প্রবন্ধ রচনা
মানবকল্যাণে বিজ্ঞান/দৈনন্দিন জীবনে
বিজ্ঞান/বিজ্ঞানের অবদান
(৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশের পর)
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান: একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, ‘Our every share of life is attached to the gift of science’ অর্থাৎ আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের অবদান রয়েছে। তেমনি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের অবদান রয়েছে। বিজ্ঞানীরা আজ চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কার করেছেন। আগে যেসব রোগে মানুষকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হতো আজ যেসব রোগব্যাধির নিরাময়ের জন্য উন্নততর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। কঠিন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিও আজ আরোগ্য লাভ করে নতুন আশার সঞ্জীবনী মন্ত্রে উজ্জীবিত হচ্ছে। দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিও আজ বাঁচার অধিকার রাখে। অধ্যাপক মাদাম কুরি ও পিয়েরে কুরির আবিষ্কৃত ‘রেডিয়াম’ ক্যানসার নিরাময়ে সহায়ক। বিজ্ঞান এখন মরণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে মানুষ ইচ্ছামতো চেহারা তৈরি করছে। পেনিসিলিন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আরও এক ধাপ এগিয়েছে। অধ্যাপক রল্টগেট রঞ্জনের আবিষ্কৃত রঞ্জনরশ্মি বা এক্স-রের মাধ্যমে মানুষের দেহের ভেতরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। কিডনি সংযোজন, ওপেন হার্ট সার্জারি, আল্ট্রাসনোগ্রাফির আবিষ্কার এখন চিকিৎসা ক্ষেত্রের অন্যতম সাফল্য। বর্তমানে বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলে মৃত্যুর হার অনেক কমে আসছে।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান: আমাদের খাদ্য সংস্থানের জন্য আমরা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই একটি দেশের কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। এজন্য প্রয়োজন বাড়তি খাদ্য। আর সে কারণেই বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি সাধন করেছে। চাষাবাদের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে কলের লাঙল, পাওয়ার ট্রিলার, আগাছা নিড়ানির জন্য হস্তচালিত নিড়ানি, ধান কাটার কল হারভেস্টার, অধিক ফসল ফলানোর জন্য রাসায়নিক সার, কীটপতঙ্গ দমনে কীটনাশক ইত্যাদি বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে এনেছে বিপ্লব, শিল্পে অচিন্তনীয় সাফল্য। পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের সাহায্যে মরু অঞ্চলকে শস্য শ্যামল করে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই রিঅ্যাক্টরের সুবিধা হলো, একে বিমানযোগে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে গিয়ে চালানো যায়। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জলাবদ্ধ ভূমির পানি নিষ্কাশন ও মরু অঞ্চলে পানি সেচ করে লাখ লাখ একর ভূমিকে কৃষিযোগ্য করা যায়। তা ছাড়া শীতপ্রধান দেশে অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ‘গ্রিন হাউজ’ নামে এক বিশেষ ঘর ব্যবহার করা হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান: বিজ্ঞানের কল্যাণে পাঠ্যপুস্তক সহজলভ্য হয়েছে। লেখার কলম ও কাগজ, জ্ঞানার্জনের জন্য সংবাদপত্র ও পুস্তক আবিষ্কার করেছে এ বিজ্ঞান। ছাত্র সমাজের পরম বন্ধু বিজ্ঞান তাদের লেখার কাগজ বহন করে আনছে রেল স্টিমারে, আর তা ছাপা হচ্ছে ছাপাখানার বিদ্যুতের সাহায্যে। ক্লাসে মাথার ওপরে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। অন্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য আবিষ্কার হয়েছে ব্রেইল পদ্ধতি। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিজ্ঞান করছে নানা ব্যবস্থা। ইলেকট্রনিক্সের কল্যাণে হয়তো একবিংশ শতাব্দীতে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। ঘরে বসেই টিভির পর্দায় শিক্ষকের বক্তব্য শুনতে পারবে। টর্চ লাইট, বৈদ্যুতিক বাল্ব যেমন অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোতে চলার পথ করে দিয়েছে তেমনি কাগজ, কলম ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে মানুষ অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তি ও আলোর পথনির্দেশ পেয়েছে।
আরো পড়ুন : মানবকল্যাণে বিজ্ঞান/বিজ্ঞানের অবদান বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা, ১ম পর্ব
অবসর বিনোদনে ও আমোদ-প্রমোদে বিজ্ঞানের অবদান: অবসর বিনোদনেরও মানুষের একান্ত আপনজন বিজ্ঞান। জীবনকে সুখী ও সুন্দর করার কাজে বিজ্ঞান নানাভাবে সাহায্য করছে মানুষকে। বিচিত্র পণ্যের বিস্ময়কর সমাবেশ, সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদির আবিষ্কার সমাজের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। রেডিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার সিনেমা। অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের উপকরণের সঙ্গে সিনেমার পার্থক্য আছে। সিনেমা গতিশীল এবং বাঙ্ময়। সিনেমা একই সঙ্গে আমাদের দর্শন এবং শ্রবণ শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে। এখানে টেলিভিশনের কথা উঠতে পারে। বহু দূরের ও স্থানের বিভিন্ন ছবি সিনেমা ও টেলিভিশনে দেখানো হয়। এ সব উপকরণ সময় ও দূরত্বের বন্ধনকে যেভাবে অতিক্রম করে, আমোদ-প্রমোদের অন্য কোনো উপকরণই তা পারে না। এ কারণেই আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রে সিনেমা ও টেলিভিশনের গুরুত্ব আজ সর্বজনবিদিত। বিজ্ঞানের কারণে সিনেমা, রেডিও টেলিভিশন ছাড়াও আজ বহু ধরনের আনন্দের উপকরণ আমাদের সামনে দেখতে পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার: বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের অভাব দূর হয়েছে, তারা আনন্দ লাভ করেছে, স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছে। সুতরাং প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের অবদান অনেক। কিন্তু এত কিছুর পরও মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই, তার তৃষ্ণা মেটেনি। ফলে মানুষ আবিষ্কার করেছে নানা ধরনের যন্ত্র ও মহাশূন্যে যাওয়ার যান, যা বিজ্ঞানের অন্যতম কৃতিত্ব। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে মানুষ আকাশের বহু গোপন রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বস্তু দেখতে পারছে। আর কম্পিউটারের সাহায্যে এমন সব কাজ করছে, যা কিছুদিন আগে কল্পনাও করা যেত না। আর রোবট সে যেন মানুষের গোলাম। সে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানা কাজ করে দিচ্ছে। এভাবেই মানুষ বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমে মানব সভ্যতার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে মানুষ প্রকৃতির ওপর উড়িয়েছে বিজ্ঞানের বিজয় কেতন। বিজ্ঞানের অবদান সম্পর্কে বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন,
‘Science is our guidence
Science is our animation’.
বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিক: ‘There is no any rose without thorn’ অর্থাৎ কাঁটা ছাড়া যেমন গোলাপ হয় না। তেমনি প্রত্যেকটি জিনিসের ভালোমন্দ উভয় দিক আছে। আমাদের জীবনে বিজ্ঞান শুধু আশীর্বাদ আনেনি, অভিশাপও এনেছে। যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে করতে মানুষের জীবনে এসেছে যন্ত্রনির্ভরতা, কর্মবিমুখতা। দিন দিন মানুষের সঙ্গে ঘনীভূত হচ্ছে কৃত্রিমতা ও অসৎ প্রবৃত্তি বেড়ে উঠছে । এক ফোঁটা অ্যাসিডের জন্য ঝলসে যাচ্ছে কত ফুলের মতো নিষ্পাপ মুখ। অবৈধ রিভলবারের মুখে হারিয়ে যাচ্ছে কত তাজা প্রাণ, নিঃশব্দে ঝরে যাচ্ছে কত মানুষ। কম্পিউটার এনেছে বেকার সমস্যা। টেলিভিশন, ভিসিআর, ভিসিডি, সিনেমা, রেডিও এনেছে আমাদের সমাজে অপসংস্কৃতি আর এজন্য যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে ধ্বংস হয়েছে এই দুটি শহরের জনপদ, প্রাণ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ, লাখ লাখ একর জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়েছে। ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংসের কারণে তা থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার ফলে অনেক এলাকার ফসল নষ্ট হয়ে যায় এবং লাখ লাখ একর উর্বর জমি সম্পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। টেলিভিশনের প্রতিফলিত রশ্মি মানুষের চোখের ক্ষতি করছে। অস্ত্রের ঝংকারে আজ প্রকম্পিত হচ্ছে পৃথিবীর আকাশ বাতাস। এতে বিজ্ঞানের অনেক ক্ষতিকর দিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
উপসংহার: ভালোর পরশে মন্দের উপস্থিতি আলো আঁধারের মতো লুকোচুরি খেলবেই। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান তাই ভালোর সঙ্গে অপ্রীতিকর কিছু বৈকি। আর এজন্যই হয়তো বিজ্ঞানী হলডেন বলেছেন, ‘We need science more than ever beofore’ বাতাস ছাড়া যেমন জীবন চলতে পারে না তেমনি বিজ্ঞান ছাড়াও বর্তমান সভ্যতা নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দন। তাই বর্তমান যুগে প্রতি মুহূর্তে এবং প্রতি পদক্ষেপে সভ্য জগৎ বিজ্ঞানের কাছে দায়বদ্ধ। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আজ জীবন ও সমাজের মুখচিত্র কল্পনাও করা যায় না।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা
কবীর