একটা ছবি। নেহাতই একজন ট্যুরিস্টের তোলা ছবি বললেই হয়। কিন্তু তার মনে হয়েছিল ছবিটা তোলা দরকার। জায়গাটার তো একটা মাহাত্ম্য আছেই, কত হাজার বছরের মাহাত্ম্য কেউ জানে না। আছে এই গঙ্গার ঘাটগুলোর শোভা- কিন্তু ঘাট দেখতে গিয়ে হঠাৎ এ দৃশ্যটাও তার চোখে পড়ে গেল। তাই সে শিক্ষিকার সঙ্গে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে দু-একটা কথা বলে একটু লুকিয়ে ছবিটা তুলে ফেলল। তারপর আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিল।
আমি এমন এক বুড়ো, সবাই জানে যে, লোকটা আজীবন মাস্টারি করেছে, এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক মাস্টার। তাকে আবার সবাই ‘বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ’ও বলে, আর সে নির্লজ্জ, পাথরের মতো মুখে ওই কথাটা সহ্য করে। যা-ই হোক, শিক্ষা আমার প্রিয় বিষয়, দেওয়ার হোক, নেওয়ার হোক। তাই আমিও ছবিটা পাওয়া মাত্র আমার মুখবইয়ে নিক্ষেপ করলাম। এ রকম কিছু কথা লিখে যে, “আমার বড় মেয়ে কুরচি আর জামাই জয়াশিস সম্প্রতি কাশী বেড়াতে গেছে। সেখানে গঙ্গার ‘অসি’ ঘাটে (এখানে নাকি মা দুর্গা তলোয়ার বিসর্জন দিয়েছিলেন) এই ছবিটা আমার মেয়ে তুলে পাঠাল। আমার কাশীর মাহাত্ম্য বা গঙ্গার পবিত্রতা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু ছবিটা হয়তো মুখবইয়ের বন্ধুদের ভালো লাগবে, তাই দিচ্ছি।” আমার মেয়েও মাস্টারনি, একটি সরকারি মেয়েদের স্কুলে খুবই দাপটে পড়ায়, ফলে তারও মনে হয়েছিল, এই ছবিটা হয়তো আমার ভালো লাগবে।
গত তারিখে দিয়েছিলাম ছবিটা। আর কী আশ্চর্য ব্যাপার- এ নিয়ে যত প্রতিক্রিয়া এল, জন্মে আমার পোস্টে তত প্রতিক্রিয়া আসেনি। প্রায় ৫০০ ‘লাইক’, ‘লাভ’ ইত্যাদি, আর আশির বেশি মন্তব্য। কেউ বলেছে ‘অসাধারণ ছবি’, কেউ বলেছে ‘এই তো নতুন ভারতের ছবি!’
অর্থাৎ ছবিটার দ্বারা আন্দোলিত বা আলোড়িত হয়েছে বেশ কিছু লোক। যারা আমার পাতায় ‘লাইক’ ইত্যাদি নিয়মিত দেন, অনেকটাই বুড়ো মাস্টারের প্রতি ভালোবাসায়, তাদের বাইরেও প্রচুর লোক ছবিটা নিয়ে ভেবেছেন আর মন্তব্য করেছেন। এতে আমিও ভাবতে বাধ্য হয়েছি, কী এমন আছে ছবিটাতে, যা এত মানুষকে নড়িয়ে দিল?
মনে হলো, এ ছবি একই সঙ্গে আমাদের, বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের, একটা অতীত শৈশবের স্মৃতি উসকে দিচ্ছে, আবার একটা ভবিষ্যতের স্বপ্নও তুলে ধরছে। সেই সঙ্গে একটা মূল্যবোধ জাগিয়ে দিচ্ছে ভেতরে, যা আমরা সবাই মনের মধ্যে পুষে রাখতে চাই। এ জীবনে অনেক কিছু চাই আমরা, কিন্তু সভ্যতা আমাদের শিখিয়েছে যে, শিক্ষা না হলে সেসব চাওয়ার কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। সে চাওয়া কেন চাইছি, সে চাওয়া ভালো কী মন্দ, তার কতটা ভালো কতটা মন্দ, ভালো হলে কেন ভালো, মন্দ হলে কেন মন্দ- সেসব বোঝার জন্যই আমাদের যা অনিবার্যভাবে দরকার তা হলো শিক্ষা। শিক্ষাহীন জীবন প্রায় পশুর জীবন, শিক্ষাই আমাদের বেঁচে থাকার মধ্যে মূল্য সঞ্চার করে।
আমি অবশ্য বারবার করে নানা জায়গায় লিখেছি যে, স্কুলের শিক্ষা পেলাম আর শিক্ষিত হলাম, আর যারা স্কুলে ঢুকতে পারল না, লিখতে পড়তে জানল না, তারা ‘অশিক্ষিত’ রয়ে গেল- কথাটা ঠিক সে রকম নয়। তারা ‘নিরক্ষর’ হতে পারে, কিন্তু ‘অশিক্ষিত’ নয়। তারা মুখে অনেক কিছু শেখেন। তারা প্রচুর কাজ জানেন, সেটাও একটা বিদ্যা বা শিক্ষা। তারা পুরাণের-কোরআনের কথা জানেন অনেকে, তার থেকে শিখেছেন কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোন অবস্থায় বা কার সঙ্গে কী কথা বলতে হয়, কী কাজ করতে হয়, সে এক শিক্ষা। তারা মুখে কত ওষুধ-বিষুদের কথা জানেন, মানুষের সাহায্যে ছুটে যান। নিরক্ষর মেয়েরা (আমাদের কারও কারও মা-মাসি-দিদিমারা) রান্নাবান্না, সেলাই-ফোঁড়াই সবই জানেন, তাও নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। নিরক্ষর মানুষ আরও কত কী জানেন।
তবু ‘লেখাপড়া’টা আমাদের মানবসমাজের এক চিরলালিত স্বপ্ন। লেখাপড়া ছাড়া মানুষ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা আয়ত্ত করেছে, মাটি ও জলের কৃষি, নানা হাতের কাজ, নৌবিদ্যা ও নানা ব্যবসা-বাণিজ্য, কিন্তু লেখাপড়া যুক্ত হওয়ার পর মানুষ তার জ্ঞান আর কর্মের এলাকায়, সভ্যতার নির্মাণে যত লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়েছে, এমন আর আগে হয়নি। তাই আধুনিক মানুষের কাছে লেখাপড়া এক বিশাল অর্থ বহন করে। তাই ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য নাগরিক মা-বাবা রাত জেগে লাইন দেয় স্কুলের গেটে, ধাক্কাধাক্কি করে আহতও হয়। গত শতকের শেষে সাক্ষরতার কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম, কীভাবে মানুষ, বিশেষত মেয়েরা, কষ্ট করে সাক্ষরতার কেন্দ্রে আসে, সারা দিন পরিশ্রমের পর চোখে ঘুম নিয়ে প্রাণপণে পড়ে, পরীক্ষা দেবে বলে বাপ-মা বিয়ের লগ্ন পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কীভাবে ‘সাক্ষর মায়ের সন্তান নিরক্ষর থাকে না’ ধরনের স্লোগান দলে দলে নিরক্ষর মায়েদের টেনে এনেছিল গ্রামের সাক্ষরতা কেন্দ্রে, সে আমার নিজের চোখে দেখা।
তাই এই ছবিটা এত মানুষের মনে এত সাড়া জাগিয়েছে। আমার সন্তান লেখাপড়া শিখুক, তা হলে সে ‘দুধেভাতে’ থাকবে। সবাই শিখুক। হয়তো একটা বাহিনীও তৈরি হয়েছে দেশে, যারা এই ব্রতে নেমে পড়েছে। ওই মেয়েটি তাদেরই একজন। তারা এই ভারতকে বদলে দিতে চায়।
আমরা তো একটা আলোকিত ভারত চাই, যাতে ওই পথশিশুরাও লেখাপড়া শিখবে। এ ধরনের ছবি আমাদের সেই স্বপ্ন দেখায়। ওই মেয়েটি, যে কাশীর গঙ্গার ঘাটে ওই শিশুদের পড়াচ্ছে, সে আমাদের সেই স্বপ্ন দেখায়। সে আমার প্রণম্য।
স্বপ্ন স্বপ্নই, কিন্তু তা দেখতে দোষ কী? যদি কিছু মানুষ তা সত্য করতে হাত লাগায়! এই দক্ষিণ এশিয়ায় ঘাটে ঘাটে, মাঠের গাছতলায়, বাড়ির উঠোনে, পথের ধারে! এই ছবিটার জয় হোক।
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়