উপজেলা পরিষদ থেকে সোনাখালি মাঠের প্রকৃত দূরত্ব সম্পর্কে জজসাহেবের আদৌ কোনো ধারণাই ছিল না। স্থানীয় মানুষজন বলে, দূর কোথায়! এই তো শহর থেকে বেরোলেই বসন্তপুর, তারপর সোজা উত্তরে যতদূর চোখ যায় সোনাখালি মাঠ। সেই বিরান মাঠের এক প্রান্তে খোদাবক্স সাঁইজির আখড়া। নিজের অফিসের পাইকপেয়াদা সেরেস্তাদারও জানায়,
-না, সোনাখালি মাঠ এখান থেকে বিশেষ দূরে নয়। বড়োজোর মাইল তিনেকের পথ। কিন্তু স্যার কেন সেই মাঠে যাবেন? কী আছে সেখানে?
জজসাহেব নিঃশব্দে এক চিলতে হাসেন। তারপর কদমছাঁট দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন,
-কিছুই নেই?
সোনাখালি মাঠ তো শুধু নামেই মাঠ। আসলে নিচু এলাকা। আগেকার মানুষ এখনো বলে সোনাখালির বাঁওর। কেউ কেউ বলে বড় বিল। দাপ্তরিক কাজকর্মের বাইরে জজসাহেবের সঙ্গে এমন ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগ পেয়ে সেরেস্তাদার নিজের এলাকার ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক চিত্র ফুটিয়ে তোলে-
-এখনো বর্ষাকালে চারদিকে জল থইথই করে। সাদা ফকফকা। সে যে কী সৌন্দর্য! এখন এই শুকনোর দিনে আপনি সেখানে কী দেখতে যাবেন স্যার?
জজসাহেবের সংক্ষিপ্ত জবাব,
-দূরে যখন নয়, চলুন সবাই মিলে একবার বেড়িয়ে আসি!
সেরেস্তাদার আর কী বলবে! আকারে-ইঙ্গিতে ঢের বলা হয়েছে, আর কত প্রতিবাদ করা যায়! পদমর্যাদার দূরত্বের কথা তো ভুলে গেলে চলবে না। অকারণে সে জজসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটি কেমন যেন অন্যরকম। আগের জজসাহেবের ঠিক উল্টোটি। জজ তো ঠিক নয়, উপজেলা হওয়ার পরপর মুন্সেফকোর্ট উঠে গিয়ে সেটারই কেতাবি নাম হয় সহকারী জজ আদালত। আগের সাহেব ওই শব্দযুগল খুব অপছন্দ করতেন। জজ মানে তো জজ, তার আবার সহকারী-টহকারী কী! মানুষটা ছিলেন আগাগোড়া কৃত্রিম মানুষ, শো-কেসের পুতুলের মতো সাজানো-গোছানো। সেই তুলনায় নতুন জজসাহেব একেবারে খাঁটি মানুষ, অহংকারের বালাই নেই, মানুষকে প্রথমে মানুষ বলেই গণ্য করেন, তারপর অন্য পরিচয়। সমাজে মুখ পায় না যে সামান্য ন্যাড়ার ফকির খুদু শাহ (খোদাবক্স সাঁইজিকে সবাই এই নামেই চেনে), প্রকাশ্য আদালতে তাকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুললেন, আবার শেষ পর্যন্ত তাকে পাগলও বললেন। কে যে আসল পাগল, কে বলবে সেই কথা! সেরেস্তাদারের সন্দেহ, জজসাহেব সেই আখড়ায় যেতে চাইছেন না তো! এ সংশয় মনে চেপে রেখে প্রসঙ্গটিকে একটু ঘুরিয়ে সে অন্যভাবে উপস্থাপন করে-
-স্যার তা হলে বিরান মাঠ দেখতেই চাইছেন!
-আহা, চলুন না এক বিকেলে ঘুরে আসি।
ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানায়,
-জি স্যার, তাই হবে।
-শাসনব্যবস্থা-বিচারব্যবস্থা এখন সব নেমে এসেছে গ্রাম পর্যন্ত। গ্রাম না চিনলে চলে!
-জি স্যার। কিন্তু গ্রামে যাবেন কীসে?
অবলীলায় জানান,
-কেন, হেঁটে! এক চিলতে হেসে যোগ করেন, শ্রীচরণ ভরসা।
জজসাহেব হাসলে সেরেস্তাদারের খুব ভালো লাগে। ফুল ফোটার সৌন্দর্য দেখতে পায় যেন-বা। হিন্দু পরিবারে জন্ম, তবু কী চমৎকার মোগলাই কায়দায় দাড়ি রেখেছেন। গৌরবর্ণ গোলগাল মুখমণ্ডল যেন বর্ষার কদম হয়ে ফুটে থাকে সারাক্ষণ। কেমন সহাস্য ভঙ্গিতে বলতে পারেন, শ্রীচরণ ভরসা। সরকার কোর্টকাচারি এনে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছে, অথচ জজসাহেবের যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থাই করেনি। উপজেলায় সরকারি গাড়ি বলতে এক ইউএনও সাহেবের জন্য আছে একটা। তা নিয়ে এই সহকারী জজ সাহেবের কোনো আক্ষেপ-অনুযোগ নেই। কত সহজেই শ্রীচরণ ভরসা বলতে পারেন। শুনতে ভালো লাগে, তবু সেরেস্তাদার কাঁচুমাচু মুখে বলে,
-আপনি অনুমতি দিলে ইউএনও স্যারের গাড়ির কথা বলতে পারি।
-আপনার কি মনে হয়, এ অনুমতি আপনি পাবেন আমার কাছ থেকে?
সেরেস্তাদার নীরব।
-তিন মাইল পথ আমরা হাঁটতে পারব না?
-স্যার আসা-যাওয়ায় তিন দুগুণে ছ-মাইল।
-ছোটবেলায় ছ-মাইল দূরের স্কুলে হেঁটেই যাওয়া-আসা করেছি, বিশ্বাস হবে?
-সে এক সময় ছিল স্যার। এখন কি পারবেন?
হা হা করে হেসে ওঠেন জজসাহেব। বলেন,
-হ্যাঁ, এখন জজসাহেব হয়েছি তো! তবু চলুন, একদিন বেরিয়ে পড়ি।
-জি স্যার।
-তারপর পথে নেমেই বোঝা যাবে পথের মাপ।
এত কথার পরও সোনাখালি মাঠের উদ্দেশে রওনা হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে সেরেস্তাদার শেষবারের মতো বিনীত প্রস্তাব রাখে-
-রিকশা নিলে হয় না স্যার?
-রিকশা! রিকশা কী হবে?
বিরক্তি এবং বিস্ময় দুই-ই যুগপৎ ছলকে ওঠে জজসাহেবের কণ্ঠে,
-রিকশা কি ওই মাঠের মধ্যে যাবে? পদ্মপুকুর পর্যন্ত যাবে?
সেরেস্তাদার হাত কচলে জানায়,
-না স্যার, তা যাবে না। অন্তত বসন্তপুরের শেষমাথা পর্যন্ত যাওয়া…
-না, তার কোনো দরকার নেই।
একটুখানি থেমে অতিদ্রুত এক পলকে সেরেস্তাদারের চোখমুখ পরখ করে বলেন,
-কষ্ট মনে হলে আপনি না হয় না-ই গেলেন। আমি পাইক-পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে একবার ঘুরে আসি।
ভয়ানক লজ্জা পেয়ে যায় সেরেস্তাদার। সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে জানায়, বেয়াদবি মাফ করবেন স্যার। আমার আবার কষ্ট কীসের! আপনার সঙ্গে থাকব এই তো আমার আনন্দ।
সেই আনন্দ-পদযাত্রা শুরু হয় চৈত্র মাসের এক পড়ন্ত বিকেলে ঘড়ির কাঁটার বিকেল বটে, তবু মাথার ওপরে তরবারি ঝলসানো রোদ্দুর। ছাতায় খানিকটা মাথা বাঁচায়, কিন্তু সারা শরীর ঘেমে-নেয়ে একশেষ। তবু কিছুতেই যেন ভ্রুক্ষেপ নেই জজসাহবের। কীসের এক দুর্বার আকর্ষণে তিনি মেঠোপথে কখনো আইল ধরে হেঁটে চলেছেন, কখনো-বা রুক্ষ মাঠেই পা চালিয়ে চলেছেন। সারা মাঠ থেকে চৈতালি ফসলও তোলা হয়ে গেছে। ফলে বিস্তীর্ণ মাঠ খা খা করছে। এমন সবুজশূন্য বুকফাটা মাঠ বুঝি আর হয় না। জজসাহেব হঠাৎ পেছনে ফিরে সঙ্গীদের কাছে জানতে চান,
-পদ্মপুকুরটা আর কত দূরে?
একজন আঙুল তুলে সামনে দেখায়-
-ওই যে দূরে তালগাছ দেখা যাচ্ছে, ওইখানে। পুকুরপাড়েই তালগাছ। ওই যে-
ভালো করে তাকাতেই চোখে পড়ে, কে যেন হাত উঁচিয়ে দ্রুতপায়ে এদিকে আসছে। তার ঊর্ধ্বমুখী ডান হাতে ওটা কি একতারা? জজসাহেব জানতে চান-
-কে ওটা, খোদাবক্স সাঁইজি নাকি?
সেরেস্তাদার বলে,
-জি স্যার, খুদু শা-ই তো মনে হচ্ছে।
-ওই পুকুরপাড়েই তার বাড়ি?
-না স্যার। ওর আখড়া তো আরও দূরে, এই মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে।
পেছনে থেকে আরও এক পেয়াদা যোগ করে,
-বাড়ি তো নয় স্যার, যত সব গাঁজাখোর ফকিরের আখড়া। ওরা সবাই কুতুবউদ্দিন পীরের মাজারটাই অপবিত্র করে দিল। মাজার-রক্ষক না ছাই। ভণ্ডামি আর ভণ্ডামি।
জজসাহেব একবার পেছন ফিরে তাকান। চোখে চোখ পড়তেই এতক্ষণের বক্তা চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পা চালায়। আরও কয়েক পা যাওয়ার পরে তিনি প্রশ্ন করেন,
-তুমি কি কখনো গিয়েছ ওর আখড়ায়?
নিম্নকণ্ঠে উচ্চারিত হয়,
-না স্যার।
-বাপরে বাপ! ওখানে না গিয়েই এত অভিজ্ঞতা তোমার?
অপর পেয়াদাটি কোনো কিছু না বুঝেই তাকে সমর্থন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে,
-ওখানে যাবে কী করে স্যার! ওখানে তো রীতিমতো অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ চলে। ওরা হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য মানে না স্যার, এমনকি নারী-পুরুষকেও আলাদা চোখে দেখতে জানে না। এই পর্যন্ত বিবরণ দিয়ে পেয়াদাটি একটু দম নেয়। তারপর সেরেস্তাদারের চোখ ইশারার অর্থ না বুঝে আবার বকবকানি শুরু করে-
-ওরা গানের মধ্যে কী বলে শোনেননি স্যার? ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নরী লোকের কী হয় বিধান। কেমন বিটকেলে প্রশ্ন দেখেছেন?
জজসাহেব পরিহাসতরল কণ্ঠে বলেন,
-বাবা, ওই সব বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞান তো আপনার মোটেই কম নয় জনাব! তা কতদিন ছিলেন ওদের আখড়ায়?
এতক্ষণে বক্তা নীরব। কী ভেবে দাঁতের তলে জিভ কাটে। একটু সময় নিয়ে বিনয় বিগলিত কণ্ঠে বলে,
-ওখানে কোনো ভদ্রলোক যেতে পারে না স্যার।
জজসাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে জানান,
-কিন্তু আমাদের যে একবার যেতেই হবে সেই আখড়ায়।
-আপনি যাবেন স্যার!
-জি আমি যাব। আমার সঙ্গে আপনারাও যাবেন।
-নিশ্চয়ই যাব স্যার। সে তো আমরা কাজের তাগিদেই যাব।
হঠাৎ কী মনে করে জজসাহেব হা হা করে হেসে ওঠেন। আদালতে থাকাকালে সাধারণত এ রকম প্রাণখোলা সরব হাসি শোনা যায় না। সেরেস্তাদার খুব অবাক চোখে তাকায় জজসাহেবের মুখের দিকে। তারপর সাবধানে মন্তব্য করে,
-আপনাকে দেখে খুদু শাহ কেমন খুশি তা দেখেছেন স্যার?
খুদু শাহ মানে খোদাবক্স সাঁই এখন খুব সামনে চলে এসেছে। দেখে মনে হয় যেন এইমাত্র আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো ভিনগ্রহের মানুষ। আবার মনে হয় পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সংবেদনকাতর সামান্য মানুষ। অক্ষিকোটরের খোঁড়লে ডুবে যাওয়া দুচোখে তার দূরের তৃষ্ণা। অথচ নিভু নিভু সেই চোখে অসম্ভব প্রাখর্য ফুটিয়ে এবং মেরুদণ্ড খাড়া করে দৃঢ় পায়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বিনম্র ভক্তি জানায়।
কণ্ঠে তার ফুটে ওঠে বিমুগ্ধ বিস্ময় এবং বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস-
-হুজুর, আপনি সত্যিই এতদূরে এই বিরান মাঠের মধ্যে চলে এলেন?
-হ্যাঁ এলাম। আমি তো একা নই, এই যে আমরা সবাই এসেছি।
-আমার মন বলেছে আপনি একদিন আসবেন হুজুর, আপনার বুকে খাঁটি সোনা আছে যে!
-আচ্ছা খুব হয়েছে। আপনি এখানে কী করছেন?
খুদু শাহের ঠোঁটে বিনম্র হাসি-
-ওই যে পুকুর পাহারা দিচ্ছি।
সেরেস্তাদার দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে-
-তবু যদি পুকুরটা নিজের হতো, সেও এক কথা ছিল। পুকুর পাহারা দিচ্ছে!
খাটো কথাও কানে যায় সাঁইজির। এক গাল বিগলিত হাসি ছড়িয়ে সে জানায়,
-নিজের নয় বলেই তো পাহারায় আছি। দিতে হয় জান দেব, কিন্তু পানি দেব না পুকুরের। সাফ কথা, হ্যাঁ।
এবার একজন পেয়াদা এগিয়ে এসে বলে,
-পানি দেব না বললেই হবে!
-বললাম তো, এক আঁজলাও পানি দেব না।
জজসাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। হিসেব মেলাতেই পারেন না লোকটির এত দৃঢ়তার উৎস কোথায়! নিজের নেই জমি-জিরেত, ওই পুকুরও তার নয়, তবু সে পুকুরের পানি কাউকে নিতে দেবে না। এমনকি পুকুরের মালিককেও দেবে না। এই তো কদিন আগে তার এই গোঁয়ার্তুমি দেখে আদালতের ভাবগাম্ভীর্য ভেঙে অনেকেই হাসাহাসি করেছে, কেউ কেউ বলেছে- পাগলামি আর বলে কাকে! জজসাহেবেরও মনে খটকা লেগেছে, তবু নিছক পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি। তাই তিনি উকিলের সাহায্য ছাড়াই সোজাসুজি সাঁইজির বক্তব্য শুনতে চান, আহ্বান জানান,
-বলুন, আপনার যা বলার আপনিই বলুন। শুনি আপনার কথা।
সাঁইজির সেই একই কথা, পুকুর থেকে কাউকে পানি নিতে দেবে না।
প্রতিপক্ষের উকিল প্রশ্ন করেন-
-ওই পুকুরের মালিক কে?
সাঁইজি অতি সহজেই জানায়,
-পুকুরের মালিক আলী হোসেন, সে তো সবাই জানে।
-তা সেই আলী হোসেন পুকুর থেকে পানি সেচে তার নিজের জমিতে নিতে পারবে না?
নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে জানিয়ে দেয়,
-না।
-যার পুকুর তারই জমি। সেই জমিতে ফসল ফলানোর জন্য নিজের পুকুরের পানি নিতে পারবে না আলী হোসেন?
বজ্রপতনের মতো উচ্চারিত হয়,
-না।
উকিল সাহেবের তখন হিতাহিত জ্ঞান হারাবার দশা। চিৎকার করে ওঠেন,
-এটা কি মগের মুলুক? আইনকানুন নেই?
সাঁইজির কণ্ঠে সহসা ছলকে ওঠে উত্তেজনা। আঙুল তুলে সে ঘোষণা দেয়,
-লাশ পড়ে যাবে হুজুর। আমার লাশ ডিঙিয়ে তারপর পুকুরের পানি নিতে হবে। এই আমি প্রকাশ্যে বলে দিলাম।
চমকে ওঠেন জজসাহেব, বলে কী এই লোকটা! কোন অধিকারে বলে! এতটা জোর সে পায় কোথায়! খুবই সঙ্গত কারণে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে এসব প্রশ্নও ওঠে আদালতে। তখন বড় অদ্ভুত বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয় সাঁইজির চেহারায়। উত্তেজনার লেশমাত্র চিহ্ন নেই তার চোখেমুখে। গভীর অনুভব থেকে সে উচ্চারণ করে,
-সে-কথা তো বলে বোঝানো যাবে না হুজুর। আমি মূর্খ মানুষ, আমি কি সব কথা বোঝাতে পারি! সোনাখালির বিরান মাঠের মধ্যে গিয়ে পদ্মপুকুর দেখলে হুজুর নিজেই বুঝবেন, ওই পানি কি দেওয়া যায়!
আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের কাছে খোদাবক্স সাঁইজির আকুল আবেদন, ওই পুকুরের ওপরে ১৪৪ ধারা জারি করা হোক। একেবারে সহজ-সরল মন্তব্য তার, আমি আর কদ্দিন পাহারা দেব হুজুর! বুড়ো মানুষ, আমি কদ্দিন ঠেকিয়ে রাখব? আমাকে মেরে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। তখন আর পানি সেচে মাঠে নিতে বাধা দেবে কে!
আদালতে উপস্থিত অনেকেই হতাশ হয়। পাগলের পাগলামি আর কতক্ষণ ভালো লাগে! অথচ অপরিসীম ধৈর্য বিচারকের। চশমার আড়াল থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এই পাগল বাউলকে। সাঁইজি ততক্ষণে দুচোখ মুদে অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে গান ধরেছে, ফকির লালন ম’লো জল পিপাসায় গো…।
এই গানের সুরে সম্মোহিত হয়েই হোক অথবা বিচারকার্যে প্রাসঙ্গিক ভেবে হোক, জজসাহেব হঠাৎ জানতে চান,
-আপনি কি ওই পুকুরের পানি পান করেন?
-না হুজুর।
বিচারকের বিস্ময়ের অবধি থাকে না।
সেদিন আদালতে এর বেশি আর কথা এগোয় না। কীভাবে এগোবে? এরপর তো অনিবার্য সেই একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে চলে আসবে, তাহলে কেন পুকুরের মালিককে পানি নিতে দেবেন না? সে কি আপনার শত্রু? এমন প্রশ্ন আগেও উঠেছে কয়েকবার। প্রতিবারই উত্তর আসে ভয়ানক গোলমেলে। এবারও সে উদার ঘোষণা দিয়ে জানায়,
-আলী ভাই শত্রু হতে যাবে কেন? তার মতো ভালো মানুষ তো হাজারেও মেলে না।
-তাহলে?
না, আর কোনো প্রশ্ন নয়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তও নয়।
খোদাবক্স সাঁইজিকে অনুসরণ করে মাঠের আইল ধরে এগিয়ে চলে জজসাহেবের দলবল। রৌদ্রের দাহ কমেছে, আলো কমেনি। পদ্মপুকুরের পাড়ে জোড়া তালগাছ এবং অসংখ্য বুনোবাবলার ডালে ডালে ঘরে ফেরা পাখির কিচিরমিচির ভিন্ন এক জগতের হাতছানি দেয়। বেলা শেষে ঘরে ফিরছে গরুর দল। না, ঘরে ফেরার আগে গরু-ছাগল-ভেড়া দলবেঁধে হইহুল্লোড় করতে করতে এসে নামছে পদ্মপুকুরে। সবাই মিলে পানিতে নাকমুখ চুবিয়ে যেন সারা দিনের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। সবটুকু পানি যেন তারা এক টানে শুষে নেবে এরই ফাঁকে এক জোড়া গাঙশালিক ডানা উল্টিয়ে স্নান সেরে নেয়। বেশি তো পানি লাগে না তাদের। একে অপরের গায়ে খানিকটা ছিটিয়ে দিতে পারলেই হলো। স্নান শেষে তারা শেষ বিকেলের রোদে গা শুকিয়ে নিতে চায়। সেই জন্য উড়ে এসে বসে প্রকাণ্ড দুই মোষের পিঠে। ওদের আবার দুই রকমের তৃষ্ণা। পেটের তৃষ্ণা, পিঠের তৃষ্ণা।
সারা শরীর পানিতে না ডোবালে ওদের শান্তি নেই। ওরা নড়েচড়ে উঠতেই পিঠের ওপর থেকে শালিকজোড়া উড়ে যায়, ঠোঁটে পুটিমাছ ঝুলিয়ে এবার এসে বসে এক মাছরাঙা। তার খুব ইচ্ছে মোষের পিঠে বসেই ঠোঁটের শিকার সে আহার করবে। হায় নির্বিবাদী প্রাণী, তার বুঝি কারও বিরুদ্ধে নালিশও নেই।
পুকুরপাড়ে এসে চোখ জুড়িয়ে যায় জজসাহেবের।
পাইকপেয়াদারা ভেবেই পায় না, দেখার মতো কী আছে এই পদ্মপুকুরে। হ্যাঁ বিরাট মাঠের মধ্যে এ এক বিরাট পুকুর। চোত-বোশেখেও একবুক পানি। নিশ্চয় পুরোনো মাছও আছে। কিন্তু তাদের সাহেব কি হুইল কিংবা ছিপ ফেলে মাছ ধরতে এসেছেন এই তেপান্তরের মাঠে! তিনি আছেন খুদু শার জগৎ ভোলানো তত্ত্বকথার ঘোরে। কখন যে তার ফেরার মর্জি হয় কে জানে!
এ দেশের গ্রাম জনপদে স্বাভাবিক খবরও অস্বাভাবিক দ্রুততায় ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে। জজসাহেব পায়ে হেঁটে শহর ছেড়ে গ্রামে এবং গ্রাম ছেড়ে মাঠে বেড়াতে বেরিয়েছেন, এ খবরও দ্রুত চাউর হয়ে যায়। ফলে আরও অনেক গ্রামবাসীর সঙ্গে পুকুরমালিক আলী হোসেনও ছুটে আসে সোনাখালির মাঠ ভেঙে পদ্মপুকুরের পাড়ে। পানি খেয়ে ফিরে আসা গরুর পালের মধ্য থেকে এক বেয়াড়া এঁড়ে কী ভেবে কে জানে শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসে আলী হোসেনের দিকে। কৌশলে নিজেকে রক্ষা করে সে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ায় জজসাহেবের সামনে। হাত তুলে সালাম জানায়। চোখ রগড়ে অবাক চোখে তাকায়। তারপর অতিদ্রুত দড়বড় করে বলে,
-দ্যাখেন স্যার, এই পুকুর আমার। পুকুরপাড়ের এই জমিও আমার। আকাশে বৃষ্টির লক্ষণ নেই। আমার পুকুরের পানি দিয়ে আমি-
বাক্য শেষ হয় না আলী হোসেনের। হঠাৎ জজসাহেব মাঝপথে বলে বসেন,
-আচ্ছা, এই গরু-বাছুরগুলো কার?
-গরু-বাছুর! এতক্ষণ যেন সে গরু-বাছুর দ্যাখেইনি। ডাইনে বামে গরুর পাল দেখে নিয়ে সে জানায়,
আমাদের। মানে আমাদের সবারই আছে গরু-বাছুর। সারা দিন মাঠে মাঠে চরে খায়। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরে।
-বুঝলাম। জজসাহেব জানতে চান,
-এর মধ্যে সাঁইজির কোনো গরু-ছাগল আছে?
আলী হোসেন এবার ফিচিক করে হেসে ওঠে, হাসির মধ্যেই জানায়,
-ও হলো ফকির মানুষ, গরু-ছাগল কোথায় পাবে স্যার?
-অথচ ওই ছাগল-গরু, পাখপাখালির জন্য তার দরদ কতখানি দেখেছেন?
-দরদ! আলী হোসেন ভাবতেই পারে না-
-ওর দরদ কেন?
জজসাহেব এমন বেমক্কা প্রশ্ন যেন আশাই করেননি। তাই সহসা কোনো জবাবও হাতড়ে পান না। ভেতরে চিনচিন করে ক্রোধ। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে তিনি বলেন,
-নিজের প্রাণ বাজি রেখে সে আপনার পুকুরের পানি আগলে রাখে আপনাদেরই গরু-ছাগলের জন্য, আর রাজ্যের পাখপাখালির জন্য। অকৃত্রিম এই দরদ কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারেন?
শেষ বিকেলের আলোর আলোয় কিংবা অন্তর্গত কোনো অচেনা ক্ষোভে জজসাহেবের চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে। যা ভেবেই হোক সেরেস্তাদার দম করে প্রস্তাব দিয়ে বসে-
-বেলা পড়ে এলো স্যার, আমাদের বোধ হয় ফেরা দরকার।
জজসাহেবও বলেন,
-হ্যাঁ, ফেরা দরকার। কিন্তু সাঁইজি কই?
খোদাবক্স সাঁইজি তখন বেশ খানিক দূরে। হাতের একতারাতে সে গান ধরেছে-
-কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে গায়, আমি বসে আছি আশার সিন্ধুর পারেতে সদাই।
শূন্য মাঠে সাঁইজির কণ্ঠ ঘুরে ঘুরে বিলাপ করে, হাহাকার মর্মরিত হয়। সে হাহাকার কেউ শোনে, কেউ শোনে না।