সুন্দরবনের কোলে এক গ্রামের বাড়িতে এক দিন ও রাত কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। খুলনার দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা ইউনিয়নের ঢাংমারী গ্রাম। গৃহকর্তা নজরুল ইসলাম আপ্যায়নের একপর্যায়ে ফিরনি খাইয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই ফিরনি তার গিন্নি রেঁধেছেন, তার হাতে লাগানো পেস্তাবাদামের গাছে ধরা বাদাম দিয়ে।
বাংলাদেশে পেস্তাবাদামের গাছ! শুনে গাছটা দেখার লোভ পেয়ে বসল। ভাবলাম, এখন কত গাছই তো অন্য দেশ থেকে আসছে। ওটাও বোধ হয় তিনি কাউকে দিয়ে বিদেশ থেকে এনে বাড়িতে লাগিয়েছেন। ফিরনি খাওয়া শেষ হলে সেই গাছের কাছে গিয়ে থ-বনে গেলাম। কোথায় পেস্তাবাদামের গাছ? এ তো দেখছি রীতিমতো জংলিবাদাম, যাকে অনেকে কৌট্টাবাদাম বলেও জানেন।
নজরুলকে এ কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘গাছপালা কী আর অত আমরা চিনি? তবে শক্ত লাল খোসার মধ্যে জালের কাঠির মতো যে বাদাম হয়, সেগুলো আমরা ফালি ফালি করে চিরে রোদে শুকিয়ে রেখে দিই। পেস্তাবাদামের মতো ফিরনি-পায়েস রাঁধার সময় সেগুলো তাতে দিই। ওগুলোই আমাদের গ্রাম্য পেস্তাবাদাম!’ ভাবলাম, নামে কি বা আসে-যায়, ব্যবহারটাই হচ্ছে আসল। পেস্তাবাদাম, আলমন্ড, কাজুবাদাম, চীনাবাদাম, এগুলোর সবই বাদাম হলেও সম্পূর্ণ আলাদা। এই জংলিবাদামের সঙ্গে ওগুলোর কোনো মিল নেই।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার ও গুলিস্তানের রাস্তায় দেখেছিলাম ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছে লাল রঙের শক্ত কাঠের মতো কিছু ফল। ক্রেতাদের কৌতূহল মেটানোর জন্য কি-না জানি না, বিক্রেতা একটা ফল ফাটিয়ে দুভাগ করে মেলে রেখেছেন। শক্ত খোসার সে ফলের ভেতরে আছে কালো রঙের দানার মতো কয়েকটা বিচি, ওটাই বাদাম। কালো খোসা ছাড়িয়ে ভেতরে চীনাবাদামের মতো ঘিয়ে রঙের সাদা বাদামগুলো খেতে বেশ। কৌট্টা বা বাক্সের ভেতরে এই বাদাম বন্দি থাকে বলে এর নাম কৌট্টাবাদাম বা বাক্সবাদাম, ইংরেজিতে বলে বক্সনাট। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম স্টারকুলিয়া ফোয়েটিডা (Sterculia foetida), গোত্র স্টারকুলিয়েসি। রোমানদের সারের দেবতা স্টারগুইলিনাসের নামানুসারে এর গণের নামকরণ। কৌট্টাবাদামের গাছ বহুবর্ষজীবী বড় বৃক্ষ প্রকৃতির। গাছের ডালগুলো একটার পর একটা ঘূর্ণাবর্তে থাকে, কাঠ নরম। ডালের আগার দিকে পাতা জন্মে। পাতা উপবৃত্তাকার, বোঁটা খাটো, একটি পাতায় সাতটি পত্রক থাকে, অনেকটা শিমুল বা ছাতিম পাতার মতো দেখতে।
বরিশাল শহরের মধ্যেও ফাগুনের দিনে নিষ্পত্র গাছের ডালে থোকা ধরে ঝোলা টুকটুকে কৌট্টাবাদামের দেখা পেয়েছি। ঢাকায় খামারবাড়ির পাশে আকামু গিয়াস উদ্দীন মিলকী অডিটরিয়ামের সামনে একটি পুরোনো বিরাট কৌট্টাবাদামের গাছ রয়েছে। সে গাছে ফি বছর ফুল-ফল ধরে, পাতা ঝরে। গত বছর টেকনাফের সাবারাং গ্রামে ঘোরার সময় রাস্তার ধারে দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি কৌট্টাবাদামের ছোট গাছ।
টেকনাফের সেসব গাছে থোকা ধরে ঝুলছিল সব সবুজ ফল। শীতে সেগুলো রং বদলে লাল হয়ে পেকে যায়। শীতের পর সেসব পাকা ফল গাছ থেকে আপনাআপনি ঝরে পড়ে। ফাটা ফল থেকে বীজ ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে। ফল শেষ হলে পাতাঝরা সেসব গাছে বসন্তে আবার ফুল ফুটতে শুরু করে। কৌট্টাবাদামের ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। ছড়ায় অনেক সবুজ-বেগুনি ফুল যখন ফোটে, তখন তার শোভা হয় দেখার মতো।
পুরুষ আর মেয়ে ফুল ফোটে আলাদা গাছে। বসন্তে ফুল ফোটে ও এরপর পাতা গজায়। ফুল ফোটার প্রায় ১১ মাস পর ফল পাওয়া যায়। অনেকেই এই বাদাম কাঁচা অবস্থায় খেয়ে থাকেন। কিন্তু গবেষকদের পরামর্শ হলো, সেগুলো ভেজে খাওয়া উচিত। কাঁচাবাদামে অনেক সময় বিষক্রিয়া হতে পারে।