পায়ে পায়ে পৃথিবীর পথে । খবরের কাগজ
ঢাকা ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪

পায়ে পায়ে পৃথিবীর পথে

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬ পিএম
পায়ে পায়ে পৃথিবীর পথে

পায়ে পায়ে পৃথিবীর পথে নামলেন সাইফুল ইসলাম শান্ত। ২০২৪ সালের ২২ মার্চ সকালে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে হেঁটে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন তিনি। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৯৩টি দেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা আছে তার। ঢাকা থেকে হাঁটা শুরু করে যশোর-বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে যাবেন কলকাতা। এরপর ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তর প্রদেশ হয়ে পৌঁছাবেন দিল্লি। তারপর উজবেকিস্তান। সেখান থেকে মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান ঘুরে যাবেন মঙ্গোলিয়া। সেখান থেকে রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এশিয়ার বাকি দেশগেুলো ঘুরবেন। এশিয়া ঘোরা শেষ করে যাবেন আফ্রিকা। তারপর ইউরোপ। ইউরোপের পর উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমনের পর যাবেন অ্যান্টার্কটিকায়। সেখানেই তাঁর বিশ্ব ভ্রমণের ইতি টানবেন। এবং এ পর্যন্ত তাঁর পরিকল্পনা।

শান্তকে সহায়তা করছে বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন। কেন এই পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণ? জবাবে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরেক বিখ্যাত পর্যটক যিনি সত্তরটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন, তিনি জানান, ‘ভ্রমণের সময় যখন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন সব কিছু অনেক বেশি উপভোগ করা যায়। শেখা যায়, জানা যায় অনেক বেশি। হেঁটে ভ্রমণ সব সময়ই আনন্দের। আমাদের দেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্রাভেল তুলনামূলক কম হয়। তাই বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন দেশের যে কোনো অ্যাডভেঞ্চার ট্রাভেলের পাশে থেকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগাতে চায়। আমরা এটাও চাই, কেউ অ্যাডভেঞ্চার ট্রাভেলে আরও আগ্রহী হোক এবং তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখুক। এতে সবাই জানতে পারবে এবং ভ্রমণে অনুপ্রাণিত হবে।’

বিশ্বভ্রমণের চিন্তা কিন্তু অনেক আগে থেকেই ছিল শান্তর। সে কারণে নিজেকে তৈরিও করছিলেন কয়েকবছর ধরে। ২০২২ সালে ৭৫ দিনে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার তিন হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেন পায়ে হেঁটে। এ সময় তিনি প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৪২ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন। হাঁটতে হাঁটতেই সচেতনতা তৈরির জন্য তিনি কিছু বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে জীবন বাঁচাতে রক্তদান, প্লাস্টিক ব্যবহারে সতর্কতা এবং বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। ওই সময় স্কুলকলেজে গিয়ে এসব নিয়ে কথা বলার ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তখন স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। সে কারণে সচেতনতার কাজটি করতে পারেননি ঠিক মতো। তবে ভ্রমণের সময় প্রতিটি জেলার মাটি সংগ্রহ করেছেন। সেই থেকে তিনি ‘হাঁটাবাবা’ হিসেবে পরিচিতি পান।

এ ছাড়া ওই বছরেই তিনি ৬৪ দিনে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার হেঁটে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে ভারতের সান্দাকফু ও দার্জিলিং ভ্রমণ করেন। তাঁর হাঁটাহাটির শুরু ২০১৬ সাল থেকে। ২০১৮ সালে বান্দরবানের আলীকদম হয়ে বাড়ি ফেরেন ১০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে।  কিন্তু এই বিশ্বভ্রমণের বিশাল খরচ কিভাবে মেটানো হবে, সেটার কথাও জানিয়েছেন শান্ত। হেঁটে বিশ্বভ্রমণ হলেও থাকা-খাওয়ার জন্য খরচ তো আছে। সেই খরচের টাকা তিনি স্পন্সরের মাধ্যমে জোটাবেন। এবং এর মধ্যেই হাজার খানেক ডলারও পেয়েছেন।

এ ভ্রমণ শেষ করতে তাঁর বারো বছরের বেশি সময় লাগবে। অর্থাৎ তিনি ২২ বছরের তরুণ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেন। আর যখন বিশ্বভ্রমণ শেষ হবে তখন তিনি ৩৪ বছরের যুবক হয়ে যাবেন।

শান্তর প্রয়োজনীয় জিনিস থাকবে তার পিঠে থাকা প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ব্যাগের মধ্যে। তবে একটা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বিশ্বভ্রমণে যাচ্ছেন শান্ত। সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে শান্ত বলেন, ‘আমার এই বিশ্বভ্রমণের স্লোগান হচ্ছে “গাছ বাঁচান, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমিয়ে আনুন”। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং সমগোত্রীয় দেশগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলায় সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে আমি এটিকে আমার বিশ্বভ্রমণের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করেছি। আর তাই ভ্রমণের সময় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কমিউনিটি ও স্কুল-কলেজে পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগানো এবং গাছ সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে চাই।’

সাইফুল ইসলামের জন্ম ১৯৯৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তার বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম এবং মায়ের নাম করুণা বেগম। তাদের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সাইফুল মেজো সন্তান। তিনি ঢাকার দনিয়া কলেজ থেকে ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণ করেন মো. ওসমান গনি। পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে ইরান তারপর দীর্ঘ ৭ বছরে একের পর এক ২২টি দেশ ও ২১ হাজার মাইল পথ পায়ে হেটে সফর করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববাসিকে।

 

আর্থার ব্লেসিত

আর্থার ব্লেসিত ছিলেন ধর্মপ্রচারক। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ ও মানুষ বসবাসকারী প্রত্যেক দ্বীপে পা রাখার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করেন তিনি। ২০০৮ সালের ১৩ জুন তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছান। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লেখান ‘দীর্ঘ তীর্থ যাত্রী’ হিসেবে। তিনি পিা রাখেন ৩২১টা রাষ্ট্রে, যার মধ্যে দ্বীপ, অঞ্চল এবং এমন দেশও ছিল যেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং প্রায় ৫৪টা এলাকায় যদ্ধ চলছিল। সবমিলিয়ে তিনি ৩৮ বছর, পাঁচ মাস ২০ দিন হেঁটে অতিক্রম করেন ৬৫ হাজার ৩১৯ কিলোমিটার বা ৪০ হাজার ৫৮৭ মাইল পথ।


জাঁ বিলিভিউ

টানা এগার বছর ১ মাস ২৯ দিন হেঁটে ৭৫ হাজার কিলোমিটার বা ৪৭ হাজার মাইল পথ পাড়ি দেন জাঁ বিলিভিউ। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট কানাডার মন্ট্রিয়ল থেকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। তাঁর এই হাঁটার লক্ষ্য ছিল শিশুদের জন্য শান্তিপূর্ণ বিশ্ব। উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড হয়ে শেষে কানাডায় ফেরেন জাঁ।

টম টুরকিচ

পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণকারী টম টুরকিচ। ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল নিউ জার্সির হ্যাডন টাউনশিপের নিজের বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে ২০২২ সালের ২১ মে যাত্রা শেষ করেন টুরকিচ। সাত বছর ১ মাস ২০ দিনে তিনি ৪৫ হাজার ৬১ কিলোমিটার বা ২৮ হাজার মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফেরেন। একমাত্র অস্ট্রেলিয়া বাদে তিনি সবগুলো মহাদেশে পা রাখেন। ২০১৫ সালের আগস্টে টেক্সাসের অস্টিন থেকে একটি অস্ট্রেলিয়ান শেফার্ড কুকুর তার সঙ্গী হয়। তিনি কুকুরটা নাম রাখেন সাভানাহ। এরপর থেকে টুরকিচের ভ্রমণের পুরো সময়টা সাভানাহ ছিল তার ভ্রমণসঙ্গী। এর মাধ্যমে প্রথম কুকুর হিসেবে বিশ্বভ্রমণের গৌরব অর্জন করে সাভানাহ।


ফিয়োনা ক্যাম্পবেল


পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণকারীর মধ্যে তৃতীয় এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম ফিয়োনা ক্যাম্পবেল। ১৯৮৫ সালের ১৭ আগস্ট নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস পর্যন্ত হেঁটে যান। এরপর অসুস্থতার কারণে তিনি যানবাহন ব্যবহার করতে বাধ্য হন। এরপর আবার হাঁটা শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে পার্থ পর্যন্ত হেঁটে যান। এরপর তিনি আফ্রিকার এ মাথা থেকে ও মাথা অতিক্রম করার জন্য পাড়ি দেন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে মরক্কোর ট্যাঙ্গিয়ারস পর্যন্ত। ১৯৯৪ সালের ১৪ অক্টোবর তিনি হাঁটা শেষ করেন। ৯ বছর ১ মাস ২৮ দিন হেঁটে তিনি পাড়ি দেন ৩২ হাজার ১৮৬ কিলোমিটার বা প্রায় ২০ হাজার মাইল পথ।

জাহ্নবী

 

কৃষিজীবীদের সেবায় হাফসা তাসনিম

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
কৃষিজীবীদের সেবায় হাফসা তাসনিম
চলছে তরমুজ চাষিদের প্রশিক্ষণ

সুন্দরবনের বানিশান্তা উইনিয়নের ঢাংমারী গ্রামের বাসিন্দাদের নানান রকম পেশা। মাছধরা, মধু সংগ্রহ, গোলপাতা সংগ্রহ ইত্যাদি। তবে এগুলো মৌসুমি পেশা। তাদের মূল পেশা কৃষি। এই কৃষিজীবী মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন হাফসা তাসনিম। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সুলতানা লাবু

দীর্ঘদিন ধরে হাফসা তাসনিমের বড় বোন জেলে এবং মৌয়ালদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সেখানকার পর্যটন এলাকার উন্নয়নেও তিনি এবং তার পরিবারের অনেক সদস্য বড় বোনকে সহযোগিতা করে আসছেন। যেমন শিশুদের পাঠশালা, নারীদের জন্য দরজির স্কুল ইত্যাদি। উদ্দেশ্য গ্রামের মানুষগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। কাজ করতে গিয়ে এই তরুণী দেখলেন মধু সংগ্রহ বা মাছ ধরা তাদের মৌসুমি পেশা। মূল পেশা কৃষি। দুই বছর ধরে কৃষকরা এই অঞ্চলে তরমুজ চাষ শুরু করেছেন। কিন্তু চাষপদ্ধতির অভিজ্ঞতার অভাবে কৃষকরা লাভবান হচ্ছিলেন না। বরং পর পর দুই বছর তাদের ক্ষতি গুনতে হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় সরকারি সেবাগুলোও তারা পাচ্ছিলেন না। এমনকি সেই সেবা সম্পর্কে তারা কিছু জানেনও না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো জানেন। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ এলাকার কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করলে খুব সহজেই তারা লাভবান হতে পারেন। যে কাজটি করার জন্য সরকারের অনেক বেশি লোকোবল প্রয়োজন, সময় প্রয়োজন।

শিক্ষার্থীরা কিছুটা সময় আর মনোযোগ দিলে কাজটি সহজেই হয়ে যায়। শুধু প্রয়োজন একটু ইচ্ছাশক্তি। প্রন্তিক কৃষকদের দুর্দশা দেখে এমনই চিন্তা এল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফসা তাসনিমের। তখনই এই তরুণীর মনে হলো কৃষির ছাত্রী হিসেবে কৃষকদের সাহায্য করা তার দায়িত্ব।

ঢংমারীর তরমুজ ক্ষেত

 

উৎসাহী চার-পাঁচজন বন্ধু নিয়ে হাফসা তাসনিম একটি টিম গঠন করলেন। তারপর কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগুলোকে কাজে লাগিয়ে পৌঁছে গেলেন কৃষকদের কাছে। কৃষিবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ফারমার ফিল্ড স্কুল। কয়েক দফায় ফারমার ফিল্ড স্কুলের কাজটি করে বের করলেন কৃষকরা কী কী সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কী কারণে তারা মুনাফা অর্জন করতে পারছেন না। কিংবা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসলটি ঘরে তুলতে পারছেন না। কৃষকদের প্রত্যাশাগুলোসহ তাদের সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধানের তালিকা করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তরুণদের এই উদ্যোগে শিক্ষকরাও খুব আগ্রহ প্রকাশ করলেন। শিক্ষকদের পরামর্শে সেখানকার মাটি পরীক্ষা করা হলো। কতটুকু সার দরকার এবং কীভাবে পরিচর্যা করতে হবে তাও নির্ধারণ করা হলো। সেই পরামর্শগুলো শিক্ষার্থীরা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিলেন। এতে কৃষকরা লাভবান হতে থাকল।

তরমুজ চাষে কৃষকরা নতুন এবং অনভিজ্ঞ ছিল বলে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করেছিল। এবং দুই বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তাছাড়া বাজারজাতকরণের সিন্ডিকেট সমস্যা তো ছিলই। সিন্ডিকেট নিয়ে শিক্ষার্থীদের কিছুই করার ছিল না। তাই উৎপাদন খরচ কমানোর কাজেই কৃষকদের সহযোগিতা করতে লাগলেন। একে তো প্রত্যন্ত অঞ্চল তার ওপর বারবার যাওয়া-আসার খরচ সামলানো শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই যোগাযোগ করলেন সেখানকার অ্যাগ্রিকালচার অফিসারদের সঙ্গে। পাশাপাশি শিক্ষকদের সহযোগিতায় এমন একটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন যারা কৃষকদের নিয়ে কাজ করে। এনজিওর কাছ থেকে তরমুজ চাষিরা প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় সহযোগিতা পেল। এবং তরমুজ চাষের জ্ঞানার্জন করে লাভের মুখ দেখতে শুরু করল। সুন্দরবন এলাকার তরমুজ চাষিদের সফলতা তরুণী হাফসা তাসনিমকে আরও উৎসাহী করে তুলেছে। সারা বাংলার কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। সারা দেশে তিনি এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চান যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় কৃষকদের সমস্যাগুলো সরেজমিন আইডেনটিফাই করবে। এবং তাদের সহায়তা করবে। শিক্ষার্থীরা অন্তত যোগাযোগগুলোকে যুক্ত করে দিলেও কৃষকরা অনেক বেশি লাভবান হবেন।

মানুষের সেবায় নিজেকে সব সময় নিয়োজিত রাখতে চান তিনি। কারণ ছোটবেলা থেকেই বড় বোন আঁখি সিদ্দিকা তাকে শিখিয়েছেন জীবনের প্রতিটি সময়কে সততার সঙ্গে সঠিকভাবে এবং প্রডাক্টটিভলি ব্যবহার করা উচিত; যা অন্য মানুষের কল্যাণে আসবে। তাহলেই চিরকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সম্ভব। কারও উপকার করলে অবশ্যই তার মনে এবং মস্তিষ্কে স্থান পাওয়া যায়। এই অনুপ্রেরণা হাফসা তাসনিমকে সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে সহায়তা করেছে। ২০১৯ সাল থেকে এই তরুণী কখনো ত্রাণ কার্যক্রম, কখনো পরিবেশ সচেতনতা ক্যাম্পেইন, কখনো বৃক্ষরোপণ, কখনো কৃষকদের সহযোগিতা করা, কখনো গ্রামীণ নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের কাজে নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন।

ঘরে আবদ্ধ না থেকে করোনাকালীন মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সুন্দরবন, খুলনা শহর, কয়রা উপজেলা এবং খুলনার বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে মাস্ক পরার সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করেছেন।

এ ছাড়া আত্মরক্ষা বা সেল্ফ ডিফেন্সের একটি প্রোগ্রামে বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় পরিচালনার কাজ করেছিলেন। সেখানে বয়সন্ধিকালীন মেয়েরা বা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা সাত দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ নিতে পারে। প্রশিক্ষণটির মাধ্যমে মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা হয়। যাতে যেকোনো ধরনের বিপদ থেকে মনোবল দিয়ে মেয়েরা নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তিনি এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। হাফসা তাসনিম কৃষি অনুষদ থেকে এ বছর গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। এবং ক্রপ বোটানি ডিপার্টমেন্টে এমএসসি করছেন। তিনি চান প্রতিটি দিন বা প্রতিটি বছর মানুষের কল্যাণে যেন কিছু না কিছু করা যায়।

জাহ্নবী

 

প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলো

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলো
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে তন্ময় আলমগীর

আশপাশের গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জের নামাপাড়া গ্রামে ছিল না কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানকার ছেলেমেয়ারা শিক্ষা ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে। আধুনিক বিশ্বের মানানসই নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। এই তাগিদ অনুভব করে গ্রামের এক স্বপ্নবাজ তন্ময় আলমগীর সুধীজনের পরামর্শ ও সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুল।

তরুণ লেখক তন্ময় আলমগীর কর্ম জীবনে বাংলায় শিক্ষকতা করেছেন, চাকরি করেছেন দেশের বিভিন্ন পত্রিকায়। সবশেষ করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করলে একটি দৈনিক পত্রিকার চাকরি ছেড়ে কিশোরগঞ্জ ফিরে স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন তিনি। সবার সাহস এবং উৎসাহে স্থাপিত হয় স্বপ্নের বিদ্যালয়।

‘আধুনিক ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে’ নামাপাড়া গ্রামের মলাই ফকির বাজারে স্থাপিত জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুলের শুরুটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দিয়েই। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি বই উৎসবের মাধ্যমে যাত্রা শুরু। প্রারম্ভিক যাত্রায় প্লে গ্রুপ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ১০৫ শিক্ষার্থী নিয়ে এই স্বপ্নের আলোকিত অধ্যায়ের শুরু। পর্যায়ক্রমিক শ্রেণি বৃদ্ধির মাধ্যমে গত বছর সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ১৩৫ শিক্ষার্থী ছিল এই বিদ্যালয়ে। সংশ্লিষ্টরা স্বপ্ন দেখে জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুল এক দিন কলেজে রূপান্তরিত হয়ে দ্যুতি ছড়াবে এই গ্রামে।

একদল দক্ষ ও শিক্ষিত মানুষের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ। যোগ্য ও মানসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করা হয়। শিক্ষক স্থানীয় হওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রতি পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন। শিক্ষার মান যাচাইয়ে নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে এবং অভিভাবকদের অবগতির বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয় স্কুল থেকে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তন্ময় আলমগীর
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তন্ময় আলমগীর

 

জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুলে প্রভাতি ও দিবা দুই শিফটে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিনা কারণে শতভাগ উপস্থিতি না থাকলে পরবর্তী পরীক্ষায় বসতে পারে না শিক্ষার্থীরা। শুধু তত্ত্বীয় মূল্যায়ন নয়, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হলেও প্রতি পরীক্ষার পাশাপাশি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক মূল্যায়ন ও আচরণসংক্রান্ত মূল্যায়নেরও ব্যবস্থা রয়েছে। সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকে উৎসবের আমেজ। এদিন নাচ, সংগীত চর্চা, অভিনয়, আবৃত্তি, সুন্দর হাতের লেখা, খেলাধুলা ইত্যাদি সৃজনশীলতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া হয়। স্কুলে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক জাতীয় উৎসবসহ বিভিন্ন বিশেষ দিবস শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পালন করা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছোট পরিসরে পাঠাগারও রয়েছে।

এই বিদ্যালয়টি যেভাবে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে এতে দিন দিন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। বিদ্যালয়ে আরও নতুন শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন সময়ের দাবি। শিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপিত পাঠাগার আরও সমৃদ্ধ হবে শিশু-কিশোর বইয়ের সমারোহে। এসব সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রয়েছে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের। তারা স্বপ্ন দেখছেন মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে। দোরগোড়ায় এমন পড়াশোনার সুযোগে পেয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকের পাশাপাশি এলাকার সচেতন মানুষও সন্তুষ্ট। এভাবে আলো ছড়িয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটে তন্ময় আলমগীরের মতো স্বপ্নবাজ যুবকরা।

জাহ্নবী

তারুণ্যের সংকেত

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
তারুণ্যের সংকেত

টিনএজারদের নিজস্ব কিছু ভাষা আছে। এসব ভাষা আবার হাতের ইশারায়, নানান ভঙ্গিতে প্রকাশ পায়। তেমনি কিছু হাতের ভাষা

মুষ্টি বাম্প
এটা একটা ক্ল্যাসিক সংকেত। দুটো মুঠো যখন বাম্প করে তখন এটাকে বন্ধুত্বের অভিবাদন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আবার কোনো কিছু জয় করার অর্থও বোঝাতে পারে। একই সঙ্গে হতাশা কাটিয়ে ওঠার সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। মোট কথা এটা একটা সুখের এবং খুশি হওয়ার সংকেত।

শেফস কিস
সাধারণত মুখরোচক কোনো খাবার, কিংবা কোনো দারুণ প্রাপ্তির পর এরকম সংকেত দেখানো হয়। এই সংকেত যে কোনো কিছুর বেলাতেই দেখানো যেতে পারে।

এল
এভাবে এল দেখানো মানে, লুজার। একে অপরকে এটা দেখানোর মানে হলো তুমি পরাজিত। আর এর সঙ্গে যদি চোখে মুখে অন্যরকম অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, সেটা পরাজিতকে আরও বেশি করে উসকে দেওয়া।

জাহ্নবী

তারুণ্যের গর্ব শেখ জামাল

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২৩ পিএম
তারুণ্যের গর্ব শেখ জামাল

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় সন্তান শেখ জামাল ছিলেন কিশোর বয়সী। কিন্তু তার ছিল ভীষণ দুঃসাহস। ২৮ এপ্রিল শেখ জামালের জন্মদিন। তার সম্পর্কে জানাচ্ছেন আহমেদ রিয়াজ

বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে কম আলোচিত যে নাম, সে নাম হচ্ছে শেখ জামাল। ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম। জন্মের ঠিক ১২ দিন পর ১৯৫৪ সালের ১০ মে বাবা শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বাবা মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে পুরো পরিবার তখন মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে এসে ওঠে। কিন্তু সৌভাগ্যের অপর পিঠেই লুকিয়ে ছিল দুর্ভাগ্য। ওই বছরই ৩১ মে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পরপরই গ্রেফতার হয়ে যান শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় তিনি সাত মাস জেলে বন্দি ছিলেন।

একেবারে মায়ের কোলের বয়স থেকেই অন্য ভাইবোনদের মতো বাবার জেলজীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন জামাল। মায়ের কোলে চড়ে মাঝে মাঝে বাবাকে জেলখানায় দেখতেও যেতেন। জেলবন্দি বাবার কাছ থেকে খুব একটা আদর-স্নেহও পাননি। তবে বাবাকে নিয়ে তার ছিল ভীষণ রকম গর্ব। কারণ তার বাবাই তো নেতৃত্ব দিয়ে পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর এই স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেও অংশ নিলেন সরাসরি।

পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে রাখল ধানমন্ডির ২৬ নম্বর সড়কের ১৮ নম্বর (বর্তমানে ৯এ) বাড়িতে। ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট কিশোর শেখ জামাল সেই বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার বয়স তখন ১৭ বছর তিন মাস। তার পরিবারের কেউ, কিংবা পাহারাদার শসস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্য- কেউই আগে থেকে তার পালিয়ে যাওয়াটা টের পায়নি। বেশ কিছুদিন থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। আর সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারকাঁটার বেড়া দেওয়া বাড়ি থেকে কিশোর শেখ জামাল পালিয়ে গেলেন।

ওই বাড়িতে তখনো বন্দি মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বড় বুবু শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা, ছোটভাই শেখ রাসেল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাবা শেখ মুজিবকে বন্দি করে নিয়ে যায়। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়ি আক্রমণ করার ঠিক আগে আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান বড় ভাই শেখ কামাল। তারপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ কামাল ছিলেন মুক্তিবাহিনির কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি।

বড় ভাই শেখ কামালের বয়স তখন ২২ বছর। আর শেখ জামালের আঠারোও হয়নি। তাতে কী! মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অদম্য এক সংকল্প করে রেখেছেন শেখ জামাল। মাকে বলে যাননি। কারণ বলতে গেলে যদি বয়স কম হওয়ার যুক্তিতে অনুমতি না মেলে!

ভাইবোনদের মধ্যে বেশ চাপা স্বভাবের ছিলেন শেখ জামাল। সহজে মনের কথা প্রকাশ করতেন না। সবসময় বই নিয়ে পড়ে থাকতেন। প্রচণ্ড বইপড়ুয়া ছিলেন।

নিরুদ্দেশের পরই শুরু হয়ে গেল তার খোঁজাখুঁজি। খোঁজ না পেয়ে মায়ের সন্দেহ হলো পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর। কদিন ধরে ওদের হাবভাবও ভালো ঠেকছিল না। ওরা শেখ জামালকে গুম করে দেয়নি তো! পাকিস্তানিদের বিশ্বাস নেই। নিরীহ মানুষদের ওপর যারা রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলি চালায়, তাদের কে বিশ্বাস করবে? পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছেলে শেখ জামালকে অপহরণের অভিযোগ তুললেন মা। পুরো বিশ্বে সে খবর প্রচার হলো। বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো শেখ জামালের নিখোঁজ হওয়ার খবর।

ততদিনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছে গেছেন কিশোর শেখ জামাল। তারপর আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছে গেলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। যোগ দিলেন মুজিব বাহিনীতে। ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ নিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে চলে গেলেন রণাঙ্গনের ৯ নম্বর সেক্টরে।

শেখ জামালের খবরটা তখন কৌশলগত কারণে চেপে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। এই ইস্যুতে প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের তীব্র চাপে আন্তর্জতিক অঙ্গনে বেশ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় কিছু মুক্তিযুদ্ধের ছবি ছাপা হয়। তেমনি একটি ছবিতে সীমান্তের দশ মাইল ভিতরে একটি রণাঙ্গনে সাবমেশিনগানধারী এক কিশোরকে দেখা যায়। সেই কিশোরই ছিলেন শেখ জামাল। সেই ছবিতে কোনো কিশোরের মুখায়ব নয়, ফুটে উঠেছিল সংকল্পবদ্ধ দুঃসাহসী এক মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি।

স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরলেন ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তাকে পেয়ে সেদিন মা আর ভাইবোনদের কী যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস!

শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। খুব ইচ্ছের কারণে গিটার শিখতে ভর্তি হলেন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া ক্রিকেটও খেলতেন নিয়মিত। হয়তো গিটারিস্ট বা ক্রিকেটার হতেন। কিন্তু ছায়ার মতো তার সঙ্গী ছিল দুঃসাহস। সেই দুঃসাহসের পালে হাওয়া দিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন মার্শাল টিটো। আলাপচারিতায় শেখ জামাল জানালেন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান। সঙ্গে সঙ্গে মার্শাল টিটো তাকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। দুই মাস পরই ১৯৭৪ সালে বসন্তে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন শেখ জামাল। কিন্তু ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভাষাগত সমস্যার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। মার্শাল টিটো তাকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণের পরামর্শ দেন। ১৯৭৪ সালের শরতে লন্ডনে এলেন শেখ জামাল। কিন্তু সরাসরি স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেন না। তার আগে ব্রিটেনের আর্মি স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ, বেকসফিল্ড থেকে কিছু পূর্ব প্রশিক্ষণ নিতে হলো। তারপর স্যান্ডহার্স্টের শর্ট সার্ভিস কমিশনে ছয় মাসের সুকঠিন গ্রাজুয়েট কোর্স করেন।

১ আগস্ট থেকে স্যান্ডহার্স্টে নিয়মিত ক্যারিয়ার কোর্সের সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাননি শেখ জামাল। কারণ তার প্রিয় দুই বন্ধু দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাছাড়া অনেকদিন মায়ের সান্নিধ্য থেকেও বঞ্চিত। মাকে না দেখে কতদিন থাকা যায়! মা যে তার খুব প্রিয়।

ফিরে এলেন ঢাকায়। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পোস্টিং হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। কোম্পানি অফিসার হিসেবে শুরু হলো রেজিমেন্টজীবন।

প্রায় দেড় মাসের পেশাদার সৈনিক জীবন পেয়েছিলেন শেখ জামাল। তবু এই সামান্য সময়েও পেশাগত দক্ষতা ও কাজের প্রতি ভীষণ রকম আন্তরিক ছিলেন। ইউনিট মাঠে সৈনিকদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলেন, বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। সন্ধ্যায় সৈনিকদের সঙ্গে মেসে রাতের খাবার খান। রাষ্ট্রপতির সন্তান হিসেবে আলাদা কোনো সুযোগ কখনো নেননি। বরং নিজের টাকায় কোম্পানির সৈনিকদের জন্য উন্নতমানের প্লেটের ব্যবস্থা করেন। মায়ের নির্দেশে, গাড়িতে করে নয়, অন্য তরুণ অফিসারদের মতো মোটরসাইকেলে করে ক্যান্টমেন্টে যাতায়াত করতেন।

১৪ আগস্ট ১৯৭৫। ক্যান্টমেন্টে না গিয়ে, মায়ের অনুরোধে রাতে বাসায় থেকে গিয়েছিলেন শেখ জামাল।

১৫ আগস্ট ভোররাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সে বাড়িতে উপস্থিত পরিবারের সবাই বিশ্ব ইতিহাসের এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। মাত্র ২১ বছর তিন মাস ১৮ দিন বয়সী শেখ জামালও।

শেখ জামালের দুঃসাহস ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে-পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। তার দুঃসাহস তারুণ্যের গর্ব।

জাহ্নবী

‘শিক্ষামন্ত্রী’ রজব

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২১ পিএম
‘শিক্ষামন্ত্রী’ রজব

শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছে রজব। না, বাংলাদেশ সরকারের নয়, আসন্ন যুব সংসদ অধিবেশনে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দেখা যাবে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নোয়াখলা গ্রামের কিশোরী তারফিনা শাহানাজ রজবকে। ধ্রুবতারা যুব উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আয়োজনে যুব সংসদ অধিবেশন বসছে ১ জুন, চট্টগ্রামে। 

নোয়াখালী সরকারি কলেজে ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে সম্মান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রজবের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন চিত্রাঙ্কন, উপস্থিত বক্তৃতা ও লেখালেখির প্রতি দারুণ আকর্ষণ ছিল। হাইস্কুলে এসে উপস্থিত বক্তৃতায় তার কাছ থেকে কেউই প্রথম পুরস্কার নিতে পারেনি। বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও ছিল দারুণ প্রাণবন্ত। উচ্চমাধ্যমিকে থাকাকালীন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উপজেলা চ্যাম্পিয়নসহ ২০১৮ সালের সৃজনশীল মেধায়ও সে উপজেলা চ্যাম্পিয়ন হয়। পরবর্তী সময়ে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দুবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে লড়ার টিকিটও নিশ্চিত করে। সেখান থেকেই যুব সংসদে শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ পায় রজব।

রজব একাধারে একজন বিতার্কিক, বক্তা, স্ক্রিপ্ট রাইটারই নয়, এর বাইরে সে মানবিক ও সমাজকর্মী। তার সহপাঠীদের অনেকেই যেখানে স্বামীর সংসার সাজানোয় মনোযোগী, সেখানে সে তার চারপাশের অসহায় মানুষগুলোর জীবন সাজানোর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। সপ্তম শ্রেণি থেকেই টিউশনি, কোচিং করিয়ে নিজের খরচ নিজেই জোগানোর পাশাপাশি আয়ের একটা অংশ গরিব-অসহায়দের জন্য ব্যয় করে আসছে। তার উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে- শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই সরবরাহ, আশপাশের হতদরিদ্রদের খাবার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, ঈদসামগ্রী বিতরণ, বিধবাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলায় উদ্যোগী, বাল্যবিবাহ রোধে প্রশাসনকে সহযোগিতা করা, সামাজিকভাবে রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণ, মাদকবিরোধী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, যৌতুক প্রথা নির্মূলে ভূমিকা, আর্সেনিক বিষয়ে বিভিন্ন কার্যক্রমসহ তৃণমূল নারীদের জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণে পাঠানো ও সার্বিক সহযোগিতায় ভূমিকা রাখা।

রেডক্রিসেন্টের উপজেলা কো-অর্ডিনেটর থাকাকালীন তার সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবার নজরে আসতে শুরু করে। বর্তমানে চাটখিল ব্লু ফোরাম, অক্ষরদান ফাউন্ডেশন ও অধিকারকর্মী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকে পাওয়া উপহার পৌঁছে দেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় মানুষগুলোর কাছে। তার কাছে যখনই কোনো অসহায় মানুষের চাহিদা বা আবদার আসে, নিজে মেটাতে না পারলে ফেসবুকে পোস্ট শেয়ারের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। তাতে সাড়াও মেলে।

রজব নোয়াখালী জেলা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট এলায়েন্সের কো-অর্ডিনেটর, জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২০ পাওয়া সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ আর্মি’-এর নোয়াখালী ডিস্ট্রিক্ট লিডার, ঢাবির দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. রেবেকা সুলতানার SASK-এর জেলা কো-অর্ডিনেটর এবং কিশোর-কিশোরী ক্লাব চাটখিলের আবৃত্তি প্রশিক্ষক।

নানা প্রতিকূলতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে একজন কিশোরী হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে মানুষের পাশে দাঁড়ানো কীভাবে সম্ভব- জানতে চাইলে রজব জানায়, আমি আমার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ। বন্ধুদের কাছে যখন যেভাবে সাহায্য চেয়েছি কেউ কখনো হতাশ করেনি। রাজনীতিতে এসে সেবার হাতকে শক্তিশালী করার ইচ্ছা আছে কি না- এমন প্রশ্নে হেসে উঠে রজবের জবাব, ‘কারও সেবা করা কিংবা পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থাকলে রাজনীতিতে আসা বা নেতা হতে হবে কেন? যার যার অবস্থান থেকেই যে কারও পাশে দাঁড়ানো সম্ভব।’ বিসিএস পরীক্ষার পর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে গণমানুষের সেবা করার স্বপ্ন দেখে প্রচারবিমুখ মানবিক রজব।

জাহ্নবী