সাধারণত দিনে আমাদের ১০০টা চুল পড়ে, কিন্তু যদি আপনি তার চেয়ে বেশি চুল পড়তে দেখেন (১২০-১৫০ বা আরও বেশি) বা মাথার ত্বকের কোনো জায়গা খালি হয়ে যেতে দেখেন, তবে আপনার তখনই চুলের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অলিভা ক্লিনিক অবলম্বনে জানাচ্ছেন ফারজানা আলম
চুল পড়ার শ্রেণিভেদ
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চুল পড়াকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে ভাগ করেন।
অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া: এটি খুব সাধারণ সমস্যা। মহিলা ও পুরুষ উভয়েই এই রোগের শিকার হতে পারেন। এটি খুব তাড়াতাড়ি শুরু হতে পারে যেমন টিনএজ বয়সে এবং বয়সের সঙ্গে এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মেল প্যাটার্ন বল্ডনেস: একটি বিশেষ বিন্যাস অনুযায়ী চুল পড়া শুরু হয়। প্রথমে কপালের দুই পাশ থেকে। সময়ের সঙ্গে হেয়ারলাইন পিছিয়ে ‘M’ আকৃতি ধারণ করে। ব্রহ্মতালুর চুলও পাতলা হয়ে আংশিক বা পুরো ফাঁকা হয়ে যেতে পারে।
ফিমেল প্যাটার্ন বল্ডনেস: এতে চুল মাথার ওপরের দিক থেকে ফাঁকা হওয়া শুরু হয় এবং মাঝখানের সিঁথি ক্রমশ চওড়া হয়ে যায়। তবে হেয়ারলাইন পেছায় না। কখনো কখনো পুরো মাথায় টাক পড়ে যেতে পারে।
টেলোজেন এফ্লুভিয়াম: এটি সারা মাথায় চুল পাতলা হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কোনো একটি ঘটনার ফলে তিন মাস পরে শুরু হয় এবং মাস ছয়েকের মধ্যে সাধারণত নিজেই কমে যায়।
অ্যালোপেশিয়া এরিয়াটা: এ ধরনের চুল পড়াতে মাথার ত্বকের কিছু বিক্ষিপ্ত জায়গায় গোল করে টাক পড়ে যায়। তবে বাকি চুল স্বাভাবিক থাকে। অনেক সময় পুরো মাথাতেই টাক পড়ে যেতে পারে। এতে শরীরের প্রতিরক্ষা শক্তি দেহের সুস্থ টিস্যুর ক্ষতি করে তাকে নষ্ট করে দেয়।
ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া: এই রোগে বারবার চুল ধরে টানার ফলে চুল পড়ে যায়। ডাক্তাররা এই রোগকে ঝোঁক নিয়ন্ত্রণ রোগের তালিকায় ফেলেন।
ইনভল্যুশনাল অ্যালোপেশিয়া: স্বাভাবিক বয়স বৃদ্ধির জন্য যে চুল পড়া। এর মূল কারণ হলো চুলের বৃদ্ধির অ্যানাজেন পর্বটির সময় হ্রাস পাওয়া। এতে যত তাড়াতাড়ি চুল পড়ে, অত তাড়াতাড়ি নতুন চুল গজিয়ে উঠতে পারে না।
স্কারিং অ্যালোপেশিয়া: একে সিকাট্রিশিয়াল অ্যালোপেশিয়াও বলা হয়। এটি খুব বেশি দেখা যায় না। এতে বিভিন্ন অসুখের ফলে মাথার ত্বকে প্রদাহ বা ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়ে নতুন চুল গজানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
চুল পড়ার কারণ
চুল পড়া শুরু হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন-
বংশগত: পরিবারে কারও চুল পড়ার ইতিহাস থাকলে অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা হতে পারে। ফলে পুরুষরা টাক পড়া বা হেয়ারলাইন পিছিয়ে যাওয়া লক্ষ করতে পারেন এবং মহিলারা সিঁথি চওড়া হয়ে যাওয়া ও চুলের ফাঁক দিয়ে মাথার ত্বক দেখা যাওয়ার সমস্যায় ভুগতে পারেন।
হরমোনের সমস্যা: গর্ভাবস্থা বা মেনোপজের সময় হরমোনের তারতম্যর ফলে চুল পড়া শুরু করতে পারে। এ ছাড়া গর্ভনিরোধক বড়ি খেলে, প্রসবের পরে বা হিস্টারেক্টমি (গর্ভাশয় কেটে বাদ দেওয়া) হলে অ্যানাজেন পর্যায়টি ছোট হয়ে গিয়ে চুল পড়তে পারে। ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স আরেকটি কারণ। পুরুষদের ক্ষেত্রেও চুল পড়ার পেছনে হরমোনের তারতম্য থাকতে পারে।
ভুল জীবনশৈলী: স্ট্রেস, বাজে খাদ্যাভ্যাস, অপুষ্টি এবং ভুল জীবনশৈলী অনুসরণের কারণে চুল পড়তে পারে।
ওষুধ: ক্যানসারের কেমোথেরাপি চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চুল পড়তে পারে।
টেনে চুল বাঁধা ও চুলে রাসায়নিক চিকিৎসা করানো: টেনে চুল বাঁধা যেমন ঝুঁটি বাঁধার ফলে হেয়ার ফলিকলে টান পড়ে চুল পড়া বেড়ে যেতে পারে। ব্লিচ, রং দিয়ে চুলের রাসায়নিক চিকিৎসা করালে চুল সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে যেতে পারে।
অন্যান্য কারণ: অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত কারণের মধ্যে পড়ে দীর্ঘস্থায়ী অসুখ যেমন- থাইরয়েডের রোগ, লুপাস এবং পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ। ক্র্যাশ ডায়েট, চিন্তায় নিয়মিত চুল টানা বা মাথা চুলকানোর অভ্যাস, দ্রুত ওজন কমানো, ইনফেকশন, চুলের রঙে অ্যালার্জি, চুলের কসমেটিক্স, সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা সোরিয়াসিস জাতীয় রোগের কারণে হঠাৎ করে চুল পড়া শুরু হতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
ক্রমাগত অতিরিক্ত চুল পড়া।
ব্রহ্মতালুর চুল পাতলা হয়ে যাওয়া।
গোলাকৃতি আকারে বিভিন্ন জায়গায় টাক পড়া।
ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্য হঠাৎ করে চুল উঠে যাওয়া, সঙ্গে ব্যথা বা চুলকানি।
বিক্ষিপ্তভাবে চুল গজানো।
‘M’ আকারে হেয়ারলাইন ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়া।
রোগ নির্ণয়
বিশেষজ্ঞরা চুল পড়ার কারণ চিহ্নিত করতে মেডিকেল হিস্ট্রি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ এবং ট্রাইকোস্কোপির সাহায্য নেন। খুব বেশি চুল পড়ার কারণে নিয়ে সন্দেহ থাকলে ডাক্তার বায়োপসি করার পরামর্শ দিতে পারেন যাতে একটি উপযুক্ত চিকিৎসাপদ্ধতি নির্দিষ্ট করা যায়।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
চুল পড়া থামাতে এই সহজ টিপসগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
উগ্র রাসায়নিক দেওয়া সামগ্রী চুলে লাগাবেন না। তাপ দিয়ে চুল স্টাইল করার সরঞ্জাম যেরকম স্ট্রেটনার বা পার্মিং আয়রন ব্যবহার করবেন না।
সুস্থ চুল পরিচর্যার রুটিন মেনে চলুন এবং হালকা শ্যাম্পু দিয়ে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার চুল পরিষ্কার করুন। কতবার শ্যাম্পু করা উচিত তা আপনার চুলের প্রকৃতি ও ময়লা এবং পলিউশন চুলে কতটা প্রভাব ফেলছে তার উপর নির্ভর করে।
প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট ও ভিটামিন যেমন আয়রন, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি, প্রোটিন আর ভিটামিন ই সহ একটি ব্যালান্সড ডায়েট খান।
সুস্থ জীবনশৈলী মেনে চলুন। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগাসন এবং মেডিটেশন করে চাপমুক্ত জীবন উপভোগ করুন।
এমনভাবে চুল বাঁধবেন না যাতে চুলের গোড়ায় বেশি টান পড়ে।
ঘরোয়া সমাধান
দই: ২ চামচ দইয়ের সঙ্গে ১ চামচ মধু এবং ১ চামচ লেবুর রস নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। মিশ্রনটা ভালো করে চুলে লাগিয়ে কম করে ৩০ মিনিট রেখে দিন। চুলটা ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে সপ্তাহে একবার করলে চুল পড়ার হার কমতে শুরু করবে।
নারকেল দুধ: এক কাপ নারকেল দুধ নিয়ে ধীরে ধীরে স্কাল্পে লাগান। টাওয়াল দিয়ে মাথাটা ঢেকে ২০ মিনিট রেখে ভালো করে চুলটা ধুয়ে ফেলুন। এমনটা সপ্তাহে কয়েকবার করলেই দেখবেন চুল পড়া কমতে শুরু করবে।
পেঁয়াজের রস: একটা পেঁয়াজ থেকে রস সংগ্রহ করে নিন। তারপর সেই রস সরাসরি মাথায় লাগিয়ে মাসাজ করুন। ৩০ মিনিট পরে শ্যাম্পু করে নিন। প্রসঙ্গত, সপ্তাহে ২-৩ বার এই পদ্ধতিতে চুলের পরিচর্যা করলে ফল পাবেন একেবারে হাতে-নাতে।
বিটরুট: পরিমাণ মতো বিটরুট পাতা নিয়ে পানিতে সেদ্ধ করে নিন। তারপর পাতাগুলো গুঁড়ো করে নিয়ে মেথির সঙ্গে মিশিয়ে স্কাল্পে লাগান। এই মিশ্রনটি ২০ মিনিট মাথায় লাগিয়ে রাখলে চুল পড়ার হার একেবারে কমে যায়।
মেথি: মেথি বীজ নিয়ে এক গ্লাস পানিতে এক রাত ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন বীজগুলো বেটে পেস্ট বানান। সেই পেস্টটা ভালো করে মাথায় লাগিয়ে ৪০ মিনিট রেখে দিয়ে ধুয়ে নিন।
নিম পাতা: ১০-১২টা নিম পাতা পানিতে ফুটিয়ে নিন। সেই পানি দিয়ে ভালো করে চুল ধুয়ে নিন। এমনটা করলেই দেখবেন উপকার মিলতে শুরু করেছে।
অ্যালোভেরা: পরিমাণ মতো অ্যালোভেরা জেল নিয়ে স্কাস্পে লাগিয়ে নিন। আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে কুসুম গরম পানি দিয়ে ভালো করে মাথাটা ধুয়ে নিন।
কলি