গত সোমবার বেলা ৩টা। গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টের সিগন্যাল পার হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আকাশ পরিবহনের একটি বাস, গুলিস্তান হয়ে সদরঘাট যাবে বাসটি। প্রায় ৩০ মিনিট পার হলেও সিগন্যাল ছাড়ছে না, বাসে হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রী ছিলেন। জ্যামের কারণে অধিকাংশ যাত্রী হেঁটেই তাদের গন্তব্যে রওনা হয়েছেন। বাসচালক মনির হেলপার জলিলকে বলেন, ‘কি রে গাড়িতে দেহি যাত্রী নাই।’ জলিল বলেন, ‘ওস্তাদ ব্যাপক জ্যাম, গাড়ি ঘুরাইয়া দেন, গাড়ি ঘুরাইয়া যাত্রী নিয়া নিমুনে।’ চালকের সঙ্গে কথা শেষে জ্যাম গাড়ি যাবে না বলে যাত্রীদের নামিয়ে দেন জলিল। পরে পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে মনির জলিলকে দেন। জলিল জানতে চান, ‘কিসের টাহা? মনির বলেন, ‘বুঝেন না কিসের।’ তখন জলিল জানান, ৫০ টাকা এখন আর নেয় না ট্রাফিক, ১০০ টাকা লাগব। পরে আরেকটি ৫০ টাকার নোট জলিলকে দেন মনির, পরক্ষণে ছাড়ে সিগন্যাল। দ্রুত গাড়ি টান দিয়ে ঘুরিয়ে নেন মনির, ততক্ষণ রাজিব নামের ট্রাফিক পুলিশের হাতে টাকা ধরিয়ে দেন হেলপার জলিল।
রাজধানীর গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে এ ধরনের ঘটনা নিত্যদিনের। সরেজমিনে দেখা যায়, গাজীপুর থেকে পল্টন-গুলিস্তান হয়ে সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জ যায় আকাশ, ভিক্টর, প্রভাতি-বনশ্রী, আজমেরি, সাভার ও গাজীপুর পরিবহনের এসব বাস। তবে গরম ও অতিরিক্ত যানজটের কারণে অধিকাংশ গাড়ি এই সিগন্যাল থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন চালকরা।
টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাসচালক মনির খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাসে সমস্যা ছিল তাই ঘুরাইয়া দিসে।’ তখন এ প্রতিবেদক তাকে গাড়ি ঘোরানো ও ভিডিওর কথা বললে তিনি স্বীকার করেন যে তার হেলপার ১০০ টাকা দিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশকে।
আইন না মেনে চালকদের গাড়ি ঘোরানোর সুযোগ দিয়ে কতিপয় পুলিশ সদস্য নিজের পকেট ভারী করছেন। জিরো পয়েন্টে সড়কে আকাশ পরিবহন থেকে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্য রাজিব। তিনি খবরের কাজকে বলেন, ‘আমি কোনো টাকা নিইনি।’
এখানে গাড়ি ঘোরানোর কোনো নিয়ম নেই, তবে কে ঘোরাচ্ছেন- প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘গাড়ি ঘোরানোর কারণ আছে।’ কী কারণ জানতে চাইলে তিনি তর্কে জড়ান।
বিপরীত পাশে দায়িত্বরত সার্জেন্ট তৌফিক হোসেনকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ‘এই রুটে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ গাড়ি চলে। গাড়ি সাধারণত ঘোরাতে দিই না। এই পয়েন্ট দিয়ে গাড়ি ঘোরানো বেআইনি। অনেক সময় আমি কাজের প্রয়োজনে আশপাশে গেলে আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘোরানো হয়। বিষয়টি আমি দেখছি।’ পরে তিনি সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিককে সতর্ক করেন ও গাড়ি যেন ঘোরানো না হয় সে নির্দেশ দেন।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট ও গোলাপ শাহর মাজার থেকে টাকার বিনিময়ে গাড়ি ঘোরাতে দিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। এ ছাড়া সদরঘাট থেকে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড হয়ে আসা বাসগুলো মূল সড়কে এসে যাত্রী তোলা ও সড়ক আইন ভঙ্গ করলে দায়িত্বরত ট্রাফিককে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেন বাসগুলোর চালক ও হেলপার।
শুধু গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট, গোলাপ শাহর মাজার ও গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে এভাবে বছরে ওঠে কোটি টাকা। তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে বছরে এই টাকা ওঠে?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ঢাকায় ৩৮৮টি রুটে বাস চলাচলের অনুমোদন থাকলেও এখন ১১০টি রুটে বাস চলে। এ ছাড়া ১৮ হাজার ৪৩১টি যাত্রীবাহী বাস চলাচলের অনুমোদন থাকলেও চলে ১০ হাজার ২৮৯টি বাস।
ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি জানায়, প্রতিদিন গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট-গোলাপ শাহ মাজার-গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড-তাঁতীবাজার মোড়-সদরঘাট-কেরানীগঞ্জ রুটে বাস চলে ৫৮০টি। এর মধ্যে আকাশ পরিবহনের ৮০টি, ভিক্টর পরিবহনের ১০০টি, প্রভাতি-বনশ্রী পরিবহনের ৬০টি, আজমেরি পরিবহনের ১০০টি, সাভার পরিবহনের ২০০টি ও গাজীপুর পরিবহনের ৪০টি বাস চলে এই রুটে। গাড়ি ঘোরানো, ইচ্ছামতো যাত্রী তোলা-নামানোসহ বিভিন্ন কারণে এসব বাসকে প্রতিনিয়ত রাস্তায় ট্রাফিককে টাকা দিয়েই চলতে হয়। এ ছাড়া মামলার ভয় তো রয়েছেই।
প্রতিদিন এই রুটে চলাচল করে ৫৮০টি বাস। এর মধ্যে ৩৫০টি বাস থেকে যদি ১০০ টাকা করে তোলা হয়, সেই হিসাবে প্রতিদিন তোলা হয় ৩৫ হাজার, যা মাসে হয় সাড়ে ১০ লাখ ও বছরে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সড়কে পুলিশের টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমরা অবগত নই। এ বিষয়ে গাড়ির কোম্পানিগুলো ভালো বলতে পারবে। তবে চালকদের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা মালিককে জানানোর চেষ্টা করি।’
গাড়ি ঘোরানো ও গুলিস্তানের তিন পয়েন্ট থেকে ট্রাফিকের টাকা আদায়ের বিষয়ে কথা হয় ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আপনি যে অভিযোগটি দিলেন, সে বিষয়ে আসলে একটি তালিকা হওয়া উচিত। আপনি কষ্ট করে আমাদের অফিসে এসে যদি তথ্য দেন, তবে খুবই ভালো হয়। আমরা একটি তালিকা করে ওই সব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। কতিপয় পুলিশ সদস্যের জন্য এই বাহিনীর বদনাম হবে তা হতে পারে না। অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’