আব্দুল হালিমের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে। বয়স ৬৫ ছুঁইছুঁই। স্ত্রী ও বোন নিয়ে এবার হজে যাচ্ছেন। ঢাকার আশকোনা হজক্যাম্পে এসে পৌঁছেছেন সকাল ৯টায়। বিমানে চড়বেন এক দিন পর। ‘আমার হজের খবরে আমার বউ-ই বেশি খুশি হলো। এক দিন বউ বলল, ‘আমারেও নিইয়া চলেন। আপনার সঙ্গে হজে যেতে চাই। চিন্তা করলাম, ৪০ বছর ধরে এক লগে আছি। হজটাও এক লগে করি। আল্লাহ রহম করলেন। হজক্যাম্পে নিজেরে বন্দি পাখির মতো লাগে। মক্কায় যেতে পারলেই কেবল মুক্তি।’ জানালেন আব্দুল হালিম।
বাংলাদেশ থেকে এবার মোট ৮৫ হাজার ২৫৭ জন হজ করতে যাবেন। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ১৬ জুন হজ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশি হাজিদের হজযাত্রার প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ করা হয় ঢাকার আশকোনা হজক্যাম্পে। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা হয় এখানেই। জেদ্দার ইমিগ্রেশন হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। হাজিদের প্রথম হজক্যাম্পেই আসতে হয়।
ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশন বা বাসস্টেশন নেমে হাতের বামে আশকোনার দিকে কিছুটা পথ হাঁটলেই হজক্যাম্প। ক্যাম্পের মূল ভবনের গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে তথ্যকেন্দ্র। হাজিদের সব বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয় এখান থেকে। গেটের ডান দিকে রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বইয়ের প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র। এরপরই মসজিদ। নিচ তলায় পুরুষদের নামাজের জায়গা, ওপরে নারীদের। একসঙ্গে ৫ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। প্রতিদিন মাগরিব ও ফজর নামাজের পর হজবিষয়ক আলোচনা হয়। মাগরিবের পর ইহরামের কাপড় পরে দেখানো হয়। মসজিদের পাশে রয়েছে দুটি খাবার ক্যান্টিন। প্রতিদিনই খাবারের মান যাচাই করা হয়।
মূল গেটের বাম দিকে পুলিশ কন্ট্রোল রুম পেরিয়ে ডান দিকে পথ নিলেই বিমান বাংলাদেশ, সৌদি এয়ারলাইন্সের চেকইন কাউন্টার। এরপর ডান দিকে বাঁক নিলেই ফ্লাইনাসের চেকইন কাউন্টার। বিমান বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন অফিসও লাগোয়া সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেই চোখে পড়বে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বুথ। রিয়াল সংগ্রহ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যায় সেখানে।
হাজিদের সেবায় রয়েছে অস্থায়ী চিকিৎসাসেবা। ডাক্তার-নার্স ও ফার্মাসিস্ট মিলিয়ে ২৪ জন সেবা দিচ্ছেন। পুরো নিচতলায় রয়েছে সারি সারি চেয়ার পাতা। আছে পর্যাপ্ত ফ্যান ও আলোর ব্যবস্থা। মূল ভবনের দুই থেকে সাত তলা পর্যন্ত ডরমেটরি রয়েছে ২৪টি। ওপরে ওঠার জন্য পাঁচটি লিফট আছে। প্রতিটি ডরমেটরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। হাজিরা বিনামূল্যে থাকতে পারেন এখানে। ফ্লাইটের আগের সময়টা চাইলে এখানেই কাটান হাজিরা। নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারেন তারা। ডরমেটরিতে আরাম করতে পারেন। মসজিদে ইবাদত করতে পারেন। নিতে পারেন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ। হাজিদের সেবা দিতে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করছেন হজক্যাম্পের দায়িত্বশীলরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন আঞ্জুমান খাদেমুল হজের ৮০ জন ও রোভার স্কাউটের ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবক। হজক্যাম্পের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা রয়েছে। অনেকেই এই ভালো ব্যবস্থাপনার কথা জানেন না। ডরমেটরির কথা জানেন না। হাজিরা এসে এলোমেলো বসে থাকেন। ফলে মানুষ মনে করে তাদের জন্য ভালো ব্যবস্থাপনা নেই।’
তখন বিকেল, ঘড়িতে ৪টা বাজে। হজক্যাম্পের মূল ভবনের গেটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি বাস থামল। বাস থেকে নামছেন শুভ্র পোশাকের হজযাত্রীরা। তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। তারা এসেছেন বরিশাল থেকে। ১১৬ জনের কাফেলা। রাত ২টা ১৫ মিনিটে ফ্লাইট। মাহবুব হাসানের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, ‘কত বছর ধরে কাবাঘরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়ছি, সেই ঘর আজও দেখা হয়নি। এবার দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে। তাওয়াফ করব। রাসুলের রওজায় সালাম দেব। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে।’ মূল গেটের বাইরে দেখা হলো নাছিমা বেগমের সঙ্গে। সাভারে বাড়ি তার। ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদছেন। নাছিমা বেগম বললেন, ‘জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে কাঁদতাম। মক্কা-মদিনা দেখতে চাইতাম। আল্লাহ ডাক শুনেছেন।’
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক