বিমা খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজনেস এডিটর আবু কাওসার
খবরের কাগজ: অথর্নীতিতে বিমা খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ খাতের অবদান সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সুরক্ষায় বিমা খাত অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে কাজ করছে। লাইফ ও নন-লাইফ খাতের বিমার মাধমে অর্জিত প্রিমিয়াম দেশের অথর্নীতিতে মূলধন জোগান দিচ্ছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবনের গতি যত বৃদ্ধি হচ্ছে দুর্ঘটনা তত বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে জীবন ও সম্পদের ঝুঁকিও। অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির হাত থেকে মানুষকে আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিমার প্রসার জরুরি। এই খাত যত উন্নত হবে দেশের অর্থনীতি তত মজবুত হবে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের বিমা ব্যবসা বিকাশে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো কী? এ থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: বিমা সম্পর্কে জনমনে স্বচ্ছ ধারণার অভাব, জীবন বিমার ক্ষেত্রে ধর্মীয় কুসংস্কার, বিমা বিষয়ে শিক্ষার অভাব এবং বিমার প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতাসহ অর্থনীতিতে কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বিমা ব্যবসা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য মাধ্যমিক পর্যায় থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিমার ওপর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার এবং জীবন বিমার বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্প চালু করে জনগণকে বিমায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে জীবন বিমাকে আরও সহজ করতে হবে।
খবরের কাগজ: বিমা সম্পর্কে দেশের জনগণের আস্থাসংকট রয়েছে। এর কারণ কী?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: জীবন বিমার ফান্ড বিনিয়োগের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে। যেমন ব্যাংকে বিনিয়োগ করা মেয়াদি আমানতের ওপর মুনাফা কমেছে। আগের মুনাফার হার ১৩ থেকে কমে বর্তমানে ৬ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রিটার্নে অনিশ্চিয়তা, স্থাবর সম্পত্তিতে বিনিয়োগের রিটার্ন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। এসব কারণে কোম্পানির একচুয়ারিয়্যাল ভ্যালুয়েশনে সারপ্লাস না হওয়ায় বিমা গ্রহীতাকে পলিসি বোনাস দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিমার মেয়াদপূর্তিতে দেরিতে দাবি পরিশোধ করতে হচ্ছে এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত লভ্যাংশ দেওয়া যাচ্ছে না বিধায় জনগণের মধ্যে আস্থাসংকট তৈরি হয়েছে।
খবরের কাগজ: আমাদের দেশে বিমা করার হার খুবই কম। আরও বেশি জনগণকে আওতায় আনতে হলে সরকারের কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ উপমহাদেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জীবন বিমার হার অত্যন্ত কম। ১৭ কোটি ৪২ লাখ জনসংখ্যার দেশে ৩৫টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মাধ্যমে ২০২২ সাল পর্যন্ত লাইফ বিমা পলিসির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮ লাখ ৯ হাজার ১২১-এ। প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ১১ হাজার ৪০১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ জনগণকে যদি জীবন বিমার আওতায় আনা যায়, তাহলে পলিসির সংখ্যা ও প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ অন্তত কয়েক শ গুণ বাড়বে। তবে এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জীবন বিমার প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা সম্পর্কে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দেশের সব এলাকায় সভা, সেমিনার, সুধী-সমাবেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা গেলে বিমা গ্রহীতার সংখ্যা ও প্রিমিয়ার আয় বাড়তে পারে।
খবরের কাগজ: মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বিমা খাতের অবদান উল্লেখ করার মতো নয়, এর কারণ কী বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: বাংলাদেশের বেশির ভাগ জনগণকে যেহেতু জীবন বিমার আওতায় আনা যায়নি। ফলে প্রিমিয়াম আয় কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। জিডিপিতে এই খাতের অবদান দশমিক ৫০ শতাংশও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ভারতে জিডিপিতে বিমার প্রিমিয়াম হার ৫ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে জীবন বিমাতে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং এর ক্ষেত্রও বিশাল।
খবরের কাগজ: বর্তমানে জীবন এবং সাধারণ মিলে ৭৯ বিমা কোম্পানি রয়েছে। আপনি কি মনে করেন আরও নতুন কোম্পানি আসা উচিত?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: বর্তমানে ৩৫টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি কাজ করছে। কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হলে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি করা প্রয়োজন। অন্যথায় শুধু কোম্পানির সংখ্যা বাড়িয়ে সুফল পাওয়া দুষ্কর হবে।
খবরের কাগজ: প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিমা শিল্পের অবস্থান কোথায়?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বিমা শিল্পের অবস্থান অনেক নিচে। এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল সৃষ্টির ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই এখানে কাঙ্ক্ষি সুফল পাওয়া যেতে পারে।
খবরের কাগজ: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিমা খাতে দক্ষজনবলের ঘাটতি আছে, আপনি কী মনে করেন?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞদের মতামতের সঙ্গে আমি একমত। বিমা শিল্পে দক্ষ জনবল সৃষ্টি প্রয়োজন। সে জন্য দেশ-বিদেশে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে বিমাশিল্পে একচ্যুয়ারির অভাব রয়েছে। বৃত্তি দেওয়ার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদেশে উপযুক্ত লোক পাঠিয়ে একচ্যুয়ারি বানানো প্রয়োজন।
খবরের কাগজ: প্রথমবারের মতো ব্যাংকান্স্যুরেন্স চালু হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: বাংলাদেশে সদ্য ব্যাংকান্স্যুরেন্স চালু করা একটি ভালো উদ্যোগ। মালয়েশিয়া ও অনেক দেশে এটা অনেক আগেই চালু হয়েছে। এ ব্যবস্থায় ব্যবসায় সংগ্রহ সহজ এবং খরচও কম হবে। তবে এটাকে সুসংহত করতে বিমা কোম্পানি ও ব্যাংকের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ ও ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিমা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাহলে সফলতা আসবে।
খবরের কাগজ: ব্যাংকান্স্যুরেন্স বিমা ব্যবসায় কী প্রভাব ফেলেছে?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: লাইফ ব্যাংকান্স্যুরেন্স বিমা ব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়েছে। যত দিন যাবে তত এর সফলতা বৃদ্ধি পাবে এবং বিমা গ্রহীতারা দ্রুত ম্যাচুরিটি পাওয়ার সুযোগ পাবেন। ফলে এ ব্যবস্থায় সহজে সেবা পেতে সক্ষম হবেন।
খবরের কাগজ: বিমা খাত নিয়ন্ত্রণে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলুন?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: আইডিআরএ হলো কোম্পনির সঙ্গে সেতুবন্ধ। এক কথায় আইডিআরএকে বিমা কোম্পানির আরও কাছাকাছি আসতে হবে। নিয়মিত তদারকি করতে হবে। যেসব কোম্পানি ভালো করবে তাদের উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কার দেওয়া এবং যারা খারাপ করবে তাদের আরও তৎপর হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে তিরস্কার বা জরিমানার ব্যবস্থা করা গেলে অবস্থার উন্নতি হবে।
খবরের কাগজ: এখনো অনেক খাত বিমা আওতার বাইরে। এর কারণ কী?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: বিমা কোম্পানিগুলো তাদের প্রচার ও সার্ভিস দেশে বেশির ভাগ এলাকায় পৌঁছাতে পারেনি। শুধু শহর বা উপশহরে নয়, পল্লি এলাকায়ও কোম্পানিগুলোকে কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। ব্যাংকের মতো সব এলাকায় বিমার এজেন্ট-শাখা সম্প্রসারণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
খবরের কাগজ: সাধারণ বিমায় বাকিতে ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে। এটি আইনের পরিপন্থী। এটি প্রতিরোধের উপায় কী?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: এই চর্চা শুধু বিমা বিধিবহির্ভূতই নয় বরং এতে দুর্নীতিও উৎসাহিত হয়ে থাকে। এটি বিমা ব্যবসার জন্য ক্ষতির কারণও হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে তদারকি জোরদারসহ শক্ত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
খবরের কাগজ: বিমা দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু বলুন?
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: বিমা দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের মতো বিমা দিবসও সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা শহর এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে পালনের ব্যবস্থা করা হলে এর প্রচার বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের মধ্যে বিমা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টি হবে। ফলে বিমা পলিসি গ্রহণে উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে।
খবরের কাগজ: এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।