
অমর একুশে বইমেলায় চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী, এ বছরেও প্রকাশনার শীর্ষস্থানটি দখলে রেখেছে কবিতার বই। বাংলা সাহিত্যের জ্যেষ্ঠ কবিদের সঙ্গে তরুণ কবিদের অনেকে সমকালীন জীবনবোধ ও ভাবনার মিশেলে প্রকাশ করেছেন কাব্যগ্রন্থ। তরুণ কবিদের কেউ আবার নতুন কাব্যরীতি নির্মাণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন। নিজস্ব কাব্যশৈলীতে তারাও নজর কাড়ছেন পাঠকদের।
তবে দেদার কবিতার বই প্রকাশ হলেও তার সব কটিই যে মানসম্পন্ন, তা বলতে নারাজ প্রকাশকরা। আগামীর কর্ণধার ওসমান গণি বলেন, ‘কবিতার বইয়ের অধিকাংশ ছাপতে হয় অনুরোধের প্রেক্ষিতে। কবিতার বইয়ের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমছে। তবু দেখুন, কবিতার বই শীর্ষস্থান দখল করে রাখে প্রকাশনায়। এটা নিয়ম হয়ে গেছে। তবে এখন সময় এসেছে কাগজ নষ্ট না করে ভালো মানের বই ছাপানোর।’
এ বছর ঐতিহ্য থেকে এসেছে আবুল হাসানের কবিতার সংকলন ‘যে তুমি হরণ করো’। আবুল হাসানের প্রতিবাদী ও দ্রোহী সত্তার পরিচয় মিলবে ‘রাজা আসে রাজা যায়’ শিরোনামের বইটিতে। সত্তরের দশকের বিশিষ্ট কবি হাফিজুর রহমানের কবিতার বই ‘অপরাহ্ণের পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশ করেছে তারা। এ ছাড়া জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাতের ‘প্রিয় ৫০ প্রেমের কবিতা’ প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। এই প্রকাশনী থেকে আসা কবিতার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে সুদীপ বসুর ‘অন্ধদের বিউটি পার্লার’, কবি নাসিমা সুলতানার ‘মৃগয়ায় যুদ্ধের ঘোড়া’, নকিব মুকশির ‘পৃথিবী এক সরোগেট মাদার’, শিহানুল ইসলামের ‘প্রেতযোনিপ্রাপ্ত আত্মাদের গোরস্তানে’, সৈকত ঘোষের ‘রাংতায় মোড়া উৎসব’।
বিশ্বসাহিত্য ভবন এনেছে কবি হাসান হাফিজের ‘জন্মেছিলাম ভুল সময়ে’। কবির ‘অনন্ত ক্ষমার চিতাকাঠ’ এনেছে অন্যপ্রকাশ, অনন্যা এনেছে ‘বিসর্জন আহত নির্জন’। কবি তৌফিক মারুফ ৩৫ বছর পরে তার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন এবং মানুষ প্রকাশনী থেকে এসেছে তার কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াঘুম’। তুরস্কের মরমি কবি ইউনুস এমরের সুফিবাদবিষয়ক কবিতার বঙ্গানুবাদ করেছেন আরশাদ-উজ জামান ও মুহম্মদ নূরুল হুদা। ৫০ খণ্ড কবিতার সঙ্গে তুরস্কের সুফি ঘরানার কাব্য প্রকরণ ও শব্দবন্ধের ব্যবহার রয়েছে এই বইয়ে। বইটি বইমেলায় এনেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশনস। এ প্রকাশনী থেকে এসেছে কবি মোহাম্মদ রফিকের কাব্যগ্রন্থ ‘মরমে মরমি’। চন্দ্রবিন্দু থেকে এসেছে নাসরীন জাহানের ‘এঁটে দিই জামার বোতাম’।
এ বছর কবিতায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারজয়ী কবি শামীম আজাদের কাব্যগ্রন্থ ‘শূন্যস্থানে চুম্বন’, ‘কবিতাসমগ্র-১’, ‘কবিতাসমগ্র-২’ এসেছে এই প্রকাশনী থেকে। কবির আরেকটি বই ‘কইন্যা কিচ্ছা’ জাগৃতি থেকে এসেছে। তার কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বাচিত কবিতা’ এসেছে স্বরবৃত্ত থেকে। জাগৃতি বইমেলায় এনেছে কবি হায়াত কামালের ‘ত্রিশ বছর পর’ ও ‘নমিতা’ কাব্যগ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হয়েছে। অনন্যা থেকে এসেছে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘সেরা তিন’। আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘মুজিবমঞ্জুষা’, সুজন বড়ুয়ার ‘অন্ধকারের উৎসমূলে অলৌকিক ভোর’, স্নিগ্ধা বাউলের ‘দ্বিখণ্ডিত পদাবলী’। তরুণ কবি স্নিগ্ধা বাউলের ‘সভ্যতা এক আশ্চর্য খোঁয়ারি হাঁস’ কাব্যগ্রন্থটি এনেছে সময় প্রকাশন। এই প্রকাশনীর কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে গুলতেকিন খানের ‘ছন্দে লেখা মানা’।
ভাষাচিত্র থেকে এসেছ আবু তাহের সরফরাজ সম্পাদিত কবিতার বই ‘নব্বই দশকের কবিতা: সমকালীন পাঠ’; গৌরাঙ্গ নাথের ‘কি শব্দ খুঁজবে আজ’। বাতিঘর থেকে এসেছে সালেহীন শিপ্রার ‘রণদৌড়ের ঘোড়া’।
হুমায়ুন আজাদের নামে পদক ও সড়কের নামকরণের দাবি
প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ স্মরণে বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তনের দাবি তুলেছেন কবি, সাহিত্যিকরা। তার মেয়ে মৌলি আজাদ দাবি জানিয়েছেন, বাংলা একাডেমির সামনের সড়কটি তার বাবার নামে নামাঙ্কিত হোক।
লেখক প্রকাশক পাঠক ফোরামের উদ্যোগে হুমায়ুন আজাদ দিবসের মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে তারা এই দাবি জানান। অনুষ্ঠানে কবি মোহন রায়হান, কবি আসলাম সানী উপস্থিত ছিলেন। আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি বলেন, হুমায়ুন আজাদ ছিলেন প্রথাবিরোধী, সাহসী এক ব্যক্তি। রাজনীতি কোন দিকে চলছে তা নিয়ে খুব সচেতন থাকতেন তিনি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘হুমায়ুন আজাদের মতো প্রতিবাদী সত্তা বা তার সমকক্ষ কম দেখেছি আমি। তিনি জানতেন, প্রতিবাদের কারণে তাকে চরম অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি মানুষের মধ্যে বিভেদহীনতায় কী এক নান্দনিকতা আবিষ্কার করেছিলেন। তার লেখনীতে তিনি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের কথা বলেছেন।’
কবি, সাহিত্যিকদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শুধু বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে না, কবি হিসেবেও আমার দাবি ছিল বাংলা একাডেমি থেকে হুমায়ুন আজাদের নামাঙ্কিত কোনো পদক হোক। তার নামে সড়কের নামকরণ করা হোক। তিনি ২০০৪ সালে টিএসসির কাছে যে স্থানে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেখানে একটি স্মারক নিদর্শন করা হোক, সেটিও চেয়েছিলাম। পদকের বিষয়ে বাংলা একাডেমির কিছু নিয়ম আছে। আমি নিয়মমাফিকভাবে তা আমাদের ফোরামে আলোচনা করব। আর সড়কের নামকরণের বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। তাদের সঙ্গে আমরা কবি, সাহিত্যিক সবাই মিলে আলোচনা করব।’
২০০৩ সালে ইত্তেফাক পত্রিকার ঈদসংখ্যায় হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৪-এর একুশে বইমেলাতে উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। হুমায়ুন আজাদ দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তিনি জার্মানিতে গবেষণার জন্য গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।