১১ ব্যক্তির নামে চার প্রতিষ্ঠান খুলে পাঁচ বছরে ৫২৩ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ১১ ব্যক্তির মধ্যে চার ব্যক্তি- রমিজ উদ্দিনকে (৪২) চেয়ারম্যান করে রায়তা সুয়েটার্স লিমিটেড, তাহের আহমেদকে (৪৪) চেয়ারম্যান করে এসআরএন ইলেকট্রিক, জাহিদুল ইসলামকে (৫১) চেয়ারম্যান করে অপটিকস ফ্যাশন লিমিটেড এবং আকিদুল ইসলামকে (৪৯) চেয়ারম্যান করে ড্রিম টেক্স গার্মেন্টস লিমিটেড নামের চার প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। চার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালক হিসেবে আরও সাত ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে চার প্রতিষ্ঠান ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর বা বিন (বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা পেয়েছে। রায়তা সুয়েটার্স লিমিটেড ১০২ কোটি টাকা, এসআরএন ইলেকট্রিক ৮৯ কোটি টাকা, অপটিকস ফ্যাশন লিমিটেড ১৪৫ কোটি টাকা এবং ড্রিম টেক্স গার্মেন্টস লিমিটেড ১৮৭ কোটি টাকা পাচার করেছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, বিভিন্ন কৌশলে অর্থ পাচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দারা অর্থ পাচার বন্ধ করতে কাজ করছেন। এরই মধ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্থ পাচারকালে অনেক প্রতিষ্ঠানকে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে অনেক দিন থেকে অর্থ পাচার করে আসছে তাদেরও ধরা হয়েছে। যারা শুধু নির্দেশ পালন করে তাদের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ পাচারকারী দলের নেতাদের ধরার কাজও চলছে।
তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ১১ ব্যক্তি তাদের নামে প্রতিষ্ঠান খোলা থেকে এলসি করা, আমদানি, রপ্তানি, প্রণোদনা নেওয়া, অর্থ পাচার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এসব ব্যক্তির স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান খোলা থেকে অর্থ পাচারের পুরো প্রক্রিয়ায় ভুয়া বা জাল কাগজপত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিচয়পত্র ব্যবহারের বিষয়েও তারা জানতেন না। তারা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তবে অর্থ পাচারের বিষয়টি শুল্ক গোয়েন্দাদের নজরে আসার পর তারা আত্মগোপনে আছেন। অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা নিজেদের আড়ালে রাখতে ১১ ব্যক্তিকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করেছেন বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। এসব ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও শুল্ক গোয়েন্দারা যোগাযোগ করে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থ আমাদের দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার করা হচ্ছে। তাই কোথা থেকে, কারা, কী পদ্ধতিতে পাঠাচ্ছে- এটা বের করা যেমন জরুরি, তেমন জরুরি কোথায়, কার কাছে অর্থ পাঠানো।
পাচারকারীদের ধরতে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তাদের ধরতে হলে দেশে-বিদেশে একই সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। তবে একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে একা অর্থ পাচার করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত থাকে। এদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল- এই পাঁচ বছরে ১০৩ চালানে অর্থ পাচার করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ১৮ চালানে, ২০২০ সালে ১১ চালানে, ২০২১ সালে ৩১ চালানে, ২০২২ সালে ২০ এবং ২০২৩ সালে ২৩ চালানে কাঁচামাল আমদানির কথা বলে বিদেশে প্রকৃত হিসাবের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ যে পরিমাণের এবং যে দামের কাঁচামাল আমদানির কথা বলে ব্যাংকে এলসি খুলে বিদেশে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে দেশে আমদানি করা হয়েছে তার চেয়ে কম দামের এবং কম পরিমাণে পণ্য। প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাচারকারীরা নিয়ে নিয়েছে। তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, চীন, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে কাঁচামাল আমদানির কথা বলে অর্থ পাচার করা হয়েছে। ওই ১১ ব্যক্তিকে ব্যবহার করে ভুয়া প্রতিষ্ঠান বানিয়ে অর্থ পাচারে জড়িতদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে ১১ ব্যক্তিকেও খুঁজে বের করার কাজ চলছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠান খুলে অর্থ পাচারের বিষয়টি এবারই প্রথম না। এর আগে অনেকবারই এ ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও শুল্ক গোয়েন্দার তদন্তে বিষয়গুলো ধরা পড়েছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সৎ-অসৎ সব জায়গাতেই আছে। সৎ ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে ব্যবসা করছেন বলেই সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য সৎ ব্যবসায়ীদের দুর্নাম হচ্ছে। অর্থ পাচারকারীরা দেশের শত্রু। এদের ধরতে সরকারের সঙ্গে আমরাও কাজ করছি।’
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান প্রকাশ পেয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে।
অর্থ পাচার-সম্পর্কিত এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্যের আকার ১৫০ শতাংশের বেশি হয়েছে। অর্থনৈতিক মুক্ততার মাত্রা গত ১০ বছরে ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশের বেশি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিধি বাড়ার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারও আগের চেয়ে বেড়েছে। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাছে সরকার।’
সর্বশেষ কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের কারণে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অর্থ পাচারকে কেন্দ্র করে দেশে একটি দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে।’