বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার ত্যাগ ও অবদান রয়েছে অপরিসীম। তার সঙ্গে কথা বলেছেন খবরের কাগজের টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি জুয়েল রানা। প্রবীণা ভাষাসংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দির সঙ্গে আলাপচারিতায় তুলে এনেছেন তার মূল্যবান স্মৃতি।
খবরের কাগজ: কোথায় বেড়ে ওঠা আপনার?
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: আমি ১৯৩৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশভাগ, ভাষার দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছি।
খবরের কাগজ: রাজনীতিতে কীভাবে আসা?
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: রাজনীতিতে হাতেখড়ি গ্রামের স্কুলে। কলেজজীবনে ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে বাম রাজনীতিতে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছি। ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রামের রাউজানে ছিলাম। জেঠতুত দাদার কাছে রাজনীতিতে হাতেখড়ি আমার। দাদার কাছে রাজনীতির দীক্ষা নিলেও পড়াশোনায়ও মনোযোগী ছিলাম। এ জন্য আমাকে কখনোই বাবার কাছে বকা খেতে হয়নি। আমাকে নিয়ে বাবা গর্ব করতেন। বাবা কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দি আমাদের ভাইবোনদের পড়াশোনার তদারকি করতেন। ভাইদের জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা থাকলেও আমার ও অন্য বোনদের জন্য গৃহশিক্ষক রাখা হতো না। যদি কেউ আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, এ জন্য।
খবরের কাগজ: কর্মজীবন শুরু কীভাবে?
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: ১৯৬৩ সালে ভারতেশ্বরী হোমসে অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষিকা হিসেবে কাজে যোগদান করি। ১৯৬৫ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং ১৯৯৮ সালে অবসর নিই। রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বাংলাদেশ) লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে এখন দায়িত্ব পালন করছি।
খবরের কাগজ: ভাষা আন্দোলনের সময়ের স্মৃতি যদি একটু বলতেন।
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। শহরের সব দোকানপাট, যানবাহন সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। চট্টগ্রামের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালে অংশগ্রহণ করেন। এ আন্দোলনে মেয়েরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তখন মেয়েদের রাস্তায় বের হয়ে মিছিল করা ছিল অকল্পনীয়। তা সত্ত্বেও মেয়েরা নিজ উদ্যোগে মিছিলে অংশগ্রহণ করে।
সেই কিশোর বয়সে একটি গ্রামের স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আমি, রাজনীতির কিছুই বুঝি না, কিন্তু তখনই স্কুলের বড় ভাইদের কাছে শুনলাম, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা বাংলাভাষাকে বাদ দিয়ে ৪৪ শতাংশ মানুষের ভাষা উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়া হবে। কিশোর মন চঞ্চল হয়ে উঠল। আমাদের স্কুলের (মহামুনি অ্যাংলো গলি ইনস্টিটিউশন) দশম শ্রেণির ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেবপ্রিয় বড়ুয়ার নেতৃত্বে ছাত্র ফেডারেশন গঠন করল।
দশম শ্রেণির ছাত্র সুনীল আইচ ছাত্রীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দিলেন আমার ওপর। আমার বাবা এ খবর পেয়ে আমাকে ও আমার ছোট বোন মীরাকে গ্রাম থেকে স্থানান্তরিত করে চট্টগ্রাম শহরে ডা. খাস্তগীর গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি করলেন। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা আর সম্ভব হলো না। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হই। তখন থেকে শুরু হয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রস্তুতি। পূর্ণেন্দু দস্তিদার, দেবেন্দ্র শিকদার, মীরাদি, প্রণতি, শেলীদি এঁদের কাছে পাঠ নিয়ে কলেজের ছাত্রীদের সংঘবদ্ধ করি। ভাষার অধিকার আদায় তখন প্রধান আন্দোলনের বিষয়।
খবরের কাগজ: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে কিছু জানতে চাই।
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের আইএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা রোষে ফেটে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রামেও মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি গড়ে ওঠে। ভাষার দাবিতে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের সঙ্গে আমরা আন্দোলনে অংশ নিই।
অন্যান্য স্কুলের ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে মিছিল, সভা, স্লোগান করি। বাবা কখনোই চাইতেন না মেয়ে রাজনীতিতে জড়াক। অভিভাবকদের বাধা উপেক্ষা করে মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে নেমে মিছিল, সভা, স্লোগানে অংশ নিই। চট্টগ্রাম রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর আহ্বানে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমি ধর্মঘট পালন, মিছিল ও সভায় যোগ দিই। একুশ ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য আগের দিন সারা রাত জেগে সবাই পোস্টার লেখে। আমি পোস্টার লিখতে পারতাম না। অন্যরা যেগুলো লিখত, তা দেয়ালে দেয়ালে লাগাতাম।
ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিকেলে শিক্ষার্থীদের এক বিরাট মিছিল নিয়ে ডা. খাস্তগীর স্কুলে যাই। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে (!) ঢাকার ছাত্রদের ওপর পুলিশি জুলুমের কথা এবং ছাত্রহত্যার কথা মেয়েদের অবগত করি। সেখান থেকে ট্রাকযোগে মেয়েদের মিছিল নিয়ে চট্টগ্রামের সারা শহর প্রদক্ষিণ করি। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন নারী সংগঠন। চট্টগ্রামের সর্বদলীয় কর্মপরিষদের হয়ে সেদিন রাজপথে নামেন শেলী দস্তিদার, প্রণতি দস্তিদার (পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বোন), মীরাসহ সিনিয়র শিক্ষার্থী সুলেখা, মিনতি, রামেন্দ্র, সুচরিত চৌধুরীসহ আরও অনেকে।
খবরের কাগজ: একজন মেয়ে হয়ে সাংগঠনিক কাজ কীভাবে করেছেন?
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময়ও প্রচুর সাংগঠনিক কাজ করেছি। সে সময়ে চট্টগ্রাম শহরে ছাত্রী ও নারীদের একত্র করা, মিটিং, শোভাযাত্রায় তাদের সঙ্গে অংশগ্রহণের মতো অসম্ভব কাজগুলো সম্ভব করেছি। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালের স্বাধিকার আন্দোলনের এক মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হই। দুই সপ্তাহ কারাবাসের পর মুক্তি পাই।
১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে ডাকসুতে মহিলা মিলনায়তন সম্পাদিকা নির্বাচিত হই। ১৯৫৬-১৯৫৭ শিক্ষাবর্ষে রোকেয়া হলের (তৎকালীন উইমেন্স হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রথম নির্বাচিত সহ-সভানেত্রী হই। রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও আন্দোলনের ঘাত-প্রতিঘাত মাথায় নিয়ে ১৯৫৬ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান), ১৯৫৯ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করি। ১৯৬০ সালে ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করি।
খবরের কাগজ: কোনো বিষয়ে কী পদক পেয়েছেন?
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক লাভ করি। ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি আমাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। এখন হুইল চেয়ারে বসে থেকে অবসর সময় কাটাচ্ছি কুমুদিনী হোমসে।
খবরের কাগজ: জীবনে আর কী চাওয়া আছে আপনার?
প্রতিভা মুশুদ্দি: কিছুই চাওয়ার নেই। জীবনের বাকিটা সময় কুমুদিনী হোমসের মাঝে থেকে যেতে চাই।
খবরের কাগজ: আপনাকে নিয়ে ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষক হেনা সুলতানা একটি বই লিখেছেন, কেমন লাগছে আপনার?
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: খুবই খুশি হয়েছি। হেনা সব সময় আমার সঙ্গেই থাকে ও খুব ভালো মেয়ে। আমি আশীর্বাদ করি ও অনেক বড় হোক।
খবরের কাগজ: দেশবাসীর জন্য কী বার্তা দেবেন?
প্রতিভা মুৎসুদ্দি: সবাইকে বলতে চাই, যে ভাষার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার সেই ভাষার যেন মূল্যায়ন হয় সব সময়।
খবরের কাগজ: ধন্যবাদ আপনাকে, খবরের কাগজকে সময় দেওয়ার জন্য।
প্রতিভা মুশুদ্দি: তোমাকেও ধন্যবাদ। আর হয়তো বা তোমাদের সঙ্গে কথা হবে না। এটা আমার জীবনের শেষ ইন্টারভিউও হতে পারে।