আমাদের বইমেলাটা আসলে যেমন ছিল, সেই মেলাটা ছিনতাই হয়ে গেছে। আমাদের বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদ থাকতেন, হুমায়ুন আজাদ থাকতেন, তাদের বই মানুষ লাইন দিয়ে কিনত। আজকে কী দেখছি? যিনি কোনো লেখকের পর্যায়েই পড়েন না, দেখা যাচ্ছে যে বাংলা ভাষা ঠিকমতো লিখতেও পারেন না, তিনিও বই লিখে নিয়ে আসছেন। তাদের সঙ্গে টিকটকার, ইউটিউবার, ফেসবুকার নানা ধরনের গ্রুপ আসছে। তারা বইমেলাটাকে খিচুড়ি বানিয়ে ফেলছে। বইমেলা তো বুদ্ধিবৃত্তিক একটা জায়গা। এখন আর বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু চলছে বলে মনে হয় না।
গরুর হাটের মতো হয়ে যাচ্ছে বইমেলাটা। এত বড় বইমেলা আসলে আমাদের দরকার নেই। আমাদের যে পরিমাণ পাঠক ও যে পরিমাণ লেখক, তাতে পরিসর আরও ছোট করা উচিত। একটা বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে আমাদের বইমেলাকে একটা আন্তর্জাতিক রূপ দিতে হবে। বইমেলায় ঢোকার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করা উচিত। সবাই লাইন ধরে টিকিট কেটে ঢুকবে। সারা পৃথিবীতেই কিন্তু টিকিট কেটেই ঢুকতে হয়। আমাদেরও সেই সিস্টেমটা চালু করতে হবে। না হলে অহেতুক এত মানুষ যে আসছে, যারা বই কেনে না, যারা বই পড়ে না, বই নিয়ে যাদের কোনো আগ্রহ নেই, তাদের তো এখানে প্রয়োজন নেই। কারণ এদের জন্য যারা আসলে বই কিনতে আসতে চান, এদের অহেতুক ভিড়ে আসতে পারেন না। যারা বই কিনবেন, দেখবেন তাদের জন্য অনুকূল সেই ব্যবস্থাটাই করতে পারলে সবচেয়ে ভালো।
আমরা এখন বাচ্চাদের বই, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। এখন যারা তরুণ, তারা কেউ খুব একটা বই পড়েন না। বাচ্চাদেরও যদি এই অভ্যাসটা হয় বই না পড়ে, সারা দিনই মোবাইলের মধ্যে থাকে, তাহলে এই সমাজ একটা বিপজ্জনক সমাজ হয়ে যাবে। আমরা চাই বাচ্চারা যেন দিনে অন্তত কিছুক্ষণ হলেও বই পড়ে। মোবাইল থেকে যেন দূরে থাকে। এই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই আমরা বাচ্চাদের বইকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি।
এবারের বইমেলায় কিন্তু বই বিক্রি হচ্ছে কম। মুদ্রিত বই এখনকার তরুণরা অনেকেই পড়তে চান না। তারা মোবাইল স্ক্রিনে বা ল্যাপটপে পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কাগজের দাম প্রচুর বেড়েছে। বই মুদ্রণ করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে বইয়ের মুদ্রণ সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। তরুণরা একবার যেহেতু প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়েছেন, এখান থেকে আসলে বের হওয়াটা খুব একটা সহজ হবে না। আর প্রযুক্তিতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে। নতুনত্ব আসছে, সেই নতুনত্ব এবং পরিবর্তনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুবসমাজ তাল মিলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ছেড়ে দেওয়াটাও আসলে ঠিক হবে না। কিন্তু এর বাইরেও একটা সময় বের করতে হবে, যেটা মানুষের জীবন- এই বিষয়টা যেন তরুণরা বের করতে পারে। তাহলে মুদ্রিত বই পড়ার আনন্দটা পেতে পারবে।
আমাদের একটি প্রকল্প আছে ‘বইগাড়ি’। এই বইগাড়ি নিয়ে আমরা দেশের প্রায় ৩০টি জেলায় গিয়েছি, বাচ্চাদের স্কুলে গিয়েছি। এই বইগাড়ি নিয়ে আমরা যখন কোনো স্কুলে যাই, তখন আমরা পাঠক তৈরি করার চেষ্টা করি। বই পড়ানোর চেষ্টা করি। আর বইবাড়ির যে বিষয়টা, সেটা হচ্ছে আসলে বইবাড়ি কেবল বিক্রয়ের জন্য হবে না। ওই বাড়ির মাধ্যমে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যারা আছেন, যারা গান করেন, ছবি আঁকেন, কবিতা আবৃত্তি করেন অর্থাৎ সব ধারার মানুষকে আমরা বইবাড়ির মাধ্যমে একত্রিত করতে চাই। আসলে শুধু বই পড়ার মাঝে কিন্তু আনন্দ নেই। মানুষ বই পড়বে, সে বিষয়ে আড্ডা দেবে, গান শুনবে, দেশ-রাজনীতি-সমাজ নিয়ে আলোচনা করবে, এর মধ্য দিয়ে যে একজন বড় চিন্তার মানুষ তৈরি হবে। সেই কাজটার জন্যই আমরা আসলে বইবাড়ি বানাচ্ছি। বাড়িটি হবে একটি গ্রামের ভেতর এবং আমাদের ইচ্ছা আছে বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতেই একটি করে ছোট ছোট বইবাড়ি বানানোর।