বিমা খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এম মনিরুল আলম
খবরের কাগজ: বিমা খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
শেখ কবির হোসেন: আমাদের বিমা খাত যতটা এগোনোর কথা ছিল, ততটা হয়নি। এর কারণ মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সাল থেকেই এ খাত থমকে পড়ে। দীর্ঘ সময় একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছিল। এরপর দেশে রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই এ খাতকে আরও পশ্চাদমুখী করে। এরই মাঝে কোনোভাবে এ শিল্প টিকে ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতায় এসে গত ১৫ বছরে এ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কিছুটা এগোতে সহযোগিতা করেছেন। এখন আমরা সামনে এগোতে চাই।
তবে সমস্যা অনেক। প্রথমত, জীবন বিমাশিল্পের অস্থায়ী এজেন্ট বা প্রতিনিধি। এরা অনিয়মিত কাজ করে। আবার হঠাৎ কাজ বন্ধ করে চলে যায়। এদের কারণে গ্রাহকের প্রিমিয়াম ঠিকমতো সংগ্রহ হয়ে কোম্পানির কাছে জমা পড়ে না। ফলে কোম্পানি গ্রাহককে তার বিমা দাবি পূরণ করতে পারে না। এটিই অবিশ্বাস তৈরি করে। আস্থাহীনতা তৈরির আরও কারণ হলো কোম্পানির মালিকরা প্রিমিয়াম আয়ের অর্থ সরিয়ে নেয়। সুশাসন ও জবাবদিহি নেই বললেই চলে। কয়েকটি বিমা কোম্পানি প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। তারা হাজার হাজার গ্রাহককে প্রাপ্য টাকা দিতে পারছে না।
দ্বিতীয়ত, বিমা খাতে দক্ষ জনবলের অভাব। রেগুলেটের সংস্থার জনবল কম। বলিষ্ঠ বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে নিয়মনীতি প্রয়োগ-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা, অভিযোগ নিষ্পত্তিতে নির্লিপ্ততা বা পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ এ খাতকে আর্থিকভাবে দুর্বল করেছে। তৃতীয়ত, নীতিমালা যুগোপযোগী না করা।
আর সম্ভাবনা অনেক। সঠিক নীতিমালা ও সরকারের সহযোগিতা পেলে বিমাশিল্পের সম্মিলিতভাবে অর্জিত ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয় তিন গুণ হতে পারে। এই আয় দিয়ে সরকার মেগা প্রকল্পের অর্থায়ন করতে পারে। এতে শিল্পও উপকৃত হবে। আবার বৈদেশিক ঋণের ওপর থেকে নির্ভরশীলতাও কমবে। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর আমরা তো পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমাদের বিমা খাতের প্রিমিয়াম আয়ের টাকা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে তো বঙ্গবন্ধুকন্যার নিজস্ব উদ্যোগ ও দৃঢ়তায় অর্থের সংস্থান হয়েই গেল। পদ্মা সেতুও হয়ে গেল। দেশে আরও অনেক মেগা প্রকল্প হবে এবং সেসবের অর্থসংস্থান বিমার প্রিমিয়াম আয়ে হতে পারে। আমি সরকারকে নানাভাবে বলেছি, বিমা খাতের উন্নয়ন করুন এবং প্রিমিয়াম আয় নিয়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন।
খবরের কাগজ: বিমাশিল্পের সম্প্রসারণ বা বিকাশ হলে দেশ ও জনগণের লাভ কী?
শেখ কবির হোসেন: যে দেশের বিমাশিল্প যত বেশি বড়, সে দেশের জনগণ ও তাদের সম্পদ তত বেশি সুরক্ষিত। অন্য কথায় বলতে গেলে উন্নত দেশের জনগণ বিমাশিল্পের পলিসি ছাড়া চলেই না। তারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও জানমাল সবই বিমার আওতায় নিয়ে নেয়, যাতে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেই আর্থিক সুরক্ষা পাওয়া যায়। অর্থাৎ উন্নত দেশে জনগণ নিজেদের ঝুঁকি বিমা দিয়ে কভার করে। এতে করে বিমাশিল্প যেমন বড় হয়, তেমনি বিমা গ্রাহকও ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায়। এটি হলো জনগণের স্বার্থের কথা। রাষ্ট্রও বিমা থেকে লাভবান হয়। সরকার যদি বিনিয়োগের জন্য উত্তম ও টেকসই পথ সৃষ্টি করে দেয়, তাহলে বিমা কোম্পানি তার প্রিমিয়াম আয়ের অর্থ লোভে পড়ে মন্দ স্থানে বিনিয়োগ করবে না। যেমন, এখন অনেক নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডিপোজিট রেখে তা আটকে গেছে। এতে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানিও বসে যাওয়ার পথে।
খবরের কাগজ: নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি?
শেখ কবির হোসেন: দুঃখজনক বিষয় হলো, আইডিআরএতে একাধিক পর্যায়ে এখনো সরকারের আমলা নিয়োগ পায়। সেক্টর সম্পর্কে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকের বড় অভাব। আর অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকবল না থাকলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ভালো পারফর্ম করা কঠিন। এটি এ খাতের বড় প্রতিবন্ধকতা।
বিমানীতি যুগোপযোগী করা দরকার। সে কাজটির কোনো উদ্যোগ আইডিআরএ নিয়েছে কি না জানা নেই। সরকারকে নির্দেশ দিয়ে জনগণকে বিমার আওতায় আনতে হবে। সরকারি নির্দেশ না থাকলে এ দেশের জনগণকে বুঝিয়ে বা মোটিভেশন করে কিছু হয় না। আইন করে করতে হয়। আমরা বলেছিলাম সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হলে বিমা পলিসির কভারেজ বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাতে প্রিমিয়াম আয়ে একটা বড় উন্নতি আসবে। এ টাকা সরকারও ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু আইডিআরএ এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
এ ছাড়া বিমা কোম্পানির আইডিআরএর নিয়মিত মনিটরিং নেই। ফলে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধ না করে কিছু মালিক টাকা সরিয়েছে। তারও কোনো প্রতিকার নেই। ঠিকমতো মনিটরিং করলে তো বিমা কোম্পানির মালিকরা টাকা সরাতে পারত না। ফারইস্ট, সানলাইফসহ বেশ কিছু বিমা কোম্পানি গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এটি বিমাশিল্পের ভাবমূর্তি আরও খারাপ করে দিয়েছে। এখানে গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষায় আইডিআরএর বড় ভূমিকা পালন করার কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।
খবরের কাগজ: জাতীয় বিমা দিবস কীভাবে এল?
শেখ কবির হোসেন: বিমা খাতের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক অনবদ্য সম্পর্ক রয়েছে। বঙ্গবন্ধু একসময় পশ্চিম পাকিস্তানের আলফা বিমা কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন। তার অফিস ছিল গুলিস্তানের জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ)। সেই অফিসের নিচতলায় রেক্স নামে একটি রেস্টুরেন্টে চলত সারা দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসা রাজনৈতিক কর্মীদের আড্ডা। বঙ্গবন্ধু ওই অফিসে বসে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচি রচনা করেন। আমি তার ওই অফিসে নিয়মিত যেতাম। এরপর ধারাবাহিক আন্দোলন চলে। পরবর্তী সময়ে ৩০ লাখ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বিমাশিল্প নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় ১৫টির মতো বিমা কোম্পানি ছিল। ওগুলো একীভূত করে সরকারি জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা কোম্পানি গঠন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় বিমাশিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।
তবে দীর্ঘ সময় পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিমাশিল্প আবারও শৃঙ্খলা ফিরে পেতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর বিমা কোম্পানিতে যোগদানের দিবস মার্চ মাসের প্রথম দিনটিকে জাতীয় বিমা দিবস করতে প্রস্তাবনা নিয়ে আমি এগোই। বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেই প্রস্তাব তুলে ধরি। দীর্ঘ ধারাবাহিক দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে আমরা জাতীয় বিমা দিবসের চূড়ান্ত অনুমোদন পাই। সেই থেকে প্রতিবছর জাতীয় বিমা দিবস উদযাপন হয়ে আসছে।
আনন্দের বিষয় হলো, এবারের জাতীয় বিমা দিবসে আমরা ব্যাংকাস্যুরেন্স পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী এর উদ্বোধন করবেন। ব্যাংকাস্যুরেন্স বিমাশিল্পের জন্য একটি ভালো উদ্যোগ। এটি বিমাশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। গ্রাহকের আস্থা ফিরবে বিমায়।
খবরের কাগজ: সরকারের কাছে আপনার কোনো দাবি আছে কি?
শেখ কবির হোসেন: আমরা দেখি একটি ব্যাংক আর্থিকভাবে মন্দ হয়ে গেলে সেটি উদ্ধারে অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ অর্থ নিয়ে মন্দ ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করা হয়। আমাদের দাবি হলো, বিমাশিল্পেও এমন একটি উদ্যোগ থাকা দরকার।
খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
শেখ কবির হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।