করা যায়।
ব্রাশ ফুল এ দেশে ততটা সুলভ নয়, খুব কমই চোখে পড়ে। প্রায় ১৫ বছর আগে বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশে এ ফুলগাছের এক বিশাল ছড়ানো লতানো ঝোপ দেখেছিলাম। মালীদের জিজ্ঞেস করলে তার নাম বলেছিলেন ব্রাশ ফুল। এ ফুলের পুষ্পমঞ্জরির গড়ন দেখতে অবিকল টুথ ব্রাশের মতো, তাই হয়তো তারা এ ফুলকে এ নামে ডাকেন। পরে ঢাকা শহরে আরও কিছু জায়গায় এ ফুলের দেখা পাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক্যাল গার্ডেনেও আছে একটা সুশোভিত লতানো ঝোপ। তবে তার প্রজাতি আলাদা, Combretum coccineum যার বাংলা নাম করা হয়েছে মাধুরীলতা। প্রবেশপথে আর্চের মতো গেটের ওপর তুলে দেওয়া হয়েছে গাছকে। মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ঢুকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে ভেতরে যেতে যেতে চোখে পড়ে ডানপাশে একটি ব্রাশ ফুলের গাছ। বাগানের এত সব রূপ, এত ফুলের ঐশ্বর্য দেখে পুলকিত হয়ে ভাবি কত সৌভাগ্য আমার!
মনে পড়ে ভারতীয় কবি জয়দীপ রাউতের দিনান্তে কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি- ‘বাগানের বহু গাছে গাছে/ ওড়ে অনায়াসগামী লতা/ আমি তার অকৃতজ্ঞতা/ ফুল হয়ে ফুটতে দেখেছি।’ বারবার ছুটে যাই রমনা আর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে, কার্জন হলের সামনে, বলধায়- একের পর এক দেখি গাছগুলোতে ফুল ফুটতে। চোখে চোখে রাখি মহুয়া চত্বরের পাশের প্রাঙ্গণে লাগানো লতানো ফুলের গাছগুলোর দিকে।
বসন্তে উদ্বেল হতে দেখেছিলাম মাধবীলতাকে, এবার গ্রীষ্মে প্রস্ফুরণ দেখলাম ব্রাশ ফুলে, মাধুরীলতাকে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে। অপেক্ষায় রইলাম বর্ষায় আর একটি লতানো ফুল দেখার আশায়।