তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানান আলামতে টের পাওয়া যাচ্ছিল, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আগে থেকেই বুঝতে পেরে গড়ে উঠল ঢাকায় প্রথম গেরিলা গ্রুপ। দুর্ধর্ষ সেই গেরিলা গ্রুপে ছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। নাম তার জামি। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েছেন পাকিস্তানিদের হাতে, বন্দি ছিলেন দীর্ঘ সময়, ভোগ করেছেন অসহনীয় নির্যাতন, সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখী হয়েও একসময় মুক্তিও পেয়েছিলেন। আর মুক্তি পাওয়া মাত্রই দেশপ্রেমিক এই তরুণ ছুটলেন রণাঙ্গনে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন তপন দেবনাথ
ডাক নাম জামি। পুরো নাম জাহিদুল ইসলাম মাহমুদ। পৈতৃক নিবাস বরিশাল মুসলিম গোরস্থান রোড। বাবা ছিলেন বরিশাল বিএম কলেজের বাংলার শিক্ষক রফিক। জামির জন্ম ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি। বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন পাঠশালায় লেখাপড়া শুরু। তৃতীয় শ্রেণিতে এসে ভর্তি হলেন বিএম স্কুলে। ১০ বছর বয়সে বরিশাল থেকে চলে এলেন ঢাকায়। ভর্তি হলেন ঢাকার সেগুনবাগিচা স্কুলে। এই স্কুল থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় পাস করার পর এইচএসসিতে ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজে। আর ঢাকা কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়ই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে, কিন্তু তার আগেই ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানান কার্যকলাপে অনেকেই বুঝে ফেলেন, মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন। আর এই বুঝতে পারা কিছু তরুণ ফেব্রুয়ারি মাসেই ঢাকায় গড়ে তুললেন দুর্ধর্ষ এক গেরিলা বাহিনী। এই দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীর এক সদস্য হলেন জামি।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে এ দেশের সংস্কৃতি ধ্বংসের যে পরিকল্পনা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তান, বাঙালিরা সেটা কোনোভাবেই মেনে নেয়নি। নানাভাবে বাঙালিরা এর প্রতিবাদ করে গেছে। জামি জানাচ্ছেন-
‘১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। সকাল ১০টার সময় আমরা ৭-৮ জন মিলিত হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে। আমাদের লক্ষ্য বি.এন.আর (Bureau of National Reconstruction) যেটা কার্জন হলের পূর্ব দিকে, সেখানে ডা. হাসানুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে আরবি হরফে বাংলা লেখার গবেষণা চলছে। আমি তখন ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রের জবাবে বি.এন.আর ভবন আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় এবং আমাদের মাতৃভাষার ওপর কোনো আঘাত আমরা সহ্য করব না বলে সিদ্ধান্ত নেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে সেটাই ছিল আমাদের চরম বার্তা। বেলা ১১টার দিকে আমরা ছয়জন কার্জন হলের সামনে দিয়ে হেঁটে রাস্তা পেরিয়ে বি.এন.আর ভবনে প্রবেশ করি। অভিযানের যিনি নেতৃত্বে ছিলেন তিনি বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা একসঙ্গে পেট্রোল এবং দেশি বোমা চার্জ করি। প্রচণ্ড শব্দে আটটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পুরো ভবনে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায়। অপারেশন শেষে আমাদের মধ্যে খান নামে একজন বোমা বিস্ফোরণে ভীষণভাবে আহত হয়। তার সারা শরীরে রক্ত ঝরছিল। তোপখানা রোডের কোনায় বর্তমান বৈদেশিক মন্ত্রণালয়, প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে ছিল। সেখান থেকে অনেক পুলিশ দৌড়ে আসছে। তক্ষুনি আমি খানকে উঠিয়ে রাস্তার একটা রিকশা নিয়ে কার্জন হলের সীমানার মধ্যের রাস্তা ধরে শাহবাগের রাস্তা ধরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছেলেমেয়ে অবাক বিস্ময়ে আমাদের দেখছিল। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এমন গেরিলা আক্রমণ হয়নি। শাহবাগের সামনে থেকে রিকশা বদলিয়ে বেবিট্যাক্সি নেই। আমি জানি হাসপাতালে গেলে বিপদ। তাই আমার নিজের এলাকা পল্টনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার দেখে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিতে বলল। নিয়ে গেলাম সোজা হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। স্ট্রেচারে করে খানকে যখন ভিতরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি ওই বেবিট্যাক্সিতে বের হচ্ছিলাম, পুলিশের জিপ তখন সেখানে ঢুকছিল।’
এরপর ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান সংসদ বাতিলের ঘোষণা দিলে সে রাতেই জামি, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুসহ কয়েকজন গেরিলা মিলে সচিবালয়ে বোমা চার্জ করে এক্সটেনশন ভবনের ছাদ গুঁড়িয়ে দেন। এরপর ৭ মার্চ, রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না করায় সন্ধ্যায় জিপে করে রেডিও স্টেশনের ভেতরে বোমা ছোড়েন জামিরা। ২৭ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে সংগ্রহ করা আটটি রাইফেল, স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত চারটি বন্দুক নিয়ে জামি, শহীদ মানিক, নাসিরউদ্দিনে ইউসুফ বাচ্চু, আলী আফসার, নাট্যশিল্পী আসাদ, টুনিসহ গেরিলা গ্রুপটি বুড়িগঙ্গার ওপারে কোনাখোলায় ক্যাম্প স্থাপন করে। ১ এপ্রিল গানবোটের সাহায্যে এবং এয়াররেইড করে পাকিস্তান সৈন্যরা জামিদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। এই আক্রমণে টিকতে না পেরে জামিরা দলের কিছু গেরিলাকে কলাতিয়া বাজারে রেখে ও অস্ত্র দিয়ে, মাত্র আটটি বন্দুক নিয়ে গভীর রাতে কার্ফুর মধ্যে ঢাকায় ফেরেন।
এপ্রিল মাসে টুনি ও আলী আফসারসহ মাদারীপুর যান জামি। মাদারীপুর সদর থেকে ১০-১২ মাইল দক্ষিণ-পূর্বের একটি গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য কৃষকদের সংগঠিত করেন। ২৪ এপ্রিল মাদারীপুর থেকে ঢাকায় রওনা দেন। একাত্তরের মে মাসে জামি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ছেলে মিতু, আলী আফসার ও টুনি বঙ্গভবনের ভেতরে হাতবোমা ছুড়ে ঢাকা শহরে মারাত্মক আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। এই আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছিল কৌশল। যাতে পাকিস্তানিরা বাইরের বিশ্বকে দেশের ভিতরে চলা যুদ্ধাবস্থাকে আড়াল করতে না পারে। এরপর আজিমপুরের পাক আর্মি ট্রেনিং সেন্টারে বোমা চার্জ করেন জামি ও তার দল। ২৪ মে শান্তিকমিটির মিছিলে যে গাড়িতে চড়ে বোমা চার্জ করেন- যদিও সে বোমা বিস্ফোরিত হয়নি, তবে সেই গাড়ির চালক ধরা পড়ে যান পাকিস্তানিদের হাতে। সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু জামিসহ প্রায় সবার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। আত্মগোপনে চলে যান জামি।
এর মধ্যেই পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জামিদের বাড়িতে পুলিশ ও আর্মির হামলা হয়। জামিরা তখন থাকতেন শান্তিনগরে শিল্পাচার্জ জয়নুল আবেদিনের পাশের বাড়িতে। সেনাবাহিনীর ভয়ে মাত্র তিন দিনের নোটিসে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয় বাড়িওয়ালা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বোন, সাত ও ১৪ বছর বয়সী দুই ভাই নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান জামির মা। জামির বড়ভাই মনিরুল ইসলাম মণি তখন বরিশালে আর মেজো ভাই মঈদুল ইসলাম চুনি তখন আগরতলার মেলাগড়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণরত ছিলেন।
জামিলের এক বন্ধু বাবুলের বাবা ছিলেন আনসারের কর্মকর্তা। বন্ধুর বাবার অফিসিয়াল পিস্তল গেরিলা যুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য বাবুলকে নিয়ে খিলগাঁও সরকারি কোয়ার্টারে যান জামি। কিন্তু গেট দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আর্মির হাতে ধরা পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বাবুল দৌড়ে পালিয়ে যান। জামি ও এমরান বন্দুকসহ পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়েন।
সেগুনবাগিচায় মিলিটারি পুলিশ ক্যাম্পে টানা পাঁচ দিন জানালার শিকের সঙ্গে পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা হয় জামিকে। এর মধ্যে দুই দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জামিসহ ছয়জনকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। রাতে ১১তম ইঞ্জিনিয়াঙের কোয়ার্টার গার্ডে সারা রাত নির্যাতনের পর সকালে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হয় জয়দেবপুর রাজবাড়িতে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের পরিত্যক্ত আবাসস্থানের বন্দিশিবিরে। ওখানে প্রায় ২০০ বন্দি ছিল। কেমন ছিল সেই দিনগুলো?
জামি জানিয়েছেন-
‘প্রত্যেকি দিন সকালে কাজ করার জন্য বের করত, বাথরুমে নেওয়ার সময় ১০ জনের এক একটা লাইন দিতে হতো। তারপর ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে অথবা ডিগবাজি খেতে খেতে বাথরুমে যেতে হতো। যারা পিছিয়ে থাকত তাদের পিঠের ওপর লাঠির বাড়ি পড়ত।’
দুই মাস এরকম নির্যাতন শেষে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জামিকে ঢাকার ইন্টেলিজেন্সের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসে মেজর সাইফুল্লা খান। জামি জানান- ‘এখানে টিফিন ক্যারিয়ারের হাতলসহ একটি বাটি সবার জন্য বরাদ্দ থাকত। ওরা এটাকে মিস্টিন বলত। এর মধ্যে দুপুরে এবং বিকেলে একটু জাউ ভাত এবং লবণ ছাড়া সেদ্ধ ধুন্দুল দিত। ওই বাটি নিয়েই বাথরুমে যেতে হতো। ওই উল্টিয়ে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমাতে হতো। গুদামের মধ্যেই রাত্রিকালীন বাথরুম ছিল। নবাবপুর স্কুলের নির্মল মাস্টারকে দিয়ে পায়খানা-প্রশ্রাব পরিষ্কার করানো হতো। অত্যাচারে নির্মল স্যার পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।’
জামিসহ বন্দি ৩০ জনের কোর্ট মার্শাল শুরু হয়। বিচার শেষে জামিদের জেলে পাঠানো হয়। জেলে জামির সঙ্গে দেখা হয় রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী ইকবাল আহমেদ, আগরতলার আসামি শামসুল হক, ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে ধরে আনা হাজী মোর্শেদ, হামিদুল হক চৌধুরীর নাতি আরিফুর ইসলামসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিকের।
ইয়াহিয়া খানের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার অভিনব কৌশল হিসেবে ২৫ অক্টোবর জেল থেকে বেশকিছু বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। গেরিলা জামি মুক্তি পান। তবে শর্ত ছিল সপ্তাহে এক দিন আর্মি হেড কোয়ার্টারে হাজিরা দিতে হবে।
জেল থেকে বেরিয়েই গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন জামি। এবং আবার গেরিলা দলে যোগ দিয়ে বিজয়ের আগ পর্যন্ত অনেকগুলো লড়াইয়ে অংশ নেন।
জাহ্নবী