দেশের বিমা খাতের সার্বিক দিক নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছেন ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কাজিম উদ্দিন।
খবরের কাগজ: ব্যাংক ও বিমা দেশের অন্যতম আর্থিক খাত হলেও শুধু বিমা খাতে জাতীয় দিবস পালিত হচ্ছে। বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখেন।
মো. কাজিম উদ্দিন: এটা অবশ্যই গর্বের ও সম্মানের। যেকোনো জাতীয় দিবসের সঙ্গে দেশের গৌরব, মর্যাদা এবং সম্মান জড়িত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে বিমাশিল্পকে গৌরবময় এবং মর্যাদাপূর্ণ করেছেন। এর মাধ্যমে অবহেলিত বিমাশিল্প একটি সম্মানজনক স্থানে পৌঁছেছে বলে আমি মনে করি। আর এই খাতের একজন কর্মী বলেই বিমা দিবসটি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
খবরের কাগজ: যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিমা দিবস পালিত হয় তার বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু ঘটছে?
মো. কাজিম উদ্দিন: বিমা খাতের জন্য বিমা দিবসটি বেশ সম্মান ও গৌরবের। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিমা কোম্পানিগুলো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও আইডিআরএ এর নির্দেশেনায় সারা দেশে সরকারিভাবে বিমা নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য শোভাযাত্রা, লিফলেট বিতরণ, আলোচনা সভাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে বিমাপ্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ছে। তাই আমি মনে করি, বিমা দিবস পালনের কারণে এ খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
খবরের কাগজ: অতীতের তুলনায় বর্তমানে বিমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কী বাড়ছে?
মো. কাজিম উদ্দিন: একসময় বিমা কোম্পানিগুলো প্রিমিয়াম আদায় করত হাতে লেখা রশিদ দিয়ে। এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহকসেবায় জটিলতা হতো। তবে বর্তমানে সময় বদলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে বিমা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমও ডিজিটাল হচ্ছে। এখন প্রিমিয়াম আদায়ে ডিজিটাল রশিদ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ গ্রাহক প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুঠোফোনে এসএমএস চলে যাচ্ছে। আইডিআরএও এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহকদের পলিসির তথ্য দিচ্ছে। এতে গ্রাহক তার প্রিমিয়াম জমা হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে। ফলে অনাস্থা দূর হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বাসও বাড়ছে।
খবরের কাগজ: দেশের জনসংখ্যার তুলনায় জীবন বিমা গ্রাহকের হার অতি নগণ্য। পার্শ্ববর্তী দেশেসহ উন্নত বিশ্বে বিমা গ্রাহকের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষ বিমা গ্রহণে অনাগ্রহী কেন?
মো. কাজিম উদ্দিন: বিপুল জনসংখ্যার দেশ হলেও বাংলাদেশে বিমা গ্রাহকের হার অত্যন্ত নগণ্য। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ বিমার আওতায় এসেছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বিমার অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। উন্নত বিশ্বে এই হার শতভাগের কাছাকাছি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জিডিপিতেও বিমার অবদান ৪ দশমিক ২ শতাংশ। নেপাল, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশেও এ হার বেশ সন্তোষজনক। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের বিমা খাত পিছিয়ে থাকার বড় কারণ গ্রাহকের আস্থা ও সচেতনতার অভাব। আরও সহজ করে বললে, বিমার উপকারিতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা এবং বিমা নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রচার বা অপপ্রচার এই খাতকে পিছিয়ে রেখেছে। এ কারণে বাংলাদেশে বিমাশিল্পের কাঙ্ক্ষিত প্রসার ঘটেনি। এ জন্য সাধারণ মানুষ বিমা পলিসি গ্রহণে অনাগ্রহী। তবে আশার কথা হলো- সরকার ও আইডিআরএ এর নানামুখী পদক্ষেপের ফলে বিমার প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে বিমা আইন ২০১০ এবং জাতীয় বিমানীতি ২০১৪ প্রণনয়, বিমা কোম্পানিগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সারা দেশে জাতীয় বিমা দিবস পালনের মাধ্যমে বিমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ছে। তবে বিমার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে হলে বিমা কোম্পানিগুলোকে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি ও সময়মতো বিমা দাবি পরিশোধ করতে হবে।
খবরের কাগজ: সদ্য প্রবর্তিত ব্যাংকান্স্যুরেন্সের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কতটুকু দেখছেন?
মো. কাজিম উদ্দিন: বাংলাদেশে ব্যাংকান্স্যুরেন্সের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যাংকান্স্যুরেন্স প্রবর্তন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ব্যাংকান্স্যুরেন্সের মাধ্যমে বিমা জনগণের কাছে আরও সহজলভ্য হবে ও জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা সুবিধা সম্প্রসারিত হবে। বাংলাদেশের বর্তমান ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটি মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু এই ১০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে বিমার আওতায় আছে ১ কোটিরও কম। আশা করছি ব্যাংকান্স্যুরেন্সের মাধ্যমে বিমার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে এবং বিমায় পেনিট্রেশন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাংকান্স্যুরেন্সের মাধ্যমে বিমা গ্রহণের হার প্রায় ৫৫ শতাংশ এবং এজেন্সি এবং অন্যান্য চ্যানেলের মাধ্যমে বিমা গ্রহণের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ। শুধু ভারতের এসবিআই লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০২২ সালের তাদের অর্জিত মোট প্রিমিয়াম ২৯,৫৯০ কোটি রুপির মধ্যে ব্যাংকান্স্যুরেন্সের মাধ্যমে আয় করেছে ১৭,৮৩০ কোটি রুপি, যা তাদের মোট প্রিমিয়ামের ৬০ শতাংশ।
আমরাও সার্বিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকান্স্যুরেন্সকে এগিয়ে নিতে পারলে আমাদেরও বিপুল প্রিমিয়াম আয় সম্ভব হবে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৃহদাকারভাবে ভূমিকা রাখবে।
খবরের কাগজ: বিমা দাবি পরিশোধ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন উল্লেখ করুন?
মো. কাজিম উদ্দিন: বিমা দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য বিমা দাবি পরিশোধকে উৎসাহিত করা। বিমা দাবি পরিশোধে শুধু যে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক লাভবান হন তা নয়, বরং এতে পুরো বিমা খাত লাভবান হয়। সঠিক সময়ে বিমা দাবি পরিশোধ করা হলে বিমার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও আস্থা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কোম্পানিগুলোকে মেয়াদ পূর্তির পরই দ্রুত বিমা দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। পদ্ধতিগত কার্যক্রমের নামে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। দাবির চেক প্রদানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা গেলে বিমা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা দূর হবে এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে; যা নতুন গ্রাহক সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ন্যাশনাল লাইফ ২০২৩ সালে ১০৯৩ কোটি টাকা দাবি পরিশোধ করে। ফলে ২০২৩ সালে আমরা সর্বমোট ১৮৬৪ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয় করতে সক্ষম হয়েছি।
খবরের কাগজ: সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী আপনার প্রতিষ্ঠানের সর্বমোট মোট বিক্রীত পলিসির সংখ্যা, গ্রাহকের সংখ্যা, পরিশোধিত দাবির সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ, দাবি নিষ্পত্তির হার, লাইফ ফান্ড, বর্তমান বিনিয়োগ কত?
মো. কাজিম উদ্দিন: ২০২৩ সাল শেষে ন্যাশনাল লাইফের বিক্রীত বিমা পলিাসর সংখ্যা ৬৪ লাখ ৫৯ হাজার ৭৩০, সর্বমোট প্রিমিয়াম অর্জিত হয়েছে ১৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, লাইফ ফান্ড ৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, বিনিয়োগ রয়েছে ৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা এবং মোট সম্পদ ৬ হাজার ০৪১ কোটি টাকা। তাছাড়া ২০২৩ সালে সর্বমোট দাবি পরিশোধ করা হয় ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।
আমাদের লাইফ ফান্ডের ৯৫ শতাংশই সরকারি ট্রেজারি বন্ডে ৩৮ শতাংশসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা আছে। কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ় ও গ্রাহকের দাবি পরিশোধের সক্ষমতা বজায় রাখতে গত ৩৯ বছর ধরে লাইফ ফান্ডের টাকা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। অতীতে ন্যাশনাল লাইফে কখনও আর্থিকসংকট দেখা দেয়নি, ভবিষ্যতেও এমন সম্ভাবনা নেই। প্রতিবছরে লাইফ ফান্ড উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য ন্যাশনাল লাইফ আজ সুদৃঢ় আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
খবরের কাগজ: বিমা খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মো. কাজিম উদ্দিন: বিমা খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিআইএ গঠনের পর থেকে সংগঠনটির বিমাশিল্পের উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছে। ইতোপূর্বে যারা সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন তারা সবাই বিমাশিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে বিআইএর বর্তমান প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেনের বিচক্ষণ ও দূরদর্শী চিন্তাচেতনায় বাংলাদেশের বিমা খাত অনেক এগিয়ে গেছে।
আইডিআরএ গঠন, নতুন বিমা আইন প্রবর্তন ও জাতীয় বিমা দিবসসহ বিমাশিল্পের সার্বিক উন্নয়নে বিআইএ জড়িত। বিআইএর প্রচেষ্টায় জাতীয় বিমা দিবসে কোম্পানিগুলোকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান বিআইএর অন্যতম অবদান।
খবরের কাগজ: বিমা খাতের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে আরও কী ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন?
মো. কাজিম উদ্দিন: বিমা খাতের সার্বিক উন্নয়নে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে আসছে। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে সংস্থাটির আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে লাইফ বিমা কোম্পানিগুলো লাইফ ফান্ডের টাকা আইডিআরএ এর গাইডলাইন অনুযায়ী সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে কি না, তা নিশ্চিতকরণে আইডিআরকে বিশেষ তদারকি করতে হবে। লাইফ ফান্ডের টাকা যথাযথ বিনিয়োগ করা হলে বিমা দাবি পরিশোধে কোম্পানিগুলোকে সমস্যায় পড়তে হবে না। ফলে এখাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, যুগোপযোগী বিমা পরিকল্প প্রণয়নে কোম্পানিগুলোকে নীতি সহায়তা প্রদান, বিমা প্রসারে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করতে হবে ও সবার জন্য জীবন বিমা বাধ্যতামূলক করতে হবে।