কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, সততা, কথা দিয়ে কথা রাখার অসাধারণ গুণাবলি রয়েছে কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমানের। হাঁটিহাঁটি পা পা করে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কৃষি খাতের উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। সমাজসেবী হিসেবেও পরিচিত। তিনি বাংলাদেশ অ্যাগ্রো কেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বামা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ব্যবসা করেন দেশের জন্য, মানুষের জন্য। গড়ে তুলেছেন ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার গ্রুপ লিমিটেড ও ওয়ান ফার্মা লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠান। তিনি মনে করেন, ব্যবসায়ী সংগঠনের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা, সমৃদ্ধি ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। খবরের কাগজের ডেপুটি বিজনেস এডিটর ফারজানা লাবনীর কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান তার এগিয়ে চলার গল্প। জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীদের এবং বেসরকারি খাতের উন্নয়নে কী পরিকল্পনা নিয়েছেন।
খবরের কাগজ: নিজের ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি দেশের মানুষের জন্য, বেসরকারি খাতের জন্য এরই মধ্যে অনেক কিছু করেছেন। ভবিষ্যতের জন্য আরও অনেক কিছু করতে চান। এ বিষয়ে কিছু বলেন।
মোস্তাফিজুর রহমান: পড়ালেখা শেষ না করতেই জীবন-জীবিকার তাগিদে ব্যবসা শুরু করেছি। কঠোর পরিশ্রম করেছি। অনেক বাধা এসেছে, হার মানিনি। নতুন উদ্যমে বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছি। ব্যবসায়ী সংগঠনের মাধ্যমে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। বেসরকারি খাতের বিকাশে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের মুখপাত্র হয়ে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। আমি মনে করি, এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের জন্য, বেসরকারি খাতের জন্য অনেক কিছু করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী যোগ্য নেতৃত্ব। এফবিসিসিআইকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারলে দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমি বেসরকারি খাতের বিকাশে ভূমিকা রাখতে চাই। এ জন্য এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্বে আসতে আগ্রহী।
খবরের কাগজ: এফবিসিসিআইকে আপনি কেমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান?
মোস্তাফিজুর রহমান: দেশের অর্থনীতির বিকাশে এফবিসিসিআইয়ের ভূমিকা বাড়াতে হবে। এফবিসিসিআইকে গতিশীল করা সম্ভব হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। বেসরকারি খাত গতিশীল হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। সরকারের অর্থসংকট কমবে। দেশের উন্নয়ন প্রকল্প গতিশীল হবে। আমি এফবিসিআইয়ের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই।
খবরের কাগজ: আপনি একই সঙ্গে ওষুধ শিল্প ও কৃষি খাতের ব্যবসায়ে জড়িত। এই খাতের উন্নয়নের কীভাবে ভূমিকা রাখতে চান?
মোস্তাফিজুর রহমান: ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ ও অ্যাগ্রো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের উন্নয়নে নীতি সহায়তা দরকার। এলডিসি সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে ফার্মাসিউটিক্যাল ও অ্যাগ্রো ক্যামিক্যাল কৃষি রসায়ন শিল্প (কীটনাশক)- দুই খাতেরই গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এলডিসি সুবিধা প্রত্যাহার হলে এ দুই খাত কী ধরনের সমস্যা পড়বে, তা চিহ্নিত করে এর সমাধান করতে হবে। এলডিসি সুবিধা না থাকলে কোনো কোম্পানি যেন দুই খাতে পেটেন্ট সুবিধার অপব্যবহার করে একচেটিয়া ব্যবসা করতে না পারে, তার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। বেসরকারি খাতকেও সহযোগিতা করতে হবে। এখন দেশের ওষুধ খাতের ব্যবসা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। ১৬০টির মতো দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আমেরিকা, জাপান, জার্মানির মতো উন্নত দেশও আছে এ তালিকায়। এখনই ওষুধ ও কৃষি খাতের উন্নয়নে নজর দিলে অনেক ধরনের প্রতিকূলতা এড়ানো সম্ভব হবে।
খবরের কাগজ: কৃষি রসায়ন শিল্পের অন্যতম সমস্যা কী?
মোস্তাফিজুর রহমান: কৃষি রসায়ন শিল্পের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো বালাইনাশকশিল্প। দেশীয় বালাইনাশকশিল্প বিকাশে বিদ্যমান বিভিন্ন বাধা যেমন- সোর্স উন্মুক্তকরণ, কাঁচামালের আমদানি ও নিবন্ধন নবায়ন, সালফার আমদানি, এলসি খোলা, কাঁচামাল উৎপাদন, পেটেন্ট স্বত্ব নিবন্ধনের সরকারি ফি কমানো ও নবায়নের সময় বৃদ্ধি। এসব সমস্যা দূর করতে পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
খবরের কাগজ: এসব ব্যবসা এগিয়ে নিতে আপনার আরও কী পরামর্শ আছে?
মোস্তাফিজুর রহমান: এনবিআরের রেকর্ড অনুযায়ী বাংলাদেশে গত বছর প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফিনিশড না হয়ে শুধু এ খাতের কাঁচামাল আমদানি করত, তাহলে ১ লাখ টনের পরিবর্তে ১৫ থেকে ২০ টন আমদানি করলেই হতো। এ হিসাব আমলে এনে সরকারকে কাঁচামাল আমদানিতে আরও সুবিধা দিতে হবে।
খবরের কাগজ: দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের ভূমিকা কেমন? এ ভূমিকা বাড়াতে আপনার পরামর্শ কী?
মোস্তাফিজুর রহমান: কৃষি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি প্রদানের উপকরণ। দেশের অর্থনীতি বহুলাংশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের শ্রমশক্তি গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ শতাংশের বেশি। কৃষির উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। কৃষি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই সরকারকে বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।
খবরের কাগজ: অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে আপনি আরও কী বলবেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: বর্তমানে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সরকারকে কৃষির উন্নয়নে জরুরিভাবে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষির উন্নয়নে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার, গুণগত মানসম্পন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন, সারের মূল্য হ্রাস, সুষম সার প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বেসরকারি কোম্পানিদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বেসরকারি খাতে দেশে মানসম্পন্ন সবজি বীজ উৎপাদন করে বীজের যোগান বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
খবরের কাগজ: কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আরও গতিশীল করা দরকার। এ ছাড়া অঞ্চলভিত্তিক সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এলাকা উপযোগী ফসলের জাত উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, সেচ অবকাঠামো নির্মাণের দ্বারা সেচের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি মৎস্য গবেষণার মাধ্যমে দেশে মাছের নতুন জাত উদ্ভাবন, এসব জাতের পোনা ব্যবহার করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাবে। এসব ক্ষেত্র গতিশীল করতেও সরকারকে গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
খবরের কাগজ: গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগি পালনও কৃষির অংশ। এ সব ব্যবসা সম্প্রসারণে কী করতে হবে?
মোস্তাফিজুর রহমান: গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগি পালনের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে এ বিষয়ে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎপাদিত কৃষি উন্নয়নের নতুন নতুন পদ্ধতি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন করা সম্ভব। পতিত জমি কাজে লাগানো, এক জমিতে বছরে চার ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারলে কৃষিবিপ্লব হবে। কৃষির উন্নয়নে জলবায়ু পরিবর্তন, খরা, বন্যা, লবণাক্ততা, পোকামাকড়, পশু ও ফসলের রোগ নিরাময়ে গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
খবরের কাগজ: কৃষি খাতের উন্নয়ন হলে কী প্রভাব পড়বে?
মোস্তাফিজুর রহমান: আশা করি আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, সমৃদ্ধ ও উন্নত হবে বাংলাদেশ।
খবরের কাগজ: কৃষি খাতে শ্রমিক সংকট বাড়ছে। এ সংকট দূর করতে আপনার পরামর্শ কী?
মোস্তাফিজুর রহমান: শ্রমিক সংকটসহ কৃষি কাজের সার্বিক উন্নয়নে যান্ত্রিকীকরণ ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। আমাদের কৃষিতে যে কয়টি বড় সমস্যা আছে তার মধ্যে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়া একটি বড় সমস্যা যার ফলে কৃষকের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফসল সংগ্রহে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হলে শ্রমিকের খরচ বাঁচবে, অন্যদিকে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে শস্য ঘরে তোলা যাবে, কাজটা সুক্ষ্মভাবে হওয়ায় ফসল অপচয় কম হবে এবং দ্রুত মাঠ খালি হয়ে যাওয়ায় আরেকটি ফসলের জন্য মাঠকে তৈরি করা যাবে। এসব বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন ফসল কাটার মৌসুমে অনেক সময় শ্রমিক সংকট দেখা যায়। এতে অনেক সময় কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য থেকেও বঞ্চিত হয়। ধান কাটার আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারে শুধু ধান উৎপাদন সহজ হয় তা নয়, একই সঙ্গে এসব যন্ত্র ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হবে। এতে দেশে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ বাড়বে।
খবরের কাগজ: কৃষিপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যকরণের গুরুত্ব কেমন?
মোস্তাফিজুর রহমান: সরকারকে কৃষিপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যকরণে এবং সংরক্ষণে সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। কৃষির ওপর এদেশের অর্থনীতির নির্ভরতা অনেক বেশি। কৃষি অর্থনীতির আওতা বাড়াতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বাজার সম্প্রসারণে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এতে কৃষিপণ্য দীর্ঘ সময়ে সংরক্ষণ করা সম্ভব। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য রপ্তানিতে আশা দেখাচ্ছে। ২০২০-১১ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি ছিল ৩৩ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে উঠেছে। বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নিশ্চিতকরণ, স্বল্প খরচে উন্নত ও গুণগত মানের পণ্য ভোক্তাদের কাছে সরবরাহে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
খবরের কাগজ: আপনার ছোটবেলা, শিক্ষাজীবন নিয়ে কিছু বলুন।
মোস্তাফিজুর রহমান: আমার দেশের বাড়ি বগুড়া জেলায়। আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে গ্রাম এবং শহরে দুই জায়গাতেই। সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া থেকে। আমি এইচ এস সি পাস করার পর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বিসিএজি তে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফলতার সঙ্গে পড়ালেখা শেষ করেছি। এরপর একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পূর্ণ করার সুযোগ হয়েছিল।
খবরের কাগজ: কর্মজীবন শুরু করেন কবে?
মোস্তাফিজুর রহমান: স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার আগেই আমি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ নামক একটি উন্নয়ন গবেষণা সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমার কর্মজীবন শুরু করি।
খবরের কাগজ: কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ে কীভাবে এলেন? কেন কৃষি সম্পর্কিত ব্যবসায় জড়িত হলেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের আর্থনীতি এগিয়ে নিতে হলে কৃষি খাতের উন্নয়ন করতে হবে। কৃষক এ দেশের প্রাণ। কৃষক ভালো থাকলে, কৃষি ভালো থাকলে তবেই দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। এসব ভাবনা থেকে কৃষি উপকরণের ব্যবসায়ে যোগ দিই। এ ছাড়া বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং ব্যবসা প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষালব্ধ জ্ঞানও আমাকে এই ব্যবসায়ে সফলতা পেতে সহায়তা করে।
খবরের কাগজ: কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ে সফলতা পেতে আপনি কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: সব ভাবনা-চিন্তা শেষে ২০০০ সালের দিকে আমি অত্যাবশ্যকীয় কৃষি উপকরণ ব্যবসা করতে মনস্থির করি। ব্যবসা শুরু করার আগেই এ সংক্রান্ত জরিপ কাজ সম্পূর্ণ করেছিলাম। যেখানে এই উপকরণগুলোর মোট চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে পার্থক্য কি? প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো কীভাবে কাজ করছে? এ খাতের চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় হচ্ছে? প্রতিযোগী কোম্পানির সার্ভিস এবং পণ্যের মধ্যে গ্যাপ কী রয়ে গেছে? এদের কোনো ক্রেতা সন্তুষ্টির দুর্বল জায়গা আছে কি না? এই বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। এই ব্যবসায় যে সম্ভাবনা আছে তা কাজে লাগাতে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছি। সব কিছু যাচাই-বাছাই করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি একটি ব্যবসা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কাজ শুরু করি।
খবরের কাগজ: এদেশে এত হিসাব কষে বেশির ভাগ মানুষ ব্যবসা শুরু করেন না। আশপাশের মানুষদের দেখে বা পরিস্থিতি দেখে ব্যবসা করেন। অনেকে পারিবারিকভাবেও ব্যবসা করেন। হয়তো বাবার ব্যবসা ছেলে দায়িত্ব নেন। কিন্তু আপনি তো অন্যভাবে ব্যবসা শুরু করলেন।
মোস্তাফিজুর রহমান: প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে গবেষণা জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আমি ২০০২ সালে পণ্য নির্বাচন করে ব্যবসা শুরু করি। যে সব পণ্য কৃষকের কাছে চাহিদা আছে অথচ বাজারে নেই, সেসব পণ্য দিয়েই আমি ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার নামে একটি কোম্পানি করি। আমার প্রতিষ্ঠানের স্লোগান ঠিক করি ‘বাংলার কৃষকের কোম্পানি’। এই স্লোগান ছিল আমার ব্যবসার শক্তি। স্লোগানটি অনেকে পছন্দ করেন। ব্যবসায় শুরু করার আগেই কতগুলো বিষয় সত্য ধরে একটি ফিলোসফিক্যাল স্ট্যান্ডিং ঠিক করা হয়েছিল যেমন আমরা বিশ্বাস করতাম “Business Is All About People, Business Is Build Up On Trust & Truth Is Always Beautiful” and “Customer Is The King” এই সব তত্ত্ব জ্ঞানকে উপজীব্য করে এবং গ্যাপ মার্কেটকে টার্গেট করে আমরা নির্দিষ্ট কিছু পণ্য নির্বাচন করেছিলাম। এসবের আলোকে আমরা একটা চমৎকার কর্মী বাহিনী গড়ে তুলি। আমার প্রতিষ্ঠানের পণ্য অল্প দিনে জনপ্রিয় হয়। ক্রেতা আগ্রহ নিয়ে কৃষি উপকরণ কিনে থাকে। অনেক ভেবেচিন্তে ব্যবসা শুরু করি বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
খবরের কাগজ: ব্যবসার স্বীকৃতি পেয়েছেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: জাতীয় অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে সিআইপি পদক পেয়েছিলাম এবং ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি শিল্প উন্নয়ন পদক পেয়েছি।
খবরের কাগজ: ওষুধ ব্যবসায়ে কবে আসেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: দেশি বিদেশি স্বীকৃতির পর আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। আমাদের এই সফলতা এবং আত্মবিশ্বাস আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়। ২০১৫ সালে ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে নতুন ডাইভারসেফিকিশনে ‘ওয়ান ফার্মা লিমিটেড’ এর যাত্রা আমরা শুরু করি। ওষুধ ব্যবসায় আমাদের আসার অন্যতম প্রধান কারণ হলো এই ব্যবসার সম্ভাবনা আছে তা কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশে ওষুধ ব্যবসায় সম্ভাবনা কেমন?
মোস্তাফিজুর রহমান: সম্ভাবনার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও বিস্তৃত করা সম্ভব। বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ভালোভাবে এগিয়ে চলছে। তবে সমস্যাও আছে।
খবরের কাগজ: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওষুধ ব্যবসা কেমন চলছে?
মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। ওষুধ খাতের উদ্যোক্তাদের নীতি আদর্শ, যোগ্যতা, দক্ষতা দিয়ে সংশ্লিষ্ট খাতকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ আছে। তাই আমরা ওষুধ উৎপাদনকারী ও দেশ-বিদেশে বাজারজাতকরণের লক্ষ্য মাথায় রেখে কাজ করে চলছি।
খবরের কাগজ: আপনার এই যে সফলতার পেছনে কার কার অবদান আছে?
মোস্তাফিজুর রহমান: আমার জীবনে সফলতার পেছনে আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগকে সবচেয়ে বেশি মনে করি। এরপর আমার পরিবার। পরিবারের মধ্যে আমার স্ত্রী, আমার বড় ভাইয়ের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। বন্ধুবান্ধব এবং আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আমার বড় ভাই ও ছোট ভাইর সহযোগিতা আমি মনে রেখেছি।
খবরের কাগজ: এদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম সমস্যা কী বলে মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: ব্যবসা বাণিজ্যের মূল সমস্যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো দক্ষ ও বিশ্বাসী জনবলের অভাব। ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি হিসেবেও আমাকে একই ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত পড়তে হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। সময়ের মধ্য দিয়ে সঠিক পরিকল্পনা, কর্মী ও দল গঠনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা করতে হয়েছে।
খবরের কাগজ: ব্যবসায় সফলতা পেতে হলে আরও কী কী বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: উন্নত আদর্শ ও মূল্যবোধ সমস্যার সমাধানের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আমাদের ক্ষেত্রেও সফলতার জন্য কোম্পানির নীতি, আদর্শ, নৈতিকতা, উন্নত মূল্যবোধ আমাদের সহযোগিতা করেছে। কোম্পানির প্রধান ব্যাক্তির নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধের প্রতিফলন কোম্পানিতে সবসময় পরে। তাই আপনি যা আপনার কোম্পানির পণ্যও তাই এবং আপনি যা আপনার কোম্পানিও তাই। মানুষ উন্নত প্রানি। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সকল বিষয় বোঝার মতো ক্ষমতা যোগ্যতা দিয়েই সকল মানুষ।
খবরের কাগজ: ওষুধ শিল্প এগিয়ে নিতে আপনার আর কী কী পরামর্শ রয়েছে?
মোস্তাফিজুর রহমান: ওষুধ শিল্পকে এগিয়ে নিতে ভালো সিভিল প্রশাসন দরকার যারা দেশের চাহিদা ও দেশের প্রয়োজনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প কলকারখানার পরিচালনার নীতিমালা বিধিমালা প্রণয়নে সহায়তা করতে পারে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর পরিদপ্তরের কর্মকর্তা ব্যক্তিকেও ওষুধ উৎপাদনের অতীত ইতিহাস, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশের সক্ষমতা এবং করণীয় নিয়ে বিস্তর জ্ঞান আহরণ করতে হবে। তারপর দেশে উৎপাদিত ওষুধকে বিশ্বদরবারে কীভাবে এই শিল্পকে বিকশিত করবে সে বিষয়ে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের একটি কমপ্রিহেন্সিভ ৫ বছরের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের মূল্য বেশি প্রায়ই পত্র পত্রিকা বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ধরণের অভিযোগ শোনা যায় কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা সম্পূর্ণ উল্টো। পৃথিবীর যে কোনো দেশের উৎপাদিত ওষুধ এর চেয়ে বাংলাদেশে ওষুধের মূল্য কম। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের দেশের সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবল আছে। তবে তাদের বেতন অনেক দেশের তুলনায় কম।
খবরের কাগজ: এ খাতের উন্নয়নে আর কী করা প্রয়োজন?
মোস্তাফিজুর রহমান: উন্নত দেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশের চেয়ে আমাদের লেবার মার্কেট প্রাইস অনেক কম। এই সুবিধা নিয়েই আমরা ওষুধের মূল্য কম করতে পেরেছি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, চীন- এই দেশগুলোর চেয়েও আমাদের দেশের উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে লেবার সুবিধার জন্য। আমরা ৩৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বাংলাদেশে উৎপাদন করতে পারি। এ ওষুধই আমেরিকার বাজারে দাম হলো পাঁচ গুণ বেশি। আমেরিকা থেকে যদি এটা আমাদের দেশে আমদানি করা লাগত, তবে দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। উৎপাদন না করে বা যেকোনো দেশ থেকে আমদানি করতে হলে আমাদের কয়েক লাখ কোটি টাকার ওষুধ আমদানি করতে হতো। সে বিবেচনায় আমাদের দেশে ওষুধের মূল্য অনেক কম। ওষুধ সাধারণ কমোডেটি প্রোডাক্ট না, এটাতো উৎপাদনের প্রতিটি স্তর আপনার WHO-এর যে বিধিমালা, নীতিমালা এবং আমাদের দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সরকারের যে নীতিমালা, বিধিমালা এবং আইনের আলোকে এর যে গাইডলাইন করা হয়েছে, তার আলোকে ওষুধ উৎপাদন করতে হয়। এই গুণগত মানের যে পণ্য আপনার ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রস প্রোডাকশন করে, তার যে খরচ, সেটা কিন্তু আমাদের অনেক কম মূল্য দিতে হচ্ছে। এটার মূল্য যে অনেক বেশি, এটা সঠিক নয়।
খবরের কাগজ: আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
মোস্তাফিজুর রহমান: আমার সহকর্মীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আছে। তাদের নিজের পরিবারের সদস্য মনে করি। মনে করি, আপনার বার্জার পেইন্টস আমার আরেকটা পরিবার।
খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তাফিজুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।