ঢাকা ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, শুক্রবার, ৩১ মে ২০২৪

শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার
অলংকরণ: মাসুম

গত সংখ্যার পর

দিনের বেলা লেজঝোলা পাখিটি নেই, কিন্তু ডানাভাঙা কাকটি উড়ে বাইরে যাবে, সে সুযোগ নেই, তাই সে আছে যথারীতি। আর আছে উঠোনজুড়ে গগনশিরীষের ছায়া, কচি ফুলসহ চালতা ফুলের দুলুনি। উঠোনজুড়ে প্রকৃতির মায়ায় ছায়ায় দুজনের হঠাৎ খেয়াল হলো, এভাবে তাকিয়ে থাকতে নেই।

রুকুই বলল প্রথম, চলুন ভেতরে গিয়ে বসবেন। 

কিন্তু মৃদুল ভেতরে গেল না। বলল, বাহ্ বাইরে তো বেশ চমৎকার পরিবেশ, তা ছাড়া রান্নাও হবে বাইরে, এখানেই বসি। বলেই গগনশিরীষের ছায়ায় কুরবানির জন্য প্রস্তুত করা চুলার পাশে বসে পড়ল সে। 

আমলকী-বহেরা দিয়ে বানানো রুকুর হাতের চা খেল তৃপ্তির সঙ্গে। কিন্তু রুকুদের আর্থিক অবস্থা টের পেতে মৃদুলের বেশি সময় লাগল না। তবে এই অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি এই গরিবালয়ে কেমন করে থাকে, কেমন করে সে এইসব অতিক্রম করে একদিন তার পাশে হাঁটবে, আঁচল ভেজাবে শিশিরের জলে- এইরকম হাজারো চিন্তা তাকে অবশ করে ফেলল। 

বেতের মোড়ার ওপর চুলার ওপাশে বসে ছিল রুকু, তার ডান পাশে পেছনে একটি পুঁইডগা লতিয়ে উঠেছে। আর ওপরে চালতার নতুন কুঁড়ি। সেও ভাবছিল স্বপন, কল্পনা সবই ঠিক ছিল। কিন্তু বাস্তব, তার সামনে বিরাজমান বাস্তব মানুষটি যে ধনীর দুলাল তা এক নজরেই বুঝে নিল সে, তবুও তার এক মন বলল, কোনো একদিন সে সমস্ত বাধা লঙ্ঘন করে তার কাছে আসবে, বসবে ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্বে। 

বেলা বেড়ে যাচ্ছিল পৃথিবীতে। 

রুকু বলল, তার বাবা কবি মানুষ, তিনি পশু কুরবানির পক্ষে নন, পক্ষে নন টিভির রাঁধুনি প্রতিযোগিতারও। তাই অনেক কষ্টে মাংস জোগাড় করতে হয়েছে। জোগাড় করেছে কিছু মসলাও। এখন বাবা গেছেন বাকি মসলা আনতে। ভয় হচ্ছে, মসলা আনতে গিয়ে যদি দিন ফুরিয়ে যায় কেমন করে রান্না হবে। কবি মানুষের মর্জি বলে কথা। 

মৃদুল হাসে, তবে কিছুই কি বুঝতে পারে না সে! আর রুকুও! নিজের বানানো কথায় নিজেই আশ্চর্য হয়ে পড়ে। 
মৃদুল বলে সমস্যা নেই, যা আছে তাই দিয়ে রান্না হবে। মসলা নয়, রাঁধুনির হাতের গুণই আসল। 

দুজন দুজনার দিকে আবার তাকায়, বারবার তাকায়। সেখানে সত্য-মিথ্যা, ভালো লাগা, ভালোবাসা, কাছে আসা দূরে যাওয়ার সমস্ত কিছুর এক মিলিত কটাক্ষ দুজনার চোখে-মুখে খেলা করে যায়। দিনের আলো সরে গিয়ে গাছের ছায়া দীর্ঘ হয়ে দুজনকে ঘিরে রাখে। 

আরও কিছুক্ষণ সময় বয়ে যায়।

রুকু বলে, ঘর থেকে টিভিটা উঠোনে আনতে হবে। টিভিতে এখন রান্নার রেসিপি লাইভ দেখানো শুরু হবে। আর রুকুকে সেইমতো রাঁধতে হবে। 

মৃদুল বলে, তার দরকার নেই, সে নিজের স্মার্ট ফোন খোলে। বলে, এখানেই চমৎকার দেখা যাবে। 

অবশেষে বাবার জন্য আর অপেক্ষা না করে রুকু ম্যারিনেট করা মাংস অল্প কিছু মসলা দিয়ে রাঁধতে বসে যায়। মনে মনে বলে, বাবা না আসায় ভালোই হয়েছে। তিনি এলে তাদের সীমাবদ্ধতা নতুন করে প্রকাশিত হয়ে পড়ত। 

রুকুর দৃষ্টি একবার রান্নার দিকে, একবার সামনে বসা স্বপ্নের মানুষের দিকে, আর একবার গেটের দিকে ফিরে ফিরে যাচ্ছে পাছে পাড়ার কোনো গৃহস্থের কাজের ছেলে শেষ বিকেলে কুরবানির মাংসের মিসকিনের অংশ নিয়ে এসে মৃদুলের সামনে তাকে আরও ছোট করে ফেলে। কিন্তু আল্লাহ বুঝি অতটা নির্মম নন, তাঁর এই ক্ষুদ্র সৃষ্টিকে তিনি আরও অপমান থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। নতুন করে কেউ মাংস নিয়ে গেটে এসে বলল না, মাংসের বাটিটা নিয়ে যান।

রুকু ত্রিশঙ্কু অবস্থার মধ্যেই বুঝিবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ‘বাংলা টিভি’র লাইভ প্রোগ্রাম অনুযায়ী রান্না করে যাচ্ছে সে। 

ম্যারিনেট করা মাংসে যে খাসির কলিজা, রানের মাংস ইত্যাদি নেই মৃদুল বুঝতে পারল না। রুকু আরও একবার হাঁফ ছাড়ল। 

কিন্তু যখন টিভিতে বলা হলো চুলার তাপ কমান, ৩৫০সে: তাপমাত্রায় ধরে রাখুন- রুকু কিছু তো করতে পারলই না, উলটো মাটির চুলায় কুড়ানো লাকড়ির মৃদু আলোয় মৃদুলের সামনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। 

তবে রুকুর কেন যেন মনে হলো, এতে মৃদুলের মনে বরং উলটো প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ মেয়েটিকে ভালোবাসার, কাছে পাওয়ার ব্যাপারে তার এতটুকু যা সংশয় ছিল রন্ধন শেষে তা একেবারে ধুয়েমুছে গিয়ে তাঁর কাছে সমস্ত কিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার চোখের আকাশে ধোঁয়াশা কেটে গিয়ে এক্ষণে একটি মাত্র শব্দ ভেসে উঠেছে- ভালোবাসি।

নিজেকে গুছিয়ে নিল রুকু। ভালোমন্দ সব ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে পায়েলের আনা চালের রুটি আর প্রায় মসলাবিহীন মাংস পরিবেশন করল মৃদুলকে। উন্মুক্ত অম্বরতলে নিজের ভালোবাসার মানুষকে খাবার বেড়ে দিয়ে মৃদুল বাতাসে হাতপাখা নাড়াতে লাগল সে। 

সে জানে, এ শহরে ছেলেরা খাদ্যের গুণাগুণ থোড়াই জানে। যা পায় তৃপ্তির সঙ্গে খায়। খেয়ে সব সময় বলবে, অতি উত্তম হয়েছে। রুকু বিশ্বাস করে, তারা তা অন্তর থেকেই বলে, কারণ একেবারে ঘরোয়া ছেলেমেয়েদের এত খাদ্যের স্বাদ বিচারের জ্ঞান তাদের কখনো হয়ে ওঠে না, তাই অতি কাছের মানুষের মতো মৃদুলের খাওয়া প্রত্যক্ষ করে রুকু। ভাবে, এরকম বিরানা অঙ্গনে নিজের হাতে ভালোবাসার মানুষটিকে একবেলা নিজের মতো খাওয়াতে পারা একজনের সারা জীবনের চাওয়া-পাওয়াকে ছাপিয়ে যায়। কৃতজ্ঞতায়, ভালো লাগায় তার প্রাণের ভেতর বসন্ত বাতাসে ওড়া ফুলের মতো হালকা হয়ে যায়। 

সময়ের তাড়া ছিল দুজনের। অগত্যা রান্না করা তবারুকের মাংস নিয়ে ‘বাংলা টিভি’র গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়ল দুজন। পেছনে পড়ে রইল কুরবানির দিনের জমা হওয়া মিসকিনের মাংসের ভাগ, ডানাভাঙা একটি কাকের করুণ চোখ আর কিছু অবাস্তব স্বপ্নঘেরা বাস্তবের এক ভাঙা বাড়ি।

শেষ

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

সপ্তম পর্ব

অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব

দশম পর্ব

একাদশ পর্ব

দ্বাদশ পর্ব

ত্রিয়োদশ পর্ব

চতুর্দশ পর্ব

পঞ্চদশ পর্ব

অতঃপর... দগ্ধ আমি

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ০১:১৭ পিএম
অতঃপর... দগ্ধ আমি

আষাঢ় মাসের এক অবেলায় বৃষ্টি ঝরছিল অঝোর ধারায় 
লুঙ্গি পরে উদোম গায়ে ডোবার জলে স্নান করছিলে তুমি 
ভেজা শরীরে বেশ লাস্যময় দেখাচ্ছিল। 
বড্ড প্রেম পেয়েছিল আমার মনে 
ইচ্ছে করছিল তুখোড় চুম্বন করে তোমার ভেতরের তুমিটা জাগিয়ে দিই।

ভীষণ রকম ইচ্ছে তোমার ওই উদোম বুকে মাথা রাখব  
নিতম্বের ভাঁজে জাগল কামুকি ঝড়
জলে ভেসে হলাম বানভাসি
অতঃপর... দগ্ধ আমি!

রক্তাক্ত দৃশ্যকাব্য

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ০১:১৬ পিএম
রক্তাক্ত দৃশ্যকাব্য

ভোকাট্টা ঘুড়ির সাথে শকুন উড়ে এসে বসে শহরের 
উপকণ্ঠে। পৃথিবীর ক্যানভাসজুড়ে আজ ধূর্ত চোখ 
আর রক্তাক্ত দৃশ্যকাব্য। যারা মৌন হয়ে বসে আছে
সুদিনের আশায় তাদের আশার ওপর চুঁইয়ে পড়ে
শকুনের আহ্লাদ! অদ্ভুতভাবে পাশ ঘেঁষে বসে চিল
যেন ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে জগৎ সংসার ডোমেইন
দূরাগত ভালোবাসা উড়তে থাকে ঘরময়, হোস্টিং
এর নিচে স্তব্ধ হয়ে আছে বিশ্বাসের চাকা! অদিনে
কেউ কারও থাকে না কেবল লোভ ধীর লয়ে অশুভ 
শক্তি হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীর পরে। এই আগুন
ছড়ানো দিনে যারা ভ্রমণে মাতে তাদের স্বভাবের
তারতম্য বুঝে ওঠা সুকঠিন। হতে পারে টোলের
মুগ্ধতা ক্লিন্ন যুবতীর মতন তাই বলে যে ক্লীবত্ব হয়ে
অভিযোগ তোলে সে কি শেষ পৃথিবীর যাত্রীর কেউ?
বড় পরাধীন হয়ে আছি,আমার কি কোথাও যাবার
কথা ছিল? ক্ষণজন্মা ভোরে হয়তো একদিন আমিও
বেরিয়ে পড়বে পৃথিবীর পথে, পেছনে পড়ে থাকবে
স্মৃতি, মায়া আর দ্বিধাগ্রস্ত সম্পর্কের ঘেরাটোপ

খোয়াব

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ০১:১৪ পিএম
খোয়াব

সারমেয়, চন্দ্রবোড়া, বৃশ্চিক, ভ্রমরা
বাস্তবে না দংশিলেও স্বপনে দংশায়।
খোয়াবে লাইলা দেখো, জাগ্রতে তোমরা
বেতো কানা দন্তরোগী সেবো, হায় হায়!
বাড়িতে তো পোড়া পিঠা, দুধচিনিহীন,
অর্ধদগ্ধ কাঁচকলা গলিত মাছের
অস্বাদ কুস্বাদময় ভোজ রাত্রিদিন
স্বপ্নে পায়সান্নে গন্ধ খেজুরগুড়ের!
তোমাদের আছে স্বর্গ, আছে রাজপ্রাসাদ,
ঝরোখায় ঝরোখায় হুর পরী মেম,
পেটিকায় সোনা, পান্না, বেশুমার হীরা,
মাণিক‍্যের পানপাত্রে রঙিন মদিরা।
বিশ্বের সুন্দরী এনে ভরেছ হারেম,
স্বপ্নেই কেবল গড়ো স্ফটিকের চাঁদ।

তৃষ্ণার সীমানা

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ০১:১১ পিএম
তৃষ্ণার সীমানা
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

উপজেলা পরিষদ থেকে সোনাখালি মাঠের প্রকৃত দূরত্ব সম্পর্কে জজসাহেবের আদৌ কোনো ধারণাই ছিল না। স্থানীয় মানুষজন বলে, দূর কোথায়! এই তো শহর থেকে বেরোলেই বসন্তপুর, তারপর সোজা উত্তরে যতদূর চোখ যায় সোনাখালি মাঠ। সেই বিরান মাঠের এক প্রান্তে খোদাবক্স সাঁইজির আখড়া। নিজের অফিসের পাইকপেয়াদা সেরেস্তাদারও জানায়, 

-না, সোনাখালি মাঠ এখান থেকে বিশেষ দূরে নয়। বড়োজোর মাইল তিনেকের পথ। কিন্তু স্যার কেন সেই মাঠে যাবেন? কী আছে সেখানে? 
জজসাহেব নিঃশব্দে এক চিলতে হাসেন। তারপর কদমছাঁট দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, 

-কিছুই নেই? 
সোনাখালি মাঠ তো শুধু নামেই মাঠ। আসলে নিচু এলাকা। আগেকার মানুষ এখনো বলে সোনাখালির বাঁওর। কেউ কেউ বলে বড় বিল। দাপ্তরিক কাজকর্মের বাইরে জজসাহেবের সঙ্গে এমন ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগ পেয়ে সেরেস্তাদার নিজের এলাকার ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক চিত্র ফুটিয়ে তোলে- 
-এখনো বর্ষাকালে চারদিকে জল থইথই করে। সাদা ফকফকা। সে যে কী সৌন্দর্য! এখন এই শুকনোর দিনে আপনি সেখানে কী দেখতে যাবেন স্যার? 

জজসাহেবের সংক্ষিপ্ত জবাব,
-দূরে যখন নয়, চলুন সবাই মিলে একবার বেড়িয়ে আসি! 

সেরেস্তাদার আর কী বলবে! আকারে-ইঙ্গিতে ঢের বলা হয়েছে, আর কত প্রতিবাদ করা যায়! পদমর্যাদার দূরত্বের কথা তো ভুলে গেলে চলবে না। অকারণে সে জজসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটি কেমন যেন অন্যরকম। আগের জজসাহেবের ঠিক উল্টোটি। জজ তো ঠিক নয়, উপজেলা হওয়ার পরপর মুন্সেফকোর্ট উঠে গিয়ে সেটারই কেতাবি নাম হয় সহকারী জজ আদালত। আগের সাহেব ওই শব্দযুগল খুব অপছন্দ করতেন। জজ মানে তো জজ, তার আবার সহকারী-টহকারী কী! মানুষটা ছিলেন আগাগোড়া কৃত্রিম মানুষ, শো-কেসের পুতুলের মতো সাজানো-গোছানো। সেই তুলনায় নতুন জজসাহেব একেবারে খাঁটি মানুষ, অহংকারের বালাই নেই, মানুষকে প্রথমে মানুষ বলেই গণ্য করেন, তারপর অন্য পরিচয়। সমাজে মুখ পায় না যে সামান্য ন্যাড়ার ফকির খুদু শাহ (খোদাবক্স সাঁইজিকে সবাই এই নামেই চেনে), প্রকাশ্য আদালতে তাকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুললেন, আবার শেষ পর্যন্ত তাকে পাগলও বললেন। কে যে আসল পাগল, কে বলবে সেই কথা! সেরেস্তাদারের সন্দেহ, জজসাহেব সেই আখড়ায় যেতে চাইছেন না তো! এ সংশয় মনে চেপে রেখে প্রসঙ্গটিকে একটু ঘুরিয়ে সে অন্যভাবে উপস্থাপন করে-

-স্যার তা হলে বিরান মাঠ দেখতেই চাইছেন! 
-আহা, চলুন না এক বিকেলে ঘুরে আসি। 
ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানায়, 
-জি স্যার, তাই হবে। 
-শাসনব্যবস্থা-বিচারব্যবস্থা এখন সব নেমে এসেছে গ্রাম পর্যন্ত। গ্রাম না চিনলে চলে! 
-জি স্যার। কিন্তু গ্রামে যাবেন কীসে? 
অবলীলায় জানান,
-কেন, হেঁটে! এক চিলতে হেসে যোগ করেন, শ্রীচরণ ভরসা। 

জজসাহেব হাসলে সেরেস্তাদারের খুব ভালো লাগে। ফুল ফোটার সৌন্দর্য দেখতে পায় যেন-বা। হিন্দু পরিবারে জন্ম, তবু কী চমৎকার মোগলাই কায়দায় দাড়ি রেখেছেন। গৌরবর্ণ গোলগাল মুখমণ্ডল যেন বর্ষার কদম হয়ে ফুটে থাকে সারাক্ষণ। কেমন সহাস্য ভঙ্গিতে বলতে পারেন, শ্রীচরণ ভরসা। সরকার কোর্টকাচারি এনে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছে, অথচ জজসাহেবের যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থাই করেনি। উপজেলায় সরকারি গাড়ি বলতে এক ইউএনও সাহেবের জন্য আছে একটা। তা নিয়ে এই সহকারী জজ সাহেবের কোনো আক্ষেপ-অনুযোগ নেই। কত সহজেই শ্রীচরণ ভরসা বলতে পারেন। শুনতে ভালো লাগে, তবু সেরেস্তাদার কাঁচুমাচু মুখে বলে, 

-আপনি অনুমতি দিলে ইউএনও স্যারের গাড়ির কথা বলতে পারি। 
-আপনার কি মনে হয়, এ অনুমতি আপনি পাবেন আমার কাছ থেকে? 
সেরেস্তাদার নীরব। 
-তিন মাইল পথ আমরা হাঁটতে পারব না? 
-স্যার আসা-যাওয়ায় তিন দুগুণে ছ-মাইল। 
-ছোটবেলায় ছ-মাইল দূরের স্কুলে হেঁটেই যাওয়া-আসা করেছি, বিশ্বাস হবে? 
-সে এক সময় ছিল স্যার। এখন কি পারবেন? 
হা হা করে হেসে ওঠেন জজসাহেব। বলেন, 
-হ্যাঁ, এখন জজসাহেব হয়েছি তো! তবু চলুন, একদিন বেরিয়ে পড়ি। 
-জি স্যার। 
-তারপর পথে নেমেই বোঝা যাবে পথের মাপ। 

এত কথার পরও সোনাখালি মাঠের উদ্দেশে রওনা হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে সেরেস্তাদার শেষবারের মতো বিনীত প্রস্তাব রাখে- 
-রিকশা নিলে হয় না স্যার? 
-রিকশা! রিকশা কী হবে? 
বিরক্তি এবং বিস্ময় দুই-ই যুগপৎ ছলকে ওঠে জজসাহেবের কণ্ঠে, 
-রিকশা কি ওই মাঠের মধ্যে যাবে? পদ্মপুকুর পর্যন্ত যাবে? 
সেরেস্তাদার হাত কচলে জানায়, 
-না স্যার, তা যাবে না। অন্তত বসন্তপুরের শেষমাথা পর্যন্ত যাওয়া…
-না, তার কোনো দরকার নেই। 
একটুখানি থেমে অতিদ্রুত এক পলকে সেরেস্তাদারের চোখমুখ পরখ করে বলেন, 
-কষ্ট মনে হলে আপনি না হয় না-ই গেলেন। আমি পাইক-পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে একবার ঘুরে আসি। 

ভয়ানক লজ্জা পেয়ে যায় সেরেস্তাদার। সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে জানায়, বেয়াদবি মাফ করবেন স্যার। আমার আবার কষ্ট কীসের! আপনার সঙ্গে থাকব এই তো আমার আনন্দ। 

সেই আনন্দ-পদযাত্রা শুরু হয় চৈত্র মাসের এক পড়ন্ত বিকেলে ঘড়ির কাঁটার বিকেল বটে, তবু মাথার ওপরে তরবারি ঝলসানো রোদ্দুর। ছাতায় খানিকটা মাথা বাঁচায়, কিন্তু সারা শরীর ঘেমে-নেয়ে একশেষ। তবু কিছুতেই যেন ভ্রুক্ষেপ নেই জজসাহবের। কীসের এক দুর্বার আকর্ষণে তিনি মেঠোপথে কখনো আইল ধরে হেঁটে চলেছেন, কখনো-বা রুক্ষ মাঠেই পা চালিয়ে চলেছেন। সারা মাঠ থেকে চৈতালি ফসলও তোলা হয়ে গেছে। ফলে বিস্তীর্ণ মাঠ খা খা করছে। এমন সবুজশূন্য বুকফাটা মাঠ বুঝি আর হয় না। জজসাহেব হঠাৎ পেছনে ফিরে সঙ্গীদের কাছে জানতে চান,

-পদ্মপুকুরটা আর কত দূরে? 
একজন আঙুল তুলে সামনে দেখায়- 
-ওই যে দূরে তালগাছ দেখা যাচ্ছে, ওইখানে। পুকুরপাড়েই তালগাছ। ওই যে-
ভালো করে তাকাতেই চোখে পড়ে, কে যেন হাত উঁচিয়ে দ্রুতপায়ে এদিকে আসছে। তার ঊর্ধ্বমুখী ডান হাতে ওটা কি একতারা? জজসাহেব জানতে চান- 
-কে ওটা, খোদাবক্স সাঁইজি নাকি? 
সেরেস্তাদার বলে, 
-জি স্যার, খুদু শা-ই তো মনে হচ্ছে। 
-ওই পুকুরপাড়েই তার বাড়ি? 
-না স্যার। ওর আখড়া তো আরও দূরে, এই মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে।
পেছনে থেকে আরও এক পেয়াদা যোগ করে, 
-বাড়ি তো নয় স্যার, যত সব গাঁজাখোর ফকিরের আখড়া। ওরা সবাই কুতুবউদ্দিন পীরের মাজারটাই অপবিত্র করে দিল। মাজার-রক্ষক না ছাই। ভণ্ডামি আর ভণ্ডামি।

জজসাহেব একবার পেছন ফিরে তাকান। চোখে চোখ পড়তেই এতক্ষণের বক্তা চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পা চালায়। আরও কয়েক পা যাওয়ার পরে তিনি প্রশ্ন করেন, 
-তুমি কি কখনো গিয়েছ ওর আখড়ায়? 
নিম্নকণ্ঠে উচ্চারিত হয়, 
-না স্যার। 
-বাপরে বাপ! ওখানে না গিয়েই এত অভিজ্ঞতা তোমার? 
অপর পেয়াদাটি কোনো কিছু না বুঝেই তাকে সমর্থন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, 
-ওখানে যাবে কী করে স্যার! ওখানে তো রীতিমতো অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ চলে। ওরা হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য মানে না স্যার, এমনকি নারী-পুরুষকেও আলাদা চোখে দেখতে জানে না। এই পর্যন্ত বিবরণ দিয়ে পেয়াদাটি একটু দম নেয়। তারপর সেরেস্তাদারের চোখ ইশারার অর্থ না বুঝে আবার বকবকানি শুরু করে- 
-ওরা গানের মধ্যে কী বলে শোনেননি স্যার? ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নরী লোকের কী হয় বিধান। কেমন বিটকেলে প্রশ্ন দেখেছেন? 

জজসাহেব পরিহাসতরল কণ্ঠে বলেন,
-বাবা, ওই সব বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞান তো আপনার মোটেই কম নয় জনাব! তা কতদিন ছিলেন ওদের আখড়ায়? 
এতক্ষণে বক্তা নীরব। কী ভেবে দাঁতের তলে জিভ কাটে। একটু সময় নিয়ে বিনয় বিগলিত কণ্ঠে বলে, 
-ওখানে কোনো ভদ্রলোক যেতে পারে না স্যার। 
জজসাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে জানান, 
-কিন্তু আমাদের যে একবার যেতেই হবে সেই আখড়ায়। 
-আপনি যাবেন স্যার! 
-জি আমি যাব। আমার সঙ্গে আপনারাও যাবেন। 
-নিশ্চয়ই যাব স্যার। সে তো আমরা কাজের তাগিদেই যাব। 

হঠাৎ কী মনে করে জজসাহেব হা হা করে হেসে ওঠেন। আদালতে থাকাকালে সাধারণত এ রকম প্রাণখোলা সরব হাসি শোনা যায় না। সেরেস্তাদার খুব অবাক চোখে তাকায় জজসাহেবের মুখের দিকে। তারপর সাবধানে মন্তব্য করে, 
-আপনাকে দেখে খুদু শাহ কেমন খুশি তা দেখেছেন স্যার? 
খুদু শাহ মানে খোদাবক্স সাঁই এখন খুব সামনে চলে এসেছে। দেখে মনে হয় যেন এইমাত্র আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো ভিনগ্রহের মানুষ। আবার মনে হয় পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সংবেদনকাতর সামান্য মানুষ। অক্ষিকোটরের খোঁড়লে ডুবে যাওয়া দুচোখে তার দূরের তৃষ্ণা। অথচ নিভু নিভু সেই চোখে অসম্ভব প্রাখর্য ফুটিয়ে এবং মেরুদণ্ড খাড়া করে দৃঢ় পায়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বিনম্র ভক্তি জানায়।

কণ্ঠে তার ফুটে ওঠে বিমুগ্ধ বিস্ময় এবং বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস- 
-হুজুর, আপনি সত্যিই এতদূরে এই বিরান মাঠের মধ্যে চলে এলেন? 
-হ্যাঁ এলাম। আমি তো একা নই, এই যে আমরা সবাই এসেছি। 
-আমার মন বলেছে আপনি একদিন আসবেন হুজুর, আপনার বুকে খাঁটি সোনা আছে যে! 
-আচ্ছা খুব হয়েছে। আপনি এখানে কী করছেন? 
খুদু শাহের ঠোঁটে বিনম্র হাসি-
-ওই যে পুকুর পাহারা দিচ্ছি। 
সেরেস্তাদার দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে- 
-তবু যদি পুকুরটা নিজের হতো, সেও এক কথা ছিল। পুকুর পাহারা দিচ্ছে! 
খাটো কথাও কানে যায় সাঁইজির। এক গাল বিগলিত হাসি ছড়িয়ে সে জানায়, 
-নিজের নয় বলেই তো পাহারায় আছি। দিতে হয় জান দেব, কিন্তু পানি দেব না পুকুরের। সাফ কথা, হ্যাঁ। 
এবার একজন পেয়াদা এগিয়ে এসে বলে,
-পানি দেব না বললেই হবে! 
-বললাম তো, এক আঁজলাও পানি দেব না। 

জজসাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। হিসেব মেলাতেই পারেন না লোকটির এত দৃঢ়তার উৎস কোথায়! নিজের নেই জমি-জিরেত, ওই পুকুরও তার নয়, তবু সে পুকুরের পানি কাউকে নিতে দেবে না। এমনকি পুকুরের মালিককেও দেবে না। এই তো কদিন আগে তার এই গোঁয়ার্তুমি দেখে আদালতের ভাবগাম্ভীর্য ভেঙে অনেকেই হাসাহাসি করেছে, কেউ কেউ বলেছে- পাগলামি আর বলে কাকে! জজসাহেবেরও মনে খটকা লেগেছে, তবু নিছক পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি। তাই তিনি উকিলের সাহায্য ছাড়াই সোজাসুজি সাঁইজির বক্তব্য শুনতে চান, আহ্বান জানান, 

-বলুন, আপনার যা বলার আপনিই বলুন। শুনি আপনার কথা। 
সাঁইজির সেই একই কথা, পুকুর থেকে কাউকে পানি নিতে দেবে না।
প্রতিপক্ষের উকিল প্রশ্ন করেন- 
-ওই পুকুরের মালিক কে? 
সাঁইজি অতি সহজেই জানায়, 
-পুকুরের মালিক আলী হোসেন, সে তো সবাই জানে। 
-তা সেই আলী হোসেন পুকুর থেকে পানি সেচে তার নিজের জমিতে নিতে পারবে না? 
নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে জানিয়ে দেয়, 
-না। 
-যার পুকুর তারই জমি। সেই জমিতে ফসল ফলানোর জন্য নিজের পুকুরের পানি নিতে পারবে না আলী হোসেন? 
বজ্রপতনের মতো উচ্চারিত হয়, 
-না। 
উকিল সাহেবের তখন হিতাহিত জ্ঞান হারাবার দশা। চিৎকার করে ওঠেন, 
-এটা কি মগের মুলুক? আইনকানুন নেই? 

সাঁইজির কণ্ঠে সহসা ছলকে ওঠে উত্তেজনা। আঙুল তুলে সে ঘোষণা দেয়, 
-লাশ পড়ে যাবে হুজুর। আমার লাশ ডিঙিয়ে তারপর পুকুরের পানি নিতে হবে। এই আমি প্রকাশ্যে বলে দিলাম। 
চমকে ওঠেন জজসাহেব, বলে কী এই  লোকটা! কোন অধিকারে বলে! এতটা জোর সে পায় কোথায়! খুবই সঙ্গত কারণে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে এসব প্রশ্নও ওঠে আদালতে। তখন বড় অদ্ভুত বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয় সাঁইজির চেহারায়। উত্তেজনার লেশমাত্র চিহ্ন নেই তার চোখেমুখে। গভীর অনুভব থেকে সে উচ্চারণ করে, 

-সে-কথা তো বলে বোঝানো যাবে না হুজুর। আমি মূর্খ মানুষ, আমি কি সব কথা বোঝাতে পারি! সোনাখালির বিরান মাঠের মধ্যে গিয়ে পদ্মপুকুর দেখলে হুজুর নিজেই বুঝবেন, ওই পানি কি দেওয়া যায়!  

আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের কাছে খোদাবক্স সাঁইজির আকুল আবেদন, ওই পুকুরের ওপরে ১৪৪ ধারা জারি করা হোক। একেবারে সহজ-সরল মন্তব্য তার, আমি আর কদ্দিন পাহারা দেব হুজুর!  বুড়ো মানুষ, আমি কদ্দিন ঠেকিয়ে রাখব?  আমাকে মেরে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। তখন আর পানি সেচে মাঠে নিতে বাধা দেবে কে! 

আদালতে উপস্থিত অনেকেই হতাশ হয়। পাগলের পাগলামি আর কতক্ষণ ভালো লাগে! অথচ অপরিসীম ধৈর্য বিচারকের। চশমার আড়াল থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এই পাগল বাউলকে। সাঁইজি ততক্ষণে দুচোখ মুদে অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে গান ধরেছে, ফকির লালন ম’লো জল পিপাসায় গো…। 
এই গানের সুরে সম্মোহিত হয়েই হোক অথবা বিচারকার্যে প্রাসঙ্গিক ভেবে হোক, জজসাহেব হঠাৎ জানতে চান, 
-আপনি কি ওই পুকুরের পানি পান করেন? 
-না হুজুর। 
বিচারকের বিস্ময়ের অবধি থাকে না। 
সেদিন আদালতে এর বেশি আর কথা এগোয় না। কীভাবে এগোবে? এরপর তো অনিবার্য সেই একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে চলে আসবে, তাহলে কেন পুকুরের মালিককে পানি নিতে দেবেন না? সে কি আপনার শত্রু? এমন প্রশ্ন আগেও উঠেছে কয়েকবার। প্রতিবারই উত্তর আসে ভয়ানক গোলমেলে। এবারও সে উদার ঘোষণা দিয়ে জানায়, 
-আলী ভাই শত্রু হতে যাবে কেন? তার মতো ভালো মানুষ তো হাজারেও মেলে না। 
-তাহলে? 
না, আর কোনো প্রশ্ন নয়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তও নয়। 

খোদাবক্স সাঁইজিকে অনুসরণ করে মাঠের আইল ধরে এগিয়ে চলে জজসাহেবের দলবল। রৌদ্রের দাহ কমেছে, আলো কমেনি। পদ্মপুকুরের পাড়ে জোড়া তালগাছ এবং অসংখ্য বুনোবাবলার ডালে ডালে ঘরে ফেরা পাখির কিচিরমিচির ভিন্ন এক জগতের হাতছানি দেয়। বেলা শেষে ঘরে ফিরছে গরুর দল। না, ঘরে ফেরার আগে গরু-ছাগল-ভেড়া দলবেঁধে হইহুল্লোড় করতে করতে এসে নামছে পদ্মপুকুরে। সবাই মিলে পানিতে নাকমুখ চুবিয়ে যেন সারা দিনের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। সবটুকু পানি যেন তারা এক টানে শুষে নেবে এরই ফাঁকে এক জোড়া গাঙশালিক ডানা উল্টিয়ে স্নান সেরে নেয়। বেশি তো পানি লাগে না তাদের। একে অপরের গায়ে খানিকটা ছিটিয়ে দিতে পারলেই হলো। স্নান শেষে তারা শেষ বিকেলের রোদে গা শুকিয়ে নিতে চায়। সেই জন্য উড়ে এসে বসে প্রকাণ্ড দুই মোষের পিঠে। ওদের আবার দুই রকমের তৃষ্ণা। পেটের তৃষ্ণা, পিঠের তৃষ্ণা। 

সারা শরীর পানিতে না ডোবালে ওদের শান্তি নেই। ওরা নড়েচড়ে উঠতেই পিঠের ওপর থেকে শালিকজোড়া উড়ে যায়, ঠোঁটে পুটিমাছ ঝুলিয়ে এবার এসে বসে এক মাছরাঙা। তার খুব ইচ্ছে মোষের পিঠে বসেই ঠোঁটের শিকার সে আহার করবে। হায় নির্বিবাদী প্রাণী, তার বুঝি কারও বিরুদ্ধে নালিশও নেই। 

পুকুরপাড়ে এসে চোখ জুড়িয়ে যায় জজসাহেবের। 

পাইকপেয়াদারা ভেবেই পায় না, দেখার মতো কী আছে এই পদ্মপুকুরে। হ্যাঁ বিরাট মাঠের মধ্যে এ এক বিরাট পুকুর। চোত-বোশেখেও একবুক পানি। নিশ্চয় পুরোনো মাছও আছে। কিন্তু তাদের সাহেব কি হুইল কিংবা ছিপ ফেলে মাছ ধরতে এসেছেন এই তেপান্তরের মাঠে! তিনি আছেন খুদু শার জগৎ ভোলানো তত্ত্বকথার ঘোরে। কখন যে তার ফেরার মর্জি হয় কে জানে!

এ দেশের গ্রাম জনপদে স্বাভাবিক খবরও অস্বাভাবিক দ্রুততায় ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে। জজসাহেব পায়ে হেঁটে শহর ছেড়ে গ্রামে এবং গ্রাম ছেড়ে মাঠে বেড়াতে বেরিয়েছেন, এ খবরও দ্রুত চাউর হয়ে যায়। ফলে আরও অনেক গ্রামবাসীর সঙ্গে পুকুরমালিক আলী হোসেনও ছুটে আসে সোনাখালির মাঠ ভেঙে পদ্মপুকুরের পাড়ে। পানি খেয়ে ফিরে আসা গরুর পালের মধ্য থেকে এক বেয়াড়া এঁড়ে কী ভেবে কে জানে শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসে আলী হোসেনের দিকে। কৌশলে নিজেকে রক্ষা করে সে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ায় জজসাহেবের সামনে। হাত তুলে সালাম জানায়। চোখ রগড়ে অবাক চোখে তাকায়। তারপর অতিদ্রুত দড়বড় করে বলে, 

-দ্যাখেন স্যার, এই পুকুর আমার। পুকুরপাড়ের এই জমিও আমার। আকাশে বৃষ্টির লক্ষণ নেই। আমার পুকুরের পানি দিয়ে আমি-
বাক্য শেষ হয় না আলী হোসেনের। হঠাৎ জজসাহেব মাঝপথে বলে বসেন, 

-আচ্ছা, এই গরু-বাছুরগুলো কার? 
-গরু-বাছুর! এতক্ষণ যেন সে গরু-বাছুর দ্যাখেইনি। ডাইনে বামে গরুর পাল দেখে নিয়ে সে জানায়, 
আমাদের। মানে আমাদের সবারই আছে গরু-বাছুর। সারা দিন মাঠে মাঠে চরে খায়। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরে। 
-বুঝলাম। জজসাহেব জানতে চান, 
-এর মধ্যে সাঁইজির কোনো গরু-ছাগল আছে? 
আলী হোসেন এবার ফিচিক করে হেসে ওঠে, হাসির মধ্যেই জানায়, 
-ও হলো ফকির মানুষ, গরু-ছাগল কোথায় পাবে স্যার? 
-অথচ ওই ছাগল-গরু, পাখপাখালির জন্য তার দরদ কতখানি দেখেছেন? 
-দরদ! আলী হোসেন ভাবতেই পারে না- 
-ওর দরদ কেন? 

জজসাহেব এমন বেমক্কা প্রশ্ন যেন আশাই করেননি। তাই সহসা কোনো জবাবও হাতড়ে পান না। ভেতরে চিনচিন করে ক্রোধ। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে তিনি বলেন, 
-নিজের প্রাণ বাজি রেখে সে আপনার পুকুরের পানি আগলে রাখে আপনাদেরই গরু-ছাগলের জন্য, আর রাজ্যের পাখপাখালির জন্য। অকৃত্রিম এই দরদ কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারেন? 
শেষ বিকেলের আলোর আলোয় কিংবা অন্তর্গত কোনো অচেনা ক্ষোভে জজসাহেবের চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে। যা ভেবেই হোক সেরেস্তাদার দম করে প্রস্তাব দিয়ে বসে- 
-বেলা পড়ে এলো স্যার, আমাদের বোধ হয় ফেরা দরকার। 

জজসাহেবও বলেন, 
-হ্যাঁ, ফেরা দরকার। কিন্তু সাঁইজি কই? 
খোদাবক্স সাঁইজি তখন বেশ খানিক দূরে। হাতের একতারাতে সে গান ধরেছে- 
-কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে গায়, আমি বসে আছি আশার সিন্ধুর পারেতে সদাই।
শূন্য মাঠে সাঁইজির কণ্ঠ ঘুরে ঘুরে বিলাপ করে, হাহাকার মর্মরিত হয়। সে হাহাকার কেউ শোনে, কেউ শোনে না।

পঞ্চাশের দশকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ০১:০৩ পিএম
পঞ্চাশের দশকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন
কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যখন ভারতীয় লেখক ছাড়া আর কারও বই বাজারে বিক্রি হতো না, সে সময় আকবর হোসেনই একমাত্র লেখক, যার বই ওপার বাংলার বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজার দখল করতে পেরেছিল।...

বাঙালি ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের জন্ম (১ অক্টোবর ১৯১৭-২ জুন ১৯৮১) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে। বাংলা কথাসাহিত্যের অনেক আলোচক-সমালোচকের মতে ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচয়িতাখ্যাত মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) এবং ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসখ্যাত মজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের (১৮৬০-১৯২৩) পরই পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন অন্যতম কথাশিল্পী আকবর হোসেন। পিতা আব্দুল আলী বিশ্বাস। আকবর হোসেন ছাত্রজীবন থেকে সন্ধানী, শিখা, দৈনিক আজাদ, নবযুগ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় লিখতেন। তার প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে কলকাতায়, যা এক সময়ে প্রায় ঘরে ঘরে পঠিত হতো। তিনি মোট নয়টি উপন্যাস ও একটি ছোটগল্প গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাছাড়া রয়েছে কিছু কবিতা, সনেট, গান, প্রবন্ধ ও নাটক। তার বর্ণাঢ্য সাহিত্য ও বোহেমিয়া জীবন নিয়ে গবেষণায় অনেক তরুণ লেখক এবং গবেষক এগিয়ে এসেছেন।