
শৈশবে প্রিয়তা করিম (ছদ্মনাম) দেখতে নাদুস-নুদুস হওয়ায় আদর করে তাকে কোলে তুলে নিতেন স্বজনরা। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পরও স্বাস্থ্য না কমায় এবার তার সুস্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু করেন পরিবার-পরিজন। আবার আয়নায় নিজেকে স্বাস্থ্যবান দেখে হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করে সে নিজেও। একসময় প্রিয়তা শুরু করে কঠোর ডায়েটিং। ক্রমেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওজন কমতে থাকে তার। দেখা দেয় অনিয়মিত ঘুম, শারীরিক দুর্বলতা। কিন্তু সে লক্ষ করে, একসময় খেতে ভালোবাসলেও এখন খাবারের প্রতি তার তৈরি হয়েছে তীব্র অনীহা। প্রিয়তার মতোই বিভিন্ন কারণে কিশোর-কিশোরীদের দেখা দেয় খেতে না চাওয়ার এই রোগ ইটিং ডিজঅর্ডার বা আহার ব্যাধি।
আহার ব্যাধি কি
খাবার খাওয়া নিয়ে বিপত্তি হলেও আহার ব্যাধি মূলত একটি মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ কেউ বেশি খায়। কারও আবার তৈরি হয় খাবারের প্রতি চরম অনীহা। বিভিন্ন কারণে খাবার নিয়ে আমাদের আবেগ, চিন্তা ও খাদ্যাভ্যাসের আচরণের পরিবর্তনই হলো আহার ব্যাধি। যেকোনো বয়সেই মানুষ আহার ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে সারা বিশ্বেই কিশোর-কিশোরী ও নবীন তরুণদের মধ্যে আহার ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি।
কৈশোরে কেন হয়
আধুনিক খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপীই কিশোর-কিশোরীদের আহার ব্যাধির বেড়েই চলছে। আমাদের দেশেও আহার ব্যাধিতে আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা কম নয়।
কৈশোরে আহার ব্যাধির অন্যতম কারণ সামাজিক ও পরিবেশগত চাপ। কিশোর-কিশোরীরা স্বভাবতই নিজেদের সৌন্দর্য নিয়ে বেশি সচেতন এবং আবেগপ্রবণ থাকে। সামাজিক মাধ্যম এবং মিডিয়ায় সুন্দরের একতরফা সংজ্ঞা ভাবিয়ে তুলে স্বাস্থ্যবান টিনএজারদের। আবার শারীরিক গঠন নিয়ে বন্ধু, পরিচিতদের নেতিবাচক মন্তব্য প্রভাব খেতে চাওয়া-না চাওয়ার ইচ্ছার ওপর। খাবার খেতে গিয়ে কোনো অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা, অপমানজনক পরিস্থিতির শিকার হলেও দেখা দিতে পারে আহার ব্যাধি। এ ছাড়া ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি কিশোর-কিশোরীদের অতিরিক্ত আগ্রহ তৈরি করে অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাসের মতো আহার ব্যাধি।
আবার জিনগত কারণেও হতে পারে আহার ব্যাধি। সাধারণত পরিবারের বড় সদস্যদের মধ্যে কখনো কারও আহার ব্যাধি থাকলেও শৈশবে তার প্রভাব পড়ে না। তবে কৈশোরে পা দেওয়ার পর দেখা দিতে পারে এই জিনগত বৈশিষ্ট্য।
কিশোর বয়সে অনিয়মিত ঘুম, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, হতাশাও তৈরি করতে পারে আহার ব্যাধি। খাবার খাওয়ার সঙ্গে রয়েছে মনের সম্পর্ক। রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে কিংবা বিষণ্ন থাকলে কিশোরীদের মধ্যে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা কিংবা খাবারে অনিচ্ছা দেখা দেয়।
আবার কৈশোরের শুরুতে বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তনের সময় দেখা দেয় বিভিন্ন মানসিক সমস্যা। কোনো কিছু নিয়ে শুচিবায়ু তৈরি হলেও সেগুলো সাধারণত শৈশবের পর বয়ঃসন্ধিকালেই দেখা দেয়। এ সময় খাবার সম্পর্কিত কোনো শুচিবায়ু দেখা দিলেও হতে পারে আহার ব্যাধি।
আহার ব্যাধির ধরন
আহার ব্যাধি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে। কৈশোরে যে ধরনের আহার ব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত হয় বেশি সেগুলো জেনে নাও।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা
এই রোগে আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের শারীরিক গড়ন ও স্বাস্থ্য নিয়ে অযথাই দুশ্চিন্তা ও হীনম্মন্যতায় ভুগে। ওজন বাড়ার ভয়ে খাবার খেতে অনীহা বা একরকম শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে দিনদিন তাদের খাবারের চাহিদা কমতে থাকে।
বুলিমিয়া নারভোসা
বুলিমিয়ায় আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীরা খাবার খাওয়ার পর খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ নিয়ে অনুতাপ বোধ করে। ফলে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি করার ইচ্ছা তৈরি হয়। কেউ কেউ আবার গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করে। এই স্বভাব সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আবার অনিয়মিত ঘুম, বিষণ্নতা থেকেও খাওয়ার পর বমির উদ্রেক হয়। অনেকের এই অবস্থা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। খাওয়ার পরের এই অস্বস্তিকর অবস্থা খাবারে অনীহা বাড়িয়ে তুলে।
বিনজ ইটিং ডিজঅর্ডার
এটি হলো অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতার আহার ব্যাধি। প্রায়ই জাংক ফুড খেতে অভ্যস্ত এমন কিশোর-কিশোরীরা সাধারণত এই রোগে বেশি ভুগে। এ ছাড়া কৈশোরে আকস্মিক হরমোনাল পরিবর্তনের কারণেও অনিয়ন্ত্রিত খাবার খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
ক্ষতিকর প্রভাব
কৈশোরকাল আমাদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সময়। মানুষের জীবনের প্রায় বেশির ভাগ বিকাশই সম্পন্ন হয় এ সময়। কৈশোরে আহার ব্যাধির কারণে পুষ্টিকর ঘরোয়া খাবারেই সাধারণত বেশি অনীহা তৈরি হয়। এতে করে উচ্চতা বৃদ্ধি, হাড় ও মাংসপেশি গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। আবার এ সময় মস্তিষ্কের বিকাশের জন্যও অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়। খাদ্যে অনীহার কারণে মস্তিষ্কের বিকাশও বাধার সম্মুখীন হয়।
সমাধান ও করণীয়
আহার ব্যাধি খুব দ্রুত সমাধানযোগ্য রোগ নয়। রোগ নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তাও হিতে বিপরীত অবস্থা তৈরি করতে পারে। এ সময় বাবা-মায়েরা জোর করে খাওয়ালে বা খাবার হঠাৎ কমিয়ে দিলে মানসিক চাপ ও শারীরিক অসুস্থতা তৈরি হতে পারে। তাই নিজের ভেতর আহার ব্যাধির লক্ষণ দেখলে বাবা-মা বা পরিবারের ঘনিষ্ঠ কাউকে খুলে বলো। খেতে গেলে কি অনুভব করো তা অনুযায়ী সমাধানের পরিকল্পনা করো। পাশাপাশি একজন মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নাও। ধৈর্যের সঙ্গে আহার ব্যাধি মোকাবিলা করা সম্ভব।