শীতের মিষ্টি রোদের সকাল। কুয়াশা তখনো হালকা চাদর বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতিতে। বিশাল চতুর্ভুজ আকৃতির দীঘির স্বচ্ছ-নিলাভ জলরাশিতে রাজহাঁসগুলো গা ভেজাচ্ছে, পানির ওপর ভাসমান কাঠের নির্মিত রাস্তা, উঁচু সেতু নজর কাড়ছে। দূরের ঘন কেওড়া বনের ওপর দিয়ে পাখির দল উড়ে যাচ্ছে। সারি সারি খেজুরগাছে আটকানো নলে জমা হওয়া ফেনা গড়িয়ে পড়ছে, ছড়াচ্ছে রসের ম ম গন্ধ। দীঘির পশ্চিম পাড়ে থরে থরে সাজানো টব। সেসব টবে সাজানো হলুদ গাঁদার ঝাঁক, চন্দ্রমল্লিকা, টিউলিপ, মনোহর ডালিয়া আর বাহারি গোলাপ আলো ছড়াচ্ছে। যেন রাতভর শিশিরে স্নিগ্ধ হয়ে নিজেদের সৌন্দর্য মেলে ধরেছে যত্ন করে।
বলছি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে জেলা প্রশাসনের উদ্যাগে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন ডিসি পার্কের কথা। গতকাল শনিবার সেখানে গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা গেল। এখানে আগামী ২৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে ফুল উৎসব। আর ফুল উৎসবকে ঘিরে ডিসি পার্কে এখন চলছে বিরাট কর্মযজ্ঞ। সেই সঙ্গে দর্শনার্থীরাও ফুলের ঘ্রাণ নিতে আর ডিসি পার্কের সৌন্দর্য অবলোকন করতে সকাল-সন্ধ্যা ভিড় করছেন।
সরেজমিনে গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, ২৫ জানুয়ারির ফুল উৎসবকে সফল করতে ২ শতাধিক শ্রমিক ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা থরে থরে ফুলের টব সাজিয়ে দিচ্ছেন। কেউ ফুলে আলতো করে ছিটাচ্ছেন পানি। কেউ টবের গোড়ায় ঝুরা মাটি বিছিয়ে দিচ্ছেন। আবার কেউ ফুলের সারি থেকে তুলছেন খড়কুটো। একদল সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছে, আরেক দল স্টল তৈরি করছেন, কেউ কেউ বসাচ্ছেন নাগরদোলা, কোনো দল নৌকা মিউজিয়াম প্রস্তুত করছে। কোনো দল আবার আর্ট নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। সেই সঙ্গে আলোকসজ্জার কর্মযজ্ঞ চলছে সমানতালে। এক কথায় ৪ দিন পরের ফুল উৎসবের জন্য পুরোদস্তুর ব্যস্ত ডিসি পার্ক। বর্তমানে এখানে ৩৫ জন শ্রমিক ফুলের পরিচর্যা করছেন। আছে নানা বিভাগের আরও ৯-১০টি ইভেন্ট গ্রুপ।
নতুন প্রজন্মকে নানা প্রজাতির ফুলের সঙ্গে পরিচয় করাতে, ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে দিতে আর মানুষের অবসরে চিত্তবিনোদনের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান নিরিবিলি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে দীঘির জলে, গাছের ছায়ায় সবুজের হাতছানিতে ডিসি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এক বছর আগে। প্রথমবারের মতো ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখানে ফুল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায় ১৯৪ একর সরকারি জমিতে গড়ে তোলা ডিসি পার্ক। এরপর থেকে প্রতিবছর এখানে ফুল উৎসবের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেন জেলা প্রশাসক।
ডিসি পার্কে ফূল উৎসব উপলক্ষে ১২৭ প্রজাতির ফুলগাছ আনা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে। উৎসবে ফুল সরবরাহ ও ডিজাইনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইফা ল্যান্ডস স্কিপ গার্ডেন ডিজাইনকে। গত ২ মাস ধরে পার্কে সাজানো হয়েছে লাখখানেক ফুলগাছ। এর মধ্যে আছে ১৫ প্রজাতির টিউলিপ, লিলিয়াম, ক্যালাঞ্চু, ডালিয়া, সান ফ্লাওয়ার, ইনকা ভ্যারাইটির প্রায় হলুদ, কমলা রংসহ ৫ প্রজাতির ফুল। এ ছাড়াও রয়েছে বোগেনভিলিয়া, ক্যামিলিয়া, এজিলিয়া, রঙ্গন ভ্যারাইটির অনেক প্রজাতি, ডাম্বেল, টগর, বকুল, হাসনাহেনা, কামিনী, গন্ধরাজ, জবার বিভিন্ন প্রজাতি, হাইডেঞ্জিয়া, মিলি (কাঁটা মকুল), করবী, মাধবীলতা, নীলকণ্ঠ, নীলপারুল। এর বাইরেও বহু প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফুল শোভা পাচ্ছে ডিসি পার্কে।
ইফা ল্যান্ড স্কিপ গার্ডেন ডিজাইনের স্বত্বাধিকারী কাউচার আল হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ২ মাস আগে থেকে এসব ফুল সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। কেননা হঠাৎ করে এতগুলো ফুল পাওয়া সম্ভব নয়। ফুল উৎসবের জন্য দিনরাত আমাদের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ডিজাইনের কাজ শেষ হয়েছে। ফুল দিয়ে বানানো হয়েছে বিশেষ ঝর্ণা, গিটার। কাঠের নৌকার নিচে ফুল দিয়ে ডিসি পার্ক লেখা হয়েছে।
এ ছাড়াও ডিসি পার্ক ঘুরে দেখা যায়, এখানে আছে শিশুদের জন্য আলাদা কিডস জোন, দীঘির পানির ওপর নির্মিত কাঠের পুলের রাস্তা, আঁকাবাঁকা সেতু, ছনের ছাউনির গোলঘর, বাদামতলায় চেয়ার-টেবিল, পানিতে প্যাডেলচালিত কায়াকিং। ফুল উৎসবের দিন এখানে হবে ঘুড়ি উৎসব, ফানুস উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, কায়াকিং, সাম্পান বাইচ, ১০০টি চিত্র প্রদর্শনী, ভায়োলিন প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন।
এ সময় কথা হয় পার্কে ঘুরতে আসা শিক্ষিকা তানভীন আরা নয়নের সঙ্গে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসককে অসংখ্য ধন্যবাদ, এমন সুন্দর একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। এত চমৎকার পার্ক, যা বলে শেষ করা যাবে না। এখনো কাজ শেষ হয়নি, অথচ কত মোহনীয় হয়ে উঠেছে। না জানি পুরো কাজ শেষ হলে কত সুন্দর হয়ে উঠবে। হয়তো স্বপ্নপুরীর মতো দেখাবে। একই কথা বলেন ঘুরতে আসা আরও অনেক নারী-পুরুষ-শিশু দর্শনার্থীও।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিদেশে পড়াশোনা করার সুবাদে দেখেছি দেশে দেশে ফুল উৎসব হয় মাসব্যাপী। এই জায়গাটি ছিল অবৈধ দখলদারের দখলে এবং মাদকের আখড়া। আমরা এটি উদ্ধারের পর ভাবলাম সবচেয়ে ভালো কী করা যায়? কী করলে মানুষ আনন্দ পাবে। এরপর গাছপালা ও বিশাল জলরাশির কারণে সেখানে পার্ক করার চিন্তা করি। তারপর থেকে কাজ শুরু হয়। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ফুল উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের নিজস্ব ফান্ড থেকে করা এ উৎসবে এবারও থাকছে নানা আয়োজন। গড়ে তোলা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহ্যবাহী নৌকা নিয়ে বোট মিউজিয়ামও। জেলা প্রশাসক আরও জানান, পুরো শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সামনে ফুল দিয়ে তোরণ বানানো হবে।