ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অমর একুশে বইমেলা স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনার কথা শোনা যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন লেখক-প্রকাশকরা। চলতি বছরের মার্চ থেকে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়)’ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেয়। তাতে এ বছরের (২৯ ফেব্রুয়ারি) পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা না করার বিষয়টি জানানো হয়। এর পরই লেখক-প্রকাশকদের কাছে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অস্থায়ী কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেল পাঁচটায় ‘অমর একুশে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
লিখিত বক্তব্য পাঠে শ্যামল পাল বলেন, ‘আমরা নানান সূত্রে জেনেছি, একুশে বইমেলাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে মহান স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত রয়েছে। যাতে বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার এই শক্তিশালী কর্মকাণ্ডটিকে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়। আমরা এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ জানাই। আমরা মনে করি, এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে বাস্তবায়ন করা হলে তা হবে এই মহান বইমেলাকে হত্যা করার শামিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘বইমেলা স্থানান্তরিত হলে সেটা হবে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, গবেষক, লেখক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার মানুষকে সাংস্কৃতিক এবং আর্থিকভাবে অপুরণীয় ক্ষতি করার শামিল।’
প্রকাশকদের পক্ষে দাবিনামা উত্থাপনের সময় তিনি বলেন, ‘আমাদের একমাত্র দাবি হলো, যেকোনো মূল্যে অমর একুশে বইমেলাকে বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যাবে না। আমরা আশা করি, কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ নেবে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা যদি অন্য কোথাও নেওয়া হয়, তবে আমি সেই মেলায় যাব না।’
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘উন্নয়নকাজের জন্য যদি সামনের বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা করা সম্ভব না হয়, তবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এখন থেকেই পরিকল্পনাবিদদের দিয়ে স্ট্রাকচার নির্মাণ শুরু করতে হবে। বইমেলা এ জায়গা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।’
সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘মেলাটাই ভাষাশহিদদের স্মরণে, এখানে মেডিকেল, শহিদ মিনার, ঢাবি রয়েছে। এই এলাকায় ফেব্রুয়ারির বইমেলা মানানসই। যেকোনো বাণিজ্যের মেলা অন্য কোথাও হতে পারে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই এই মেলা কাম্য। অন্য কোথাও গেলে মেলা তার চরিত্র হারাবে। অন্য কোথাও চলে গেলে বাংলা একাডেমিতে আরেকটা মেলা হবে কি না, জানি না।’
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি ও অন্য প্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘বইমেলার প্রাঙ্গণ ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, টিএসসি, কার্জন হল, শহিদ মিনার, মেডিকেল কলেজ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক বলয় তো বটেই, ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিবিজড়িত স্থানও। ফলে এই জায়গা থেকে মেলা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, তা করতে দেওয়া হবে না।’
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংস্কারকাজের কারণে যদি সেখানে মেলা করা সম্ভব না হয়, তবে আমরা একাডেমি প্রাঙ্গণেই মেলা করব। সে ক্ষেত্রে স্টলের আকার আর বই বিক্রির ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আনা হবে। এ ক্ষেত্রে আমার আরও পরিকল্পনা আছে।’
প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল চৌধুরী বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বইমেলা স্থানান্তরের বিষয়ে আমার জানা নেই। আমরা কাছে কোনো তথ্য নেই। অনেকেই ধারণাপ্রসূতভাবে এটি বলছেন।’
জানা গেছে, ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়)’ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের স্থান সংরক্ষণসহ আনুষঙ্গিক উন্নয়নকাজ হবে। উন্নয়ন প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে চলতি বছরের মার্চে।
মেলার নতুন বই
মেলার ২৯তম দিনে গতকাল বইমেলার নতুন বইয়ের স্টলে জমা পড়েছে ১২৭টি বই। এগুলোর মধ্যে সৌম্য প্রকাশনী থেকে এসেছে যতীন সরকারের ‘আমাদের চিন্তাচর্চার দিক্-দিগন্ত’, বাংলা একাডেমি এনেছে সাজজাদ আরেফিনের ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা পরিচয়’ ও সুকুমার বিশ্বাসের ‘পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন: সংবাদপত্রের ভূমিকা ও ইতিহাস’ (দুই খণ্ডে), অন্যপ্রকাশ এনেছে কবি কামাল চৌধুরীর ‘প্রতিপৃষ্ঠা নদীর জীবন’, বিশ্বসাহিত্য ভবন এনেছে হাসান হাফিজের ‘কিশোরসংগ্রহ-১’, বাতিঘর এনেছে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ‘যখন পুলিশ ছিলাম’, কথাপ্রকাশ এনেছে মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘প্রবন্ধাবলী-১’ ও আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আকালের গল্প’।
মেলার নানা আয়োজন
বৃহস্পতিবার ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন, পুথি গবেষক জালাল খান ইউসুফী, কথাসাহিত্যিক মাহমুদুন নবী রনি এবং কবি রনি রেজা।
শুক্রবার (১ মার্চ) অমর একুশে বইমেলার ৩০তম দিন। মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।