মোহাম্মদ জয়নুল বারী বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআর) চেয়ারম্যান। সাবেক এই সচিব ২০২২ সালের ১৬ জুন আইডিআরে যোগদান করেন। দেশে বিমাশিল্পের গুরুত্ব কতটুকু, অর্থনীতিতে কি ভূমিকা পালন করছে, বাংলাদেশে বিমাশিল্পের বিদ্যমান পরিস্থিতি, সম্ভাবনা ও সংকটসমূহ কি- এসব বিষয় নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এম মনিরুল আলম
খবরের কাগজ: আমাদের দেশে বিমা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের ধারণা কি বলে আপনি মনে করেন?
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: এক কথায় বলতে গেলে বিমা হলো এক ধরনের প্রটেকশন বা আর্থিক সুরক্ষা। সাধারণত, জীবন ও জীবিকার সব প্রক্রিয়ায় বিমার গুরুত্ব রয়েছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা, সড়কে পরিবহন দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি, সন্তানের শিক্ষা, বাড়িঘর বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি- এসব কিছুতেই আর্থিক সুরক্ষা সেবা দিয়ে থাকে বিমা কোম্পানি। আমাদের দেশে বিমা কোম্পানিগুলো নিজেদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও অর্থ লোপাটের কারণে সময়মতো গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করতে না পারায় বিমা সম্পর্কে জনগণের মাঝে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তারপরও অনেকগুলো বিমা কোম্পানি ভালো করছে।
খবরের কাগজ: বিমাশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: আমাদের বিমাশিল্প খারাপ নেই। প্রতিবছর ৯-১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। পলিসির বিপরীতে প্রিমিয়াম আয় হয়। আর্থিক মূল্যে এর পরিমাণ বছরে ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকা। তবে জিডিপি অনুপাতে এ হার খুবই কম। গতবছর ছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের মতো। শতাংশের হিসেবে এ বছর এটি আরও কমে আসতে পারে। কারণ হলো: আমাদের জিডিপি বড় হচ্ছে। জিডিপির আকার অনুযায়ী বিমা খাতের প্রিমিয়াম আয় সামান্য। তার মানে হলো: আমাদের এই শিল্প ব্যাপক বিকাশের সুযোগ রয়েছে। তবে প্রিমিয়াম আয় কমছে না। আমি যতটুকু জেনেছি শুধু করোনা সংক্রমণের বছর ছাড়া অন্য সব বছরে বিমা খাতে প্রিমিয়াম আয় ভালো হয়েছে। আমাদের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এটি অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক।
খবরের কাগজ: বিমা খাত কি সঠিকভাবে মনিটর করতে পারছে সরকার?
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: ২০১০ সালে আইডিআরএ গঠনের মাধ্যমে বিমাশিল্প নতুন যাত্রা শুরু করেছে। আগে তো একেবারেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। এখন অনেকটা গুছিয়ে আনা হয়েছে। রেগুলেটর বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ২০১১ সালের পর এই খাতে একটু একটু করে শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
খবরের কাগজ: প্রিমিয়াম নেওয়ার পর গ্রাহককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা বা গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষায় বিমা কোম্পানি ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কি ভূমিকা হওয়া উচিত।
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: অবশ্যই এটি দায়। প্রিমিয়াম নিলেন মানে আপনি দায় নিলেন। এ দায় হলো সময়মতো বিমা কোম্পানি গ্রাহকের টাকা বা প্রাপ্য মুনাফাসহ প্রশ্নাতীতভাবে ফেরত দিবে।
নেতিবাচক দিকটা হলো, অনেক গ্রাহক সময়মতো বিমা দাবি ফেরত পাচ্ছে না। এ কারণে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আস্থা ও বিশ্বাস হারাচ্ছে। যে একবার বিমা করে তার প্রাপ্য টাকা ফেরত পায়নি, সে তো আর বিমার সেবা নিবে না। এ খাতে আর ফিরবে না। বরং অন্যদের তার বঞ্চনার কথা বলবে। এতে সম্ভাবনাময় গ্রাহকরা উৎসাহ হারাবে। এটিই হচ্ছে আমাদের এখনকার বিমাশিল্পের বাস্তবতা। এর কারণ হলো কতিপয় বিমা কোম্পানি নিজেরা প্রিমিয়াম আয়ের অর্থ সরিয়েছে বা মন্দ বিনিয়োগ করেছে। আবার কোনো কোম্পানি অধিক মুনাফার আশায় শেয়ারবাজার বা নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত শেয়ারের দরপতন হয়েছে বা ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠান মন্দ গ্রাহকের কাছে বিনিয়োগ করেছে। এতে করে বিমা কোম্পানি টাকা উদ্ধার করতে পারেনি। গ্রাহককে টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। এমন অভিযোগও আমরা পেয়েছি যে, বিমা কোম্পানির মালিকরা ব্যক্তিগত জমি কিনেছে, গাড়ি, বাড়ি কিনেছে প্রিমিয়াম আয় দিয়ে। তারা তো বিনিয়োগ করেনি।
হাজারো অভিযোগ আমাদের কাছে আসে, বিমা দাবির টাকা ফেরত পাচ্ছে না গ্রাহক। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে আমরা নিয়মনীতির মধ্যে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ওয়ান টু ওয়ান আলোচনার উদ্যোগ নিয়েও সমাধান পেতে গ্রাহককে সহযোগিতা করে যাচ্ছি।
খবরের কাগজ: সাধারণ বীমার সেবা নিয়ে কিছু বলুন। কোম্পানিগুলো বাকিতে প্রিমিয়াম ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো ঠিকঠাক চলছে। বাকি ব্যবসাও এক ধরনের ব্যবসা। এটা গ্রাহক ও সেবাদাতার মধ্যে বোঝাপড়ায় হয়ে থাকে। এ খাতে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। যত অভিযোগ, ক্ষোভ সব জীবন বিমায়।
খবরের কাগজ: স্বাস্থ্য বিমা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: জীবন বিমা কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্য বিমায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে পারেনি। এর কারণ হলো নীতিমালার অভাব। এত দিন একটি সার্কুলার দিয়ে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোকে শুধু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিমা করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। আমি আসার পর সেটা প্রত্যাহার করেছি। বর্তমানে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিমা পলিসি বিক্রিতে কোনো বাঁধা নেই। তবে এ বিমা পলিসিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটা ভূমিকা রাখার প্রয়োজন আছে। এবার আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। কারণ একজন গ্রাহক কোন রোগের চিকিৎসায় কতটুকু আর্থিক সহায়তা পাবে, তার মেয়াদ কত দিন হবে, সেসব বিষয়ে নীতিমালা দরকার আছে।
খবরের কাগজ: এ দেশে ব্যাংকান্স্যুরেন্স একটি নতুন বিষয়। এটি বিমা ব্যবসায় কি প্রভাব ফেলবে?
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: ব্যাংকান্স্যুরেন্স একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমি মনে করি এটি বিমাশিল্পে বৈপ্লবিক না হলেও বিশাল পরিবর্তন আনবে। কারণ বিমা কোম্পানির ওপর আস্থার সংকট থাকলেও ব্যাংকের ক্ষেত্রে সেটা নেই। ব্যাংক গ্রাহকদের একটি বড় অংশ বিমার বাইরে রয়েছে। এদের কাছে বিমা এজেন্টরা পৌঁছাতে পারে না। সুতরাং প্রতিটি ব্যাংক কর্মকর্তা তার গ্রাহককে বিমা পলিসি গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ করতে পারবে। আর এখানে প্রিমিয়াম আয় বকেয়া পড়ার সম্ভাবনা নেই।
একটি কথা না বললেই নয় যে, ব্যাংক হলো বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে বিমা এজেন্টরা অনিয়মিত। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে ক্রয় করা পলিসি নিয়ে গ্রাহক আগের মতো শঙ্কায় থাকার বিষয়টা দূর হয়ে যাবে। পলিসির মেয়াদ শেষে দাবিকৃত টাকাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে চলে যাবে। এটিই বড় পরিবর্তন আনবে বিমাশিল্পে।
খবরের কাগজ: এবার জাতীয় বিমা দিবস উদযাপন সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: ১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবসে রাষ্ট্রপতি থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী এ দিবসে উপস্থিত থাকবেন। তিনি এ দিন ব্যাংকান্স্যুরেন্স উদ্বোধন করবেন। সারা দেশে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়েও এ দিন নানা কর্মসূচি পালন করা হবে।
খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ জয়নুল বারী: আপনাকেও ধন্যবাদ।