প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নবীনদের গল্প, কবিতা, উপন্যাস আর অনুবাদ গ্রন্থ নিয়ে বেশ কজন নবীন প্রকাশক আলোচনায় রয়েছেন এবার বইমেলায়। প্রকাশনায় নতুন ধারার নিরীক্ষায় নবীন প্রকাশকদের অনেকে অগ্রজ কথাসাহিত্যিকদের নজর কেড়েছেন। কেউ কেউ বিষয়বৈচিত্র্যে, কেউ প্রচ্ছদে, কেউবা প্রথিতযশা লেখকদের লেখা সংগ্রহ করে বই প্রকাশ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তারা বলছেন, সেসব নতুন বইয়ে এই প্রজন্মের পাঠকদের সাহিত্যতৃষ্ণা পাবে নতুন আলোর সন্ধান।
গত ২০২২ সাল থেকে অমর একুশে বইমেলায় অংশ নিচ্ছে জলধি। প্রকাশক কবি নাহিদা আশরাফী জানান, এবারের বইমেলায় ৩০টি নতুন বই এনেছেন তারা। তিনি বলেন, ‘বছরের শুরুতে আমরা কজন লেখকের পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করব বলে সিদ্ধান্ত নিই। পাশাপাশি নবীন লেখকদের কাছেও আমরা পাণ্ডুলিপি আহ্বান করি। পরে আমরা ভালো মানের পাণ্ডুলিপি বাছাই না করি। তারপর তা সম্পাদনার টেবিলে যায়। পুরো প্রক্রিয়া শেষে যে বইটি কেবল মানসম্পন্ন হচ্ছে বলে মনে করি, তাই প্রকাশ করি। পাণ্ডুলিপি পেলেই সেটা তাড়াহুড়ো করে প্রকাশ করব, এমনটি ভাবি না কখনো আমরা। প্রয়োজনে বইমেলায় একটি বইও প্রকাশ করব না, কিন্তু মানের দিক থেকে আমরা কোনো আপস করব না।’
বইয়ের মান বিচারে ছাড় দিতে নারাজ আরেক নবীন প্রকাশক পেন্ডুলাম পাবলিশার্সের কর্ণধার রুম্মান তাশরিফ। তিনি বলেন, ‘শুধু বইমেলা কেন্দ্র করে সব নতুন বই প্রকাশ করব, এমন ভাবি না। আমি বইমেলায় খুব বাছাই করে এবার ৫টি মাত্র বই প্রকাশ করেছি। এতে আমার সেই বইগুলো বিপণন করতে সুবিধা হয়েছে। অনেক বই আনলে কোনটি ছেড়ে কোন বইটির প্রচার করতাম, তাই হয়তো ঠিক করতে পারতাম না।’
নবীন প্রকাশকদের অনেকের কবিতা, গল্প ও অনুবাদের বই প্রকাশ করছে পেন্ডুলাম। এ বছর আঞ্জুমান লায়লা নওশিন ও অরূপ রতনের অনুবাদে এই প্রকাশনী থেকে এসেছে হ্যালেন হ্যানফের ‘৮৪, চ্যারিং ক্রস রোড’। এ বইটি প্রথম সারির সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন তুলেছে। নবীন লেখকদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে রুম্মানকে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নতুন বা নবীন লেখকদের অনেকে পাণ্ডুলিপি দেওয়ার পরেই তাগাদা দিতে থাকেন, বইটি বইমেলায় কবে নিয়ে আসব। আমি কিন্তু কোনো লেখককে কথা দিই না যে বইটি বইমেলাতে আমি আনব। তারপর তাদের পাণ্ডুলিপি যখন সম্পাদকদের হাতে দিই, তখন অনেকে আপত্তি করেন কেন তাদের লেখা সম্পাদনা করতে হবে। কিন্তু সিনিয়র লেখকরা এটি করেন না। আমি মানের দিক বিবেচনায় সেটি করতে পারি না।’
প্রথমবারের মতো বইমেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠান মরিয়ম প্রকাশনী এবার ২৫টি নতুন বই প্রকাশ করেছে। এই প্রকাশনীর কর্ণধার মো. নাজমুল ইসলাম জানান, সাংবাদিকতা থেকে তিনি এসেছেন প্রকাশনীর ব্যবসায়। তিনি বলেন, ‘নবীন কবি, গল্পকারদের তুলে ধরার প্রয়াস হিসেবে আমি প্রকাশনা ব্যবসায় এনেছি। তবে এখন প্রকাশনার মূল চ্যালেঞ্জ হলো শিশু-কিশোরদের বইমুখী করা। তারা যেভাবে মোবাইলে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে, তাদের বইমুখী করতে এখন ভালো মানের বই প্রকাশ করতে হবে।’
১৯৯৯ সালে লিটলম্যাগ মাছরাঙা প্রকাশনায় সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সিলেটের আবুল কাশেম। ২০০৭ সাল পর্যন্ত সেই প্রকাশনাটি অনিয়মিতভাবে বই প্রকাশ করতে থাকে। পরে তা বন্ধ করে দিয়ে আবুল কাশেম চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। উচ্চতর পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে তিনি হাকালুকি হাওরের জলজ জীবন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, প্রাণপ্রকৃতির বৈচিত্র্য রক্ষায় নেন নানা উদ্যোগ। তখন তিনি অনুভব করেন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আলাদা করে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করবেন, পাশাপাশি প্রাণপ্রকৃতিবিষয়ক বইও বের করবেন। সে ভাবনা থেকে মাছরাঙা প্রকাশনীর যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে। এবারই প্রথমবারের মতো বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পেয়েছেন তারা।
আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা গবেষণাধর্মী যে বইগুলো বের করছি, তার হয়তো খুব বেশি পাঠক থাকবে না। সিলেটের আঞ্চলিক সাহিত্যের বইয়ের সমঝদারও হয়তো অনেক কমই হবে। কিন্তু আমার সাহিত্যের প্রতি যে দায়বোধ রয়ে গেছে, তা থেকেই আমি এ প্রকাশনীর যাত্রা শুরু করেছি। পাঠক ভালো বই খুঁজে বেড়ায় মেলায় এসে। আমি সেই ভালো বইটি করতে চাই। আর প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, আমি নবীন হিসেবে যারা ভালো লিখছেন তাদের বই প্রকাশ করতে চাই।’ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে তিনি আলাদা একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠন করেছেন বলে জানালেন খবরের কাগজকে।
তবে নবীন প্রকাশকদের অনেকে জানান, অর্থাভাবে তারা আলাদা করে সম্পাদনা পরিষদ গঠন করতে পারছেন না। নৃ প্রকাশনের পরিচালক ফয়জুস সালেহীন ভূঞা বলেন, ‘আমার লক্ষ্য যে আমি একটি ভালো সম্পাদনা পরিষদ গঠন করব। কিন্তু অর্থাভাবে তা করতে পারছি না। আপাতত প্রুফ রিডার যারা রয়েছেন, তাদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।’
ফয়জুস সালেহীন জানালেন আরেকটি সংকটের কথা। নবীন প্রকাশকদের অনেকে একেবারে নতুন লেখকদের বই বেশি প্রকাশ করছেন। তবে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বইয়ের মতো প্রচার নবীন লেখকরা পান না। তিনি বলেন, নবীন লেখকদের প্রচারের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আমরা কিছু বই তো প্রচারে আনতে পারি। কিন্তু সেটা আমরা করছি না। এতে নবীন লেখকটি যেমন প্রচার পান না, তেমনি আমরা যারা নতুন বই করছি তারাও কিন্তু ব্যবসায় পিছিয়ে থাকছি।’
একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত থাকার পরে নিজে আলাদা একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন জাহিদ খান। অস্তিত্ব নামে তার সেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি বইমেলায় অংশ নিচ্ছে ২০২২ সাল থেকে। এ বছর হায়দার আকবর খান রনোর লেখা শহীদ আসাদের জীবনী আর ধ্রুব এষের গল্প-উপন্যাসের তিনটি বই এনে বইমেলায় আলোচনায় রয়েছে প্রকাশনীটি। জাহিদ খান বলেন, ‘এ বছর নতুন বই করেছি মাত্র ৫টা। আমি আসলে একটু রয়েসয়ে এগোতে চাই। ভালো বই প্রকাশ করতে পারলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তাই একটি শক্তিশালী সম্পাদনা পরিষদ গঠন করব আগে, তারপর আমি একে একে গল্প, উপন্যাস আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রচনার দিকে নজর দেব।’
মেলার নানা আয়োজন
বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার মূলমঞ্চে ছিল ‘স্মরণ: মুনীর চৌধুরী এবং স্মরণ: হুমায়ুন আজাদ’ শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে অধ্যাপক ফিরোজা ইয়াসমীন এবং অধ্যাপক হাকিম আরিফ। আলোচনা করেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম, অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক, ওসমান গনি এবং মৌলি আজাদ। সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কাজী জাহিদুল হক সংকলিত এবং ঐতিহ্য প্রকাশিত মুনীর চৌধুরীর দুষ্প্রাপ্য রচনা বই উন্মোচনে অংশ নেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ফেরদৌসী মজুমদার, প্রাবন্ধিকদ্বয়, আলোচকবৃন্দ, বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার এবং গ্রন্থটির সম্পাদক কাজী জাহিদুল হক।
বুধবার লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান, কবি তারিক সুজাত, কথাসাহিত্যিক সমীর আহমেদ এবং শিশুসাহিত্যিক আবেদীন জনি।