ওয়াসিকা আয়শা খান গত ১ মার্চ অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী, যিনি প্রথমবারের মতো অর্থ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন। চট্টগ্রামের এই কৃতী সন্তান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন-৩১ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারীর ক্ষমতায়ন, অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা, অর্থনীতিতে নারীর অবদান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজনেস এডিটর আবু কাওসার
খবরের কাগজ: নারীর অগ্রযাত্রায় বর্তমান সরকারের অবদান কতটুকু?
ওয়াসিকা আয়শা খান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত। তিনি বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং লিঙ্গ সমতাকরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার নিরলস পরিশ্রম, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাধারা এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপে সবকিছুর মধ্য দিয়েই আজকে বাংলাদেশের নারীরা দৃশ্যমানভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের জগতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও উপস্থিতি বাংলাদেশের সর্বত্র দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, প্রশাসন, কূটনীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নারীরা অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করে তুলছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাঙালি নারীরা তাদের নিজেদের অনুকরণীয় করে তুলছেন।
খবরের কাগজ: নারীর অগ্রযাত্রায় আপনার দৃষ্টিতে এখনো সীমাবদ্ধতা কোথায়?
ওয়াসিকা আয়শা খান: দেশের চলমান অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি নারী তার পরিবারের সচ্ছলতা আনতে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ইটভাঙা শ্রমিক থেকে শুরু করে হিমালয় চূড়া জয় করা, পোশাকশিল্প, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে থেকে কাজে অংশগ্রহণ করছেন। পুলিশ, বিজিবি, সামরিক বাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ ও ফলপ্রসূ ভূমিকা এখন দৃশ্যমান। নারী অগ্রসর হলেও কিছু সামাজিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে অধস্তন করে রাখছে। এ কারণে আমাদের মা, মেয়ে ও বোনেরা নতুন নতুন নৃশংস ও নিষ্ঠুর সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। আমাদের সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে দেশ ও দশের স্বার্থেই সবাই মিলে নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে।
খবরের কাগজ: অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ে এই প্রথম একজন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। এর কি তাৎপর্য আছে বলে আপনার মনে হয়?
ওয়াসিকা আয়শা খান: গ্রাম কিংবা শহর, সব জায়গায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শুধু জাতীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যে পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা এরই ধারাবাহিকতা বলে আমি মনে করি। আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম নারী অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে প্রথম সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।
খবরের কাগজ: গৃহস্থালিতে নারীর শ্রম জিডিপিতে গণনার বিষয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা জানতে চাই।
ওয়াসিকা আয়শা খান: কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা না করেই নারীরা গৃহস্থালি কাজ করে থাকেন। তাদের এই কাজটি উৎপাদনের জাতীয় হিসাব অথবা জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতির (এসএনএ) বাইরে থাকে। কিন্তু জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। অনেক আগে থেকেই গ্রামীণ নারীরা কৃষি খাতে অবদান রাখছেন। অধুনা সেই হার বেড়েছে। বাংলাদেশে মোট কর্মজীবী মানুষের মধ্যে প্রায় ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ লোক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আবার তাদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশই নারী। তাই গৃহস্থালিতে নারীর শ্রম জিডিপিতে গণনার বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
খবরের কাগজ: দুর্নীতিমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে আপনি কাজ করবেন বলে এরই মধ্যে জানিয়েছেন; এ ক্ষেত্রে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন কী?
ওয়াসিকা আয়শা খান: বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির দুনিয়ায় এক নীরব সংকট বিরাজমান। উন্নত দেশগুলোতেও মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্বসহ নানা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজমান। যেকোনো সংকট থেকে মুক্তির ধারাবাহিক ধাপগুলো হলো সংকট চিহ্নিত করা, সংকটের প্রকৃত কারণ উদ্ধার এবং এরপর উত্তরণের পথ বের করা। এর থেকে উত্তরণের একটি পথ বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠী লক্ষ্যবস্তু নয়, বরং প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে বাস্তবতা ও অর্থনীতির মৌলিক সূত্রের আলোকে এর সমাধান নিয়ে কাজ করাই আমার মূল লক্ষ্য।
খবরের কাগজ: নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরও বেশি যুক্ত করতে আপনার কী পরিকল্পনা রয়েছে?
ওয়াসিকা আয়শা খান: ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের ভোগান্তি কমিয়ে ব্যাংকঋণের সহজলভ্যতা ও অন্য সব ক্ষেত্রে তাদের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ জন্য জেন্ডার ইনক্লুসিভ ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম এবং জেন্ডার লেন্স ইনভেস্টমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নারী-পুরুষ বৈষম্য নিরসন করে জেন্ডার লেন্স ইনভেস্টমেন্ট সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ে নারীদের কাছে পৌঁছে দিয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ালে সারা দেশ উপকৃত হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে শহরমুখী উদোক্তাদের ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য গ্রামীণ এলাকায় নারী উদ্যোক্তাদের সময়মতো ঋণ দিতে হবে। বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাজারমুখী করার চেষ্টা করতে হবে।