ঢাকা ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫
English

শেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০২ পিএম
আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৪ পিএম
শেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার

গত সংখ্যার পর

এসময় হঠাৎ কী ভেবে হালিম শাহের মাইক হাতে নেন কবি হাসান আলী। তার গান এতদিন ধরে হালিম শাহ গেয়ে এসেছেন, গেয়ে মসজিদের জন্য টাকা তুলেছেন, আজ দেখি, কুরবানির এই নির্দয় ভোরে নিজের কণ্ঠে সেই গান কেমন মর্মরিয়া ওঠে। তিনি ধরলেন, কোনো এক উদাসী বিকালে লেখা জীবনের সকালবেলার গান- 

একটা গান গাও জুড়াও এ দেহ মন, 
দিনে দিনে জীবন ক্ষয় আর যদি না পাই সময়,
কেমন হবে গান ছাড়া সেই আঁধার মরণ।

গানে পাই প্রেম সাথি গানে প্রেমের মালা গাঁথি,
গান ছাড়া প্রেম বালা (হায় রে) গান ছাড়া গাঁথা মালা 
শুকাইবে হায় মরুর মতন।

গান দিয়ে শুনি সবি গানে আঁকি প্রেমের ছবি,
গান বিনে শ্রুতি কথা (হায় রে) গান বিনে প্রেম গাঁথা
কে দেখে কে করে শ্রবণ।

স্তব্ধ জনতা, নির্বাক পৃথিবী।
ভোরে, ঈদের দিনের ভোরে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন দরিদ্র চালক। হয়তো তাঁর মতোই হতভাগ্য তাঁর গাড়ির যাত্রীরা। ঈদের আনন্দ নেই তাদের ভাগ্যে। তাই কুরবানির খুশি নয়, পরিজনের সঙ্গে ঈদের ছুটিতে মিলনের ব্যাকুল পিয়াসা তাদের চোখেমুখে উপছায়ে পড়ছিল। 

কবি হাসান আলী জানেন, এসব লোকের কাছ থেকে আজ ঈদের চাঁদার বাক্সে কোনো টাকা পড়বে না, তবুও গান তাকে এমন অলৌকিক এক লোকে টেনে নিয়ে গেল, যেখান থেকে মানব লোকে চটজলদি ফিরে আসা সম্ভব নয়। গেয়েই গেলেন তিনি আর চট্টগ্রাম সড়ক অবরুদ্ধ করে মুগ্ধ চালকের সঙ্গে মুগ্ধ যাত্রীর দল রাস্তার ওপর বিহ্বল শুনে গেল সে গান।

গাড়ির লাইন পড়ে গেল মহাসড়কে। কিন্তু কোনো হাঁকডাক নেই। কথা নেই, নিশ্বাস পর্যন্ত নেই। আল ফালাহ মসজিদের ভাঙা মাইক যতটুকু পৌঁছে এক অন্ত্যজ গায়কের গলা বিলোল করে গেল শত শত গ্রামীণ মানুষ- 
একটা গান গাও জুড়াও এ দেহ মন...

গান একসময় বন্ধ হলো, কিন্তু গানের রেশ রইল বহুক্ষণ। দূরপাল্লার গাড়িগুলো চলতে লাগল একসময়। যাত্রীরা, যাদের কাছ থেকে কিছুই আশা করেননি কবি, সে গরিব যাত্রীরাই যতটুকু সামর্থ্য উজাড় করে দিয়ে গেল মসজিদের দানবাক্সে। 

কবি তো দানের জন্য এ গান গাননি। তাই হাত দিলেন না দানবাক্সের টাকায়। ছিটেফোঁটা যা পড়ল তাঁর তহবন্দে তাতেই সন্তুষ্ট থাকলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মনজুড়ে রইল পড়ে এক অপার্থিব শান্তি কপোতের পক্ষ বিধূনন। 

বেলা আরও চড়ে গেলে ক্যানভাসার হালিম শাহ আর গণক হারাধন বাবু এলেন। কিন্তু ঈদের সকালে কি দুপুরে ইনকাম হলো না আর। সকালের সেই আয়টুকুই ভাগযোগ করে নিল তিনজন। 

দুই বন্ধুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে অল্প টাকায় যতটুকু পারে মেয়ের মসলা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন কবি হাসান আলী। বিকালে আবার আসা যাবে। 

এদিকে দুপুর অবধি বিকালের সেরা রান্নার মানসিক প্রস্তুতিতে কাটল রুকুর। একটু আগে বান্ধবীর থেকে ধার করা মোবাইলে কল দিয়েছেন ‘বাংলা টিভি’র পক্ষ থেকে রুকুর জন্য নির্ধারিত মেন্টর মৃদুল। অদ্ভুত রিনরিনে গলায় বলল মৃদুল- ঈদ মোবারক।
-ঈদ মোবারক।
-ঈদের দিন কেমন কাটছে? 
এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে রুকু? তারা যে গরিব, তাদের বাড়িতে যে কুরবানি হয় না, তা কেমন করে বলে সে। 

কিন্তু আজ বাড়িতে এ লোকটি আসবে। কুরবানির ঈদের মাংস দিয়ে রুকুর রান্না কুরবানির তবারুকের তদারক করবে সে। তারপর রুকুকে নিয়ে, রুকুর রান্নাকে নিয়ে যাবে টিভির প্রতিযোগিতায়- সেরা রাঁধুনি প্রতিযোগিতায়। 
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে রুকু বলল, ভালো। আপনাদের কেমন কাটছে। 

আর বলবেন না, প্রতিযোগিতার প্রস্তুতিতে দিন কাটছে, এমনিতে আমাদের ঘরে পশু কুরবানির চল নেই। বাবা পশু ক্লেশ নিবারণী সভার সভ্য। তবে কুরবানি হলেও অফিস ছেড়ে আজ বাসায় যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই আপনার তবারুকের মাংসেই আজ হবে আমাদের কুরবানির আহার; বিকালের আগেই আমি চলে আসব। 

ঠিক আছে, বলতেই রুকুর লাইন কেটে গেল। 

-কিন্তু কুরবানির মাংস কোথা থেকে আসবে, কোত্থেকে আসবে মসলা আর কীভাবেই-বা মুখ দেখাবে সেই অচেনা মৃদুল নামের যুবককে- সবকিছু রুকুকে আচ্ছন্ন করে রাখল। তার কানে বাজতে লাগল মৃদুলের শেষ কথা, বিকালের আগেই চলে আসব। 

কিছুক্ষণ পুরোনো সাদা-কালো টিভিতে অনুষ্ঠান দেখল সে, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার কানে, মনে বাজতে লাগল সেই রিনরিনে গলা, কেমন মানুষ হবে সে গলার অধিকারী? 

তার নিজের তো বহু দিনের চর্চিত গলা। পিতা কবি, গান লেখেন, গানের সুর দেন আর প্রকৃতির উদাস করা মুহূর্তে নিজে গলা মেলান নিজের দেওয়া সুরে। কিন্তু মেয়েকে নিজের সবটুকু উজাড় করে গান শিখিয়েছেন তিনি, যদিও প্রকাশ্যে গান গাওয়ার ব্যাপারে মেয়ের তীব্র অনীহা। সেই সাধিত গলার পরীক্ষায় একজন টিভি উপস্থাপকের সঙ্গে কেমন করে পারবে তুমি রুকাইয়া বেগম, নিজেকে প্রশ্ন করে রুকু।

নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে দেয় না রুকু। শুধু ভাবে, ভাবতেই থাকে। কিন্তু আচমকা এক অদ্ভুত অনুভবে বিচলিত হয়ে পড়ে সে।

বহুদিন আগের কথা,...
বহুদিনের খর বৈশাখে আদর্শ কলেজের সবুজ প্রকৃতি গৈরিক সন্ন্যাসীর বেশ নিয়েছে। ‘ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল’। প্রকৃতির সঙ্গে ক্যাম্পাসের বাসিন্দারাও এক গণ্ডুষ বৃষ্টির আসায় দিনাতিপাত করছে। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিতা নারী রুকুর তাবৎ প্রেমিককুল বৃষ্টির এন্তেজার করছে যখন শীতল মলয় সমীরে বলবে, কেমন আছ রুকু। 

রুকু এসব জানে। জানে বলে তার সতর্কতায় এতটুকু ঢিলেমি থাকে না। একদিন অনেক অনেক দিনের অপেক্ষার অবসানে বৃষ্টি নেমেছে। রুকুকে কমন রুমে ডেকে নিয়েছেন বাংলার তরুণ শিক্ষক সৈয়দ আফাজ উদ্দিন। রুকু সব জানে, জানে এই শিক্ষকের নয়ন আকাশে তার দর্শনে কেমন করে কামনার বিদ্যুৎ চমকিয়া ওঠে। কিন্তু শিক্ষকের ডাক সে উপেক্ষা করে কীভাবে। রুমে ঢোকার পর শিক্ষক বললেন, বসো রুকু। বসল রুকু। 

কিন্তু শিক্ষক কিছুই বলছেন না। মুহূর্তের পর মুহূর্ত অতিক্রম হলো, কিছুই বললেন না তরুণ শিক্ষক। 
অবশেষে রুকু কোনোমতে বলল, স্যার, আমি কি এখন যেতে পারি? 

শিক্ষক বললেন, যাও। অনেক দিনের রৌদ্রক্লান্ত আমাদের পৃথিবীতে আজ বর্ষা নেমেছে। তাই ভাবলাম এই শুভক্ষণে তোমাকে ডাকি, ডেকে এই বৃষ্টি লগনে তোমার মনের অবস্থার খবর লই। কিন্তু তুমি তো কিছুই বলছ না। 

সুনসান রুমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল রুকু। এ শিক্ষক মানুষটিকে ভালো করে চেনে সে, কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে তিনি যখন ডাকেন, অন্য একজনের এক অলৌকিক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করে সে। এ কি মনের চোখ, না চর্মচক্ষের দর্শন- তা অবশ্য হলফ করে বলতে পারে না রুকু। তবে সে অলৌকিক মানুষের উপস্থিতিতে তার প্রাণের মধ্যে কেমন করে ওঠে। জগতের সব ভয়-ডরের ঊর্ধ্বে উঠে সে মনভরে পৃথিবীর মানুষজনকে, তাদের নিম্নগামী দৃষ্টিকে উপেক্ষার আবিল চোখে দেখতে থাকে। 

জানালার বাইরে সাপচড়া ছাতিমগাছের ছায়াটি লম্বা হয়ে জানালা গলে রুকুর পায়ের কাছে এসে পড়ে। ঝুম বৃষ্টি শেষে পৃথিবী অন্ধকার। আর আদর্শ কলেজের ছাতিমতলায় সেই একজনের বিমূর্ত ছবি রুকুর চোখে উদ্ভাসিত হয়, সে হাসে, কথা বলে। কিন্তু বহুদূর তো- তাঁর সেই কণ্ঠ রুকুর কান অবধি আসতে পারে না। তবে তাঁর রিনরিনে ধ্বনি তাঁর কর্ণকুহরে প্রতিবিম্বিত হতে থাকে প্রতিক্ষণ। 

আজ বহুদিন পর সেই বহুল শ্রুত কণ্ঠস্বর নিজের কানে প্রত্যক্ষ শুনতে পেয়ে বিমূঢ় হয়ে গেল মেয়েটি। 
‘এও কি সম্ভব!’ নিজের ভেতর তড়পায় সে। 

‘আজ এতদিন পর এই পূতদিবসের পবিত্র লগনে আল্লাহ তাঁর ঈপ্সিত মানুষকে মিলিয়ে দিতে যাচ্ছেন’- এমনতর ভাবনা বিশ বৎসর বর্ষীয়া রুকু নামের মেয়েটিকে আশা এবং আশঙ্কার মাঝামাঝি কোনো মোকামে এতটুকু করে রাখল। 

‘কেমন দেখতে হবে সে? নিশ্চয়ই তার চেয়ে অনেক লম্বা হবে। উচ্চশিক্ষিত হবে- সে ব্যাপারে তো সন্দেহ নেই’- ইত্যাকার হাজারো প্রশ্ন তার মস্তিষ্কে জট পাকাতে লাগল। 

কিন্তু সেই জট দীর্ঘ হওয়ার আগেই বাড়ির গেটে কেউ আওয়াজ তুলল। 
গেট খুলতেই এক ঝলক লিলুয়া বাতাসের মতো তার বন্ধু পায়েল তার বুকে ঝুঁকে পড়ে। 
-কি রে, ঈদের দিনে এমন আনমনা যে! যে রাজকুমারীকে আদর্শ কলেজের কোনো ছাত্র-শিক্ষক টলাতে পারেনি, আজ কার কাছে তোর শক্ত হৃদয়কে কুরবানি দিলি? 

রুকুর ভেতরে ভাঙচুর হয়, ‘ও টের পেল কীভাবে?’ তবে মুখে কিছুই বলে না সে; কিন্তু বুঝতে পারে, হয়তো তার চোখে-মুখে ভেতরের ছায়া পড়েছে, তাই মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে-

ঈদের দিন ফাজলামো করিস না। আমাদের মতো মানুষের প্রেম করার সময় আছে নাকি? 
পায়েল কিছুই বলে না। শুধু স্মিত হাসে। রুকুর কপোলে জমা প্রেমরাগ একজন মেয়ে হয়ে তার চোখ এড়াবে কীভাবে! কিন্তু কিছুই বলে না সে।

কলেজের বাইরে এই বন্ধুটির সঙ্গেই রুকুর যা একটু বন্ধুত্ব। একই গ্রামে বাড়ি ওদের। সম্পন্ন গৃহস্থের মেয়ে পায়েল। তবে সবচেয়ে বড় কথা, রুকুদের অবস্থা সে জানে, আর জানে বলেই সে এমন কিছু করে না, পাছে রুকুর মনে কষ্ট জমাট বাঁধে। যেমন অন্য ঈদের মতো আজও সে রুকুর জন্য কুরবানির মাংস নিয়ে এসেছে। সে জানে, রুকুরা কুরবানি করে না, করবার সামর্থ্য নেই, তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিবারের মতো বলল-

বাবাকে কতবার বললাম, পশু কুরবানি না করতে, কে শোনে কার কথা। হজরত ইব্রাহিম তো নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, তাঁর শিশু পুত্রকে কুরবানি দিয়েছিলেন, পারলে নিজের ছেলেমেয়েদের কুরবানি দেন, তা কিন্তু করবে না। এ হচ্ছে এ সমাজের কুরবানির নমুনা।

-আমার বাবা যদি তোর বাবার মতো হতো! তুই বুঝবি নাহ; কত বড় ভাগ্যবতী তুই এরকম পশু কুরবানিবিরোধী বাবা পেয়েছিস।

রুকু চুপ করে থাকে। সে জানে, তার প্রাণের এ বন্ধু তাকে ভালোবেসে এসব বলে। একবার তার মনে হয়, পায়েল হয়তো অন্তর থেকেই চায় পশুবিহীন কুরবানি, সে নিজে অবশ্য চায় একদিন সম্পন্ন গৃহস্থ হলে তার বাবাও গ্রামের সেরা কুরবানি দেবে। ভাবনার এ পর্যায়ে নিজেকে পায়েলের কাছে ছোট মনে হয়।

বন্ধুর হাত ধরে সে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। হরীতকী-বহেরা দিয়ে বানানো তার জাদুর চা খাওয়ায়, আর পায়েল বলতে থাকে-

জানিস তো আম্মুর হাতের রান্না একবারের বেশি দুই বার মুখে তোলা যায় না। তবুও প্রতিদিন খেতে হয়। এইবার আম্মুকে বলে কিছু মাংস নিয়ে এসেছি তোকে দিয়ে রাঁধাব বলে। তুই আর আমি মিলে হাত ডুবিয়ে খাব। সাদা চালের রুটিও এনেছি। দারুণ মজা হবে।

রুকু কোনোমতে কান্না চেপে রাখে। এ যে তাকে কুরবানির মাংস দেওয়ার জন্য পায়েলের বাঁধা গল্প সে বেশ বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, ধনী মানুষেরা কুরবানির থালি নিয়ে গরিবের বাড়ি বাড়ি যেভাবে ভিক্ষার মতো বিতরণ করে তার বিপরীতে পায়েলের এই প্রাণান্ত প্রয়াস।

বন্ধুর বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতায় সে খুশি হয়। কিন্তু নিজের অসামর্থ্যতা তার ভেতরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। আবার নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে, হয়তো আসলেই তার মায়ের রান্না খারাপ।

পায়েল চলে গেলে তার আনীত মাংস নিয়ে বসে রুকু। মাংসের পরিমাণ ভালোই, তবে খাসির মাংস নেই। তার রেসিপির জন্য যে খাসির মাংস লাগবে! কী করবে সে এখন।

পরবর্তী দুই-তিন ঘণ্টা ধরে একের পর এক ধনী গৃহের কাজের লোকেরা ডালিতে সাজানো মাংসের ভাগ দিয়ে গেল তাকেসহ গ্রামের দরিদ্রদের!

রুকুর একবার মনে হলো, এক-একজন লোক তাদের দুয়ারে মাংস নিয়ে আসে আর সবার কাছে তাদের দরিদ্রতা, অপরাগত নতুন করে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। খোদা, কথিত আনন্দের ঈদের দিন তোমার বান্দাদের সঙ্গে এমন খেলা কেন খেলো? কেন খোদা?

চলবে...

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

সপ্তম পর্ব

অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব

দশম পর্ব

একাদশ পর্ব

দ্বাদশ পর্ব

ত্রিয়োদশ পর্ব

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা: কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৫২ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা: কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী মোস্তফা কামাল। তার ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাস অসামান্য এক শিল্পকর্ম। পুরো পৃথিবী যে করোনা আক্রান্ত হয়েছিল, তাতে চেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে উঠেছিল, সেই প্রেক্ষিতে এ দেশের মানুষের জীবনযাপনে কী ভয়াবহ নিস্তব্ধতা, অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার নেমে এসেছিল, সেটাকেই উপজীব্য করে তিনি উপন্যাসটি রচনা করেছেন। এদিক বিবেচনা করলে এটি একটি বিশেষ সময়-পরিস্থিতিনির্ভর উপন্যাস। সে কারণে একে বিশেষায়িত উপন্যাস হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। আমাদের সাহিত্যে উপন্যাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় শাখা। সাহিত্যে উপন্যাস বা কবিতা-গল্প যেটাই হোক, সেখানে নিজের অবস্থান সুনিশ্চিত করতে হলে নিজস্ব স্টাইল তৈরি ও বিষয়বস্তুতে ভিন্নতা ধারণ ব্যতীত সম্ভব নয়। প্যারীচাঁদ মিত্র থেকে শুরু করে এ সময়কাল বিবেচনায় নিলে, যারা খ্যাতিমান হয়েছেন উপন্যাস সাহিত্যে, তারা প্রত্যেকেই নিজস্বতাগুণে অমরত্ব বা কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। মোস্তফা কামালের সাহিত্যকর্ম সেই বিবেচনায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারছে বা পেরেছে, সে বিচার-বিবেচনার সময় এখনো আসেনি। তবে স্বতন্ত্র তীব্র একটা আলো তার সাহিত্যকর্মে যে ছড়ানো, বিভাসিত- তাতে করে তিনি যে কালের যাত্রায় ভিন্নতর সাহিত্যসাধক, তা অনুমান করে নিতে অসুবিধে হয় না। তার উপন্যাসের প্যাটার্ন ও বলার ভঙ্গি একদমই আলাদা। উপন্যাসে শিল্প যে একটা বড় ব্যাপার এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ, মোস্তফা কামালের উপন্যাসে সেটা দারুণভাবে আছে। শুধু গল্পের জন্য গল্প বললে সেটা সার্থক শিল্পকর্ম হয় না। হয়তো পাঠক মেলে। জনপ্রিয়তাও হয়। কিন্তু সাহিত্যগুণ বিচার-বিশ্লেষেণে এসবের গুরুত্ব থাকে না। মোস্তফা কামালের সাহিত্যকর্ম শুধু গল্প বলার জন্য গল্প নয়, সেখানে সুনির্দিষ্ট সুপরিকল্পিত বার্তা থাকে, দর্শন থাকে, উপস্থাপনে মৌলিকত্ব থাকে এবং শিল্পের ব্যবহারে সচেষ্ট ও সচেতন থাকেন তিনি। 

বাংলা উপন্যাসের ধারায় আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। মোস্তফা কামাল সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসের ধারায়, এ সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তার আগেও বাংলা ভাষায় উপন্যাস বা উপন্যাস ধরনের আখ্যান রচিত হয়েছে। হ্যানা ক্যাথরিন ম্যুলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’, প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম বাঙালি লেখক যিনি বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাধারণ সবশ্রেণির পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। তার উপন্যাসের বিষয়বস্তুও ছিল অতীতের লেখকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গঠনশৈলী, ভাষা, বিষয়বস্তু, শৈল্পিকতা- সবদিক থেকে নতুনত্বে পূর্ণ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের মূলত সেখান থেকেই শক্ত ও সফল অভিযাত্রা ঘটে। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বপ্রতিভাও উপন্যাসে প্রথম দিকে বঙ্কিমের জন্মপ্রিয়তার কাছে ম্লান ছিলেন। কিন্তু তার উপন্যাস সবদিক থেকে বঙ্কিম থেকে ভিন্ন ছিল। সময়ের সিঁড়ি ধরে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে একসময় মগ্ন হয়ে ওঠেন বাঙালি পাঠক। বাংলা ছোটগল্পেরও সার্থক সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের হাতে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাস ও গল্প রচনা করে রবীন্দ্রনাথের সময়কালেই তুমুল জনপ্রিয়তা পান। এভাবে মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর বাংলা উপন্যাসে বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলীতে পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও আকবর হোসেনও যে ব্যাপক জনপ্রিয় হতে পেরেছিলেন, তার কারণ তাদের উপন্যাসে বিষয়বস্তু, গঠন ভাষাশৈলীতে পুরো নিজস্বতা বিদ্যমান ছিল। উপন্যাসের এ ধারাবাহিকতায় নিজস্ব শৈলীতে বিখ্যাত হয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, আকবর হোসেন, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, রাজিয়া খাতুন, মাহমুদুল হক, রাবেয়া খাতুন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, জহির, ইমদাদুল হক মিলন-সহ অনেক কথাশিল্পী, তারা উপন্যাসে গতানুগতিক ধারাকে গ্রহণ করেননি। যারা গতানুগতিকতা গ্রহণ করে সাহিত্যকর্ম করেছেন, তাদের সমকালীন অনেকেই বাহবা লাভ করলেও কালের যাত্রায় বিস্মৃত ও অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছেন, তাদের সৃষ্টিকর্ম সেভাবে গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে মেধাবী ও দূরদর্শী যেকোনো কথাশিল্পীই সৃষ্টিকর্মে বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে গঠনপ্রক্রিয়া, শিল্পমান, নিজস্ব বার্তা, সমাজ-সমকাল-রাজনীতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-অর্থনীতি-অবক্ষয় এসব গ্রহণে ও সৃষ্টিশীলতায় সতর্ক থাকেন। যারা বাংলা কথাসাহিত্যে অমরত্ব অর্জন করেছেন তারা মৌলিকত্বে অসম্ভবরকম সচেতন ছিলেন এবং সৃষ্টিকর্মে নিজস্ব ধরন বা স্টাইল প্রতিষ্ঠা করে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিসহ আরও বহু বিচিত্র বিষয় উপন্যাসের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে নিজস্বতা সৃষ্টিতে দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রত্যেকেই নিজস্ব মৌলিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মোস্তফা কামালও সেই জায়গাটিতে অধিকতর সচেতন তার শিল্পকর্মের মৌলিকত্বে ও নিজস্ব স্টাইল নির্মাণে।

বাংলা সাহিত্যে অধিকাংশ উপন্যাসই পারিবারিক-সমাজব্যবস্থা ও রোমান্টিকতাকে কেন্দ্র করে মূল বিষয়বস্তুতে গড়ে ওঠা। রাজনীতি, সমকাল এসব ধারণ করেও যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে দায়বোধ কাজ করেছে বেশি। এ ধরনের উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে লেখকের আত্মসচেতনা ও বিশেষ প্রস্তুতি থাকতে হয়। ইচ্ছে করলেই এ ধরনের উপন্যাস হুট করে লেখা যায় না। লেখককে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেই এ ধরনের উপন্যাস রচনা করতে হয়। সে কারণে বাংলা সাহিত্যে বিশেষায়িত উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের সংখ্যা অপ্রতুল। এর পরও কথা হলো, এসব বিষয়ে যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সার্থক উপন্যাস বা বৃহত্তর ক্যানভাসে কয়টি উপন্যাস রচিত হয়েছে, যেখানে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করা হয়েছে। এগুলো জাতীয় বিষয়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর আগে যে করোনাসংকট তৈরি হয়, তাতে গোটা পৃথিবী একসঙ্গে প্রায় মৃত্যুনগরীতে পরিণত হয়েছিল। এরকম ঘটনা পৃথিবীতে বিরল, যা একই সঙ্গে গোটা পৃথিবীর রোগে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশও স্বাভাবিকভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। করোনায় বাংলাদেশেরও অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাভাবিক জীবনযাপন ভেঙে পড়েছিল। প্রতিদিন স্বজন আত্মীয়হীন করুণ মৃত্যু। এই প্রথম মানুষ বুঝল, মানুষ মূলত একা। এই ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে পৃথিবীতে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। বাংলাদেশেও সৃজনশীল সাহিত্যে অনেক কবি-সাহিত্যেকের উপন্যাস-কবিতা-গল্পে করোনা মূল বিষয়বস্ত হয়ে উঠেছে, সেই সময়কালকে ধারণ এবং সেই সময়কালের মৃত্যু-ভয়াবহতার কঠিনতম যে বাস্তবতা, তা অনেকের সাহিত্যকর্মে যথাযথভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষণীয়। সমকালকে ধারণ না করে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টিও তো অসম্ভব একটি ব্যাপার। মোস্তফা কামাল এ সময়কালে মেধাবী ও নিবেদিত লেখক। করোনাকালীন সময়কালকে ধারণ করে সেই সময়ের বহমাত্রিক কঠিন ও রূঢ় বাস্তবতাকে ধারণ করে ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাস লিখেছেন। এ কাজটি বেশ কঠিন। কারণ তার সময়কালের এ ঘটনা, নিজের দেখা, হয়তো নিজেও অনেকখানি শিকারও। সেটাকে শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করা বেশ কঠিন। কারণ দেখা ঘটনা বা জীবনের কোনো ঘটনা সহজেই বলা যেতে পারে, কিন্তু সেটিকে শিল্পরূপ দিয়ে সর্বজনীন করে মহৎ সাহিত্য নির্মাণ কঠিনই। মোস্তফা কামাল সততা ও ধ্যানীভঙ্গিতে নির্মোহ দৃষ্টিতে করোনাকালীন বাংলাদেশের যে ভয়াবহতা, আর এর ভেতর দিয়েই মানবহৃদয়ের বহুমাত্রিক ক্ষতবিক্ষত স্বরূপটি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আরও বিস্ময়কর, তিনি এ উপন্যাসে নিজের মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্বের প্রকাশ করেছেন। তিনি খুব কৌশলে বলেছেন, চীনের লোকজন ইংরেজি জানে না। জানার প্রয়োজনও মনে করে না। যাদের প্রয়োজন তারা চীনা ভাষা শিখে নেবে। মূলত এর মাধ্যমেই তিনি আমাদের ভাষাপ্রীতির মূল মেসেজটি দিয়ে দিয়েছেন।

বিষাদ বসুধা উপন্যাসের নামকরণে প্রথমেই মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু নামটি স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ  বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসটি এত বছর পরও এখনো বাঙালি পাঠকমনে তরতাজা হয়ে বেঁচে আছে। সে কারণে বিষাদ বসুধা যে বিষাদ-সিন্ধু নামটি মনে করিয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। বিষয়বস্তুতে ও বিরাটত্বে দুটো উপন্যাস একদমই দুই মেরুর। বিষাদ বসুধা ছাড়া অন্য আর কোনো নামও এখানে যৌক্তিক হতো বলে মনে হয় না। উপন্যসটির প্রধান চরিত্র মোহিনীর নামে ভাবা যেতে পারত, কিন্তু বিষয়বস্তুর যে বিরাটত্ব, তাতে ‘মোহিনী’ চরিত্রের মধ্যেও পুরোট ধারণ করা সম্ভব ছিল না। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের নামকরণ রোহিনী হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাধ ঠাকুরের’ চোখের বালি’ উপন্যাসের নাম বিনোদিনী নয়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের নাম অচলা হয়নি, কিংবা ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের নামও তো কপিলা হতে পারত, হয়নি। কারণ কপিলা পুরো উপন্যাসটিকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। একইভাবে আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাসের নামকরণ রোকেয়া হয়নি। অথচ এসব উপন্যাসের এরা প্রত্যেকেই প্রধান চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের বিশালত্বে-বিষয়বস্তুতে-গুরুত্বে এসব চরিত্রকে ছাপিয়ে সর্বজনীন ও অধিক অর্থপূর্ণ নাম এসে নির্বিধায় দখল করে নিয়েছে- এখানেই লেখকের শিল্পমত্তার পরিচয়। মোস্তফা কামাল উপন্যাসটির নামকরণে দুর্দান্ত শিল্পদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।  

উপন্যাসটি পাঠের শুরুতে একটুও অনুধাবন করা যায়নি, এটা করোনাকালীন সময়কালকে ধারণ করে রচিত। উপন্যাসটিতে ৩৪টি অধ্যায় আছে। মোট পৃষ্ঠা ২০৭। ৪৮ পৃষ্ঠায় এসে প্রথম করোনার কথা পাঠককে বললেন লেখক। অথচ উপন্যাসটির মূল উপজীব্য করোনাকে কেন্দ্র করে। কী অদ্ভুত শিল্পশক্তিতে লেখক ধীরে ধীরে করোনাকালীন সময়কালের মধ্যে, কঠিন বাস্তবতার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন, এবং যা খুবই প্রাসঙ্গিকতায়। এক অদ্ভুত কৌশলে পাঠককে তিনি ধাবিত করেন করোনার ভয়াবহতার ভেতর। প্রথম দিকে বিশেষ করে ছয় অধ্যায়ের মধ্যে এসবের ছিটেফোঁটাও নেই। তখন মস্তিষ্কের কোষে কোষে নক করছে ‘চোখের বালি’ কিংবা ‘মাদাম বোভারি’র মতো এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংকট। বিনোদিনী যেমন প্রকাশ্যে না বলে নিজের ভেতর নিজে যেমন অনেক প্রশ্ন তুলেছে-উত্তর খুঁজেছে, বোভারি যেমন অনেক কথাই রোদলফকে না বলে নিজের ভেতর বোঝাপড়া করেছে, মোহিনীও তো ঠিক তাই- নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া-অজস্র প্রশ্ন- আত্মসমালোচনা করেছেন। বহুবার বোঝাপড়া করতে চেয়েছেন আরেফিনের সঙ্গে। এক-দুবার করেছেনও। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-রাগ-অভিমান ক্ষোভ যখন চরমে মোহিনীর, তখনই করোনার কবলে মুষড়ে পড়েন তিনি নিজেই- আরেফিনের জন্য। কারণ আরেফিন তখন চীনের হুবে শহরে অফিসের কাজে। হুবে তখন করোনা আক্রান্ত শহর। করোনায় মরছে মানুষ। যে আরেফিনের প্রতি মোহিনীর এত ক্ষোভ, অভিমান, করোনার খবরে বেদনায় আছড়ে পড়েন নিজের ভেতরে নিজেই। মনস্তাত্ত্বিকতার সঙ্গে লেখক কঠিন এক বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দেন মোহিনীর সঙ্গে পাঠককেও। সেখান থেকে আর কিছু ভাবার সুযোগ থাকে না। প্রবল স্রোতধারায় অসহনীয় এক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে শুধুই ধাবিত হতে হয় সম্মুখে। সেই স্রোতধারার ভেতর প্রেম-প্রণয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, মানবতা,  অমানবিকতা, খাদ্যসংকট, দুর্বিষহ জীবনযাপন, অসংখ্য অযত্ন-অনাদর-অসহায় মৃত্যু- একাত্ম হয়ে ভেসে যায়, সেখান থেকে উজান ঠেলে ফিরে আসা কঠিনের চেয়ে কঠিন- অসম্ভব এক ব্যাপার হয়ে ওঠে।
চলবে...

মৃত্তিকার ঘ্রাণ

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪৬ পিএম
আপডেট: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম
মৃত্তিকার ঘ্রাণ
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুদ

অরুণোদয়ের আগেই উদয় পালের বাড়িতে মৃত্তিকায় তৈরি বাসনকোসন পোড়ানোর ভাটার হাপর জ্বলছে। পালবাড়ির বড় ছেলে রাতুল পাল আর ছেলের বউয়ের ঘুম ভেঙেছে সবার আগে। পালবাড়ির ভেতরে ছোট্ট একটা মন্দির। সেখানে বসে উদয় পালের স্ত্রী মিনতি পাল প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায় শিঙা বাজায়। আজও শিঙা বাজাচ্ছে। বড় ছেলের বউ রেণুকা পাল জ্বলন্ত ভাটার হাপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। করাত কলের গুঁড়ো আর খড়ি যখন একসঙ্গে জ্বলে তখন ভাটার হাপরে দপ্ দপ্ শব্দ হয়। শব্দটা বুকে এসে লাগে রেণুকার। রতন পালের সঙ্গে এক বছর আগে পরিণয় সূত্রে এ বাড়িতে এসেই মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে গেছে রেণুকা। সময় সময় রতন পালের ওপর খুব রাখ হয় রেণুকার। সে ভাবে, লোকটা একেবারেই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে করতে সেও মাটির মতো সর্বংসহা হয়ে গেছে। এত কটু কথা কই, এত বকাঝকা করি তবুও উচ্চবাচ্য করে না। ঘরে আর দুই দিন পরেই লোকটা বলেছিল, শোনো রেণু, মাটি আর সুতা দুটোই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে গেলে ধৈর্য থাকতে হয়, মাটির মতো নরম হতে হয়। সুতার সঙ্গে একই আচরণ করা লাগে। একটু টান লাগলেই সুতা ছিঁড়ে যায়। কুমার আর তাঁতিদের ধৈর্যহারা হলে চলে না। রাগও মাটি করতে হয়। সেদিন থেকেই বুঝে গেছি লোকটার স্বভাব। মানুষ নরম হয়, তাই বলে এত নরম হয়! 

রতন ভাটার হাপরে খড়ি দিচ্ছে। রেণুকার দিকে একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না। দইয়ের মালসা, ঢাকুন, ঢোকসা, হাঁড়িপাতিল পোড়াচ্ছে রতন। বোশেখ মাসে ভাটা বন্ধ থাকে। ভাটায় আগুন জ্বলে না। তার পর বৃষ্টির সময় ঠিকমতো কাজ করা যায় না। শীতকালটা কাজের উপযোগী সময়। এ সময় এঁটেল মাটির অভাব হয় না। মাটি ক্রয় করা, তা কেটে এনে মাটির টিবি বানিয়ে জমা রাখা। এ সময় রাতদিন কাজ করতে হয়। বোশেখ আসার আগেই কলস, কয়েলদানি, খোলা-বালেন, কোলা, মাটির ব্যাংকসহ নিত্যব্যবহার্য বাসনকোসন তৈরি করে ঘরে মজুত করে রাখা লাগে। রেণুকা বাড়িতে আসার পর রতনের শনৈ শনৈ উন্নতি হচ্ছে। রেণুকা ফুলদানি, রঙিন মাছ, খেলনা পুতুল, কলমদানিসহ নানারকম মাটির জিনিস তৈরি করতে পারে। রেণুকার প্রতি পরিবারের সবাই খুশি। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। শ্বশুরবাড়িতে রেণুর ক্ষমতায়ন হয়েছে। তার কথামতো সবকিছু হয়। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুর কথার বাইরে কিছু করে না। এক বছরে সবার মন জয় করে শ্বশুরবাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সে।
রতন অনেকক্ষণ পর রেণুকার দিকে নেত্রপল্লব ফেরালো। রেণুকে অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রতন বলল, কিছু কবা-

-কী কব? তুমি কি কথা কও। বোবার সঙ্গে থাকতি থাকতি বোবা হয়ে যাচ্ছি।

-কাম করব না কতা কব। গত কয় মাসে কী কষ্টই না গেল। এঁটেল মাটি কিনে বাড়িতি আনা, টিবি বানানো, মাটি ছেনা, চড়কায় তোলা, জিনিসপত্র বানানো, কত্ত কাম।
-তুমি বিয়ে করিছিলে ক্যা, কও তো?

-কী সব আবোল-তাবোল কতা কচ্ছ। তুমার কোনোটার কমতি আছে?
-তোমাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই মাটির সঙ্গে আছি। মাটির গন্ধ নিয়ে আছি। মাটি নিয়ে খেলছি। তুমিও তো মাটিরই, তোমার মাটির গন্ধ পাচ্ছি না। তোমাকে নিয়ে খেলার সময় দিলে কই?

-বাব্বা, ভালোই তো কতা শিখিছ। সামনের বোশেখে তুমাক সময় দিব। বোশেখ মাস বিয়ের মাস। দেখতি দেখতি এক বছর হতে চলল। কী খুশি তো?
-তুমি আমাক সময় দিবা, তুমি তো কাঁচা খড়ির মতো জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাও।

-আঘাত দিয়ে কথা কচ্ছ রেণু। তুমাক ভালোবাসি। জানের মিদি রাখি। তুমি আমন কতা কলি বাঁচপো না রেণু।
রেনু এগিয়ে গিয়ে রতনের ঘেমে যাওয়া মুখটা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, 
-আরে বাপু টোকা দিয়ে দেখলাম। মন খারাপ করিছ। ইতিউতি চেয়ে রতনের কপালে আলতো করে চুমো খেল রেণু।

রেণুকার চুমো পেয়েও খুশি ছড়াল না রতনের বিষণ্ন মুখে। করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকালো রেণুকার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল রতন। ভাবনারা এসে মাথার ভিতর নাড়া দিতে লাগল। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সংসারের হাল ধরা। সেই শুরু। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আর পড়া হয়নি। ছোট ভাইটি বিএ পাস করেছে। সে এখন চাকরি করে। বাইরে থাকে। ছোট বোনটা এসএসি পাস করেছে। চাকরিজীবী পাত্রের সঙ্গে বিয়েও হয়েছে। মা সুস্থ থাকলেও বাবাকে দেখতে তার সময় চলে যায়। সংসারের কাজকর্ম করে মাটির কজে সাহায্য করতে হয় রেণুকাকে। তারও কষ্টের অন্ত নেই। সত্যি তো, এক বছরে একদিনের জন্যও রেণুকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। বাড়িতে কাজের চাপ দেখে শ্বশুরও রেণুকাকে না নিয়ে ফিরে গেছে।

দুপুরের পর ভাটায় খড়ি দেওয়া বন্ধ হলে রতন উঠে স্নানের জন্য বাড়ির পাশে নিস্তরঙ্গ ডাকুয়া নদীতে চলে গেল। রেণুর খোঁচামারা কথা শুনে রতন আর কথা বলছে না। রেণুর মনটা ভাটায় পোড়ানো কলসের মতো পোড়ে। উপায়ান্তর না দেখে রেণুও রতনের পেছন পেছন নদীতে গেল। রেণু ভাবে- কাজপাগল লোকটাকে কথার ঘায়ে কষ্ট দিলাম। সাধারণত দুপুরের পরে নদীর ঘাটে স্নান করতে যায় কুমারপাড়ার লোকেরা। এখন ফাঁকা ঘাট। রতনের গা ঘেঁষে বসে রেণুকা। তার পর ভগ্নকণ্ঠে বলে, আরে আমি তো তুমার সঙ্গে ইয়ারকি করতিছিলাম। 

রেণুকার কথা না শোনার ভান করে স্রোতহীন মজা ডাকুয়ার স্বচ্ছ জলের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকল রতন।

মুহূর্তে মুগ্ধতা ছড়িয়ে রতনকে মোহিত করার ক্ষমতা রেণুকা রাখে। সে কেয়া সাবান দিয়ে রতনের মুখ, মাথা ঘষতে লাগল। এর আগেও এ কাজ অনেকবার করেছে রেণুকা। বুক-পিঠে সাবান ঘষতে গিয়ে দুষ্টুমি করে ও। হেসে ফেলে রতন। রতনের প্রাণময় হাসিতে খুশি ছড়ালো রেণুকার মুখে।

রেণুকা রতনের মুখের ওপর মুখ রেখে বলল, ভাটার হাপর ঠাণ্ডা হতে সময় লাগে। দেখলে তো তোমাকে ঠাণ্ডা করে ফেললাম কত অল্প সময়ে।

-আবারও উল্টাপাল্টা কতা কচ্ছ। তুমি আমার চেয়ে বেশি লেখাপড়া জানো ঠিক আছে। দশ ক্লাস পড়িছ। কিন্তু তুমার ঢাকনা দেওয়া কতা বুঝার ক্ষমতা আমার আছে।

সত্যি বলছি। আমি খারাপ অর্থে কিছু বলিনি। তুমি যা বোঝ তা ঠিক নাও হতে পারে। চলো এরপর থেকে আর কোনো 
খুনসুটি নয়।

স্নান সেরে ওরা ডাকুয়া নদীর কূলে ওঠে। রতন আগে, পেছনে রেণু হাঁটছে। রতন বলে, রেণু তুমি সামনে যাও। আমি পেছনে হাঁটি।
-কেন?

-তুমাক দেখতি দেখতি যাই। আর শোনো, আমার দাদু অনেক দিন বেঁচে ছিল। দাদু মজার মজার গল্প করত। কত রকম গল্প। দাদির গল্প বেশি বেশি করত। দাদি তাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। দাদু কইত, কাঁচা মাটির এক রকম গন্ধ, হাত-পা দিয়ে ছেনার পর মাটির এক রকম গন্ধ আর পোড়ালি হয় এক রকম গন্ধ। মাটি ছেনার পর যে গন্ধ মাটি দিয়ে বের হয় সেই গন্ধ নাকি যৈবতী মাটির গন্ধ। ভাটায় ওঠার আগে নাকি মাটির শরীরে যৌবন আসে। গন্ধ ছড়িয়ে যায়। দাদা এসব কতা কইত। এসব কতা বিশ্বাস করো রেণু।
তুমি সবকিছুই বোঝ, শুধু পালবধূর মন বুঝতে পার না। মাটির এত গন্ধের খবর রাখো, ঘরের মাটির খবর রাখো না। দাদার মতো যৈবতী মাটির গন্ধ ভালোবাসতে পারলে না। 

ওদের গা ঘেঁষে প্রতিবেশী মালতি দাদি নদীতে যাওয়ার পথে ভাঙা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, তুরা হচ্চিস পালপাড়ার রাধা-কৃঞ্চ। তোরে দেখে আমার প্রাণডা আইটাই করে, তোর দাদার কতা মনে পড়ে। বুঝলি রেণুবালা, তোর দাদাও রতনের মতো নরম মানুষ ছিল।

-তুমি কী করে বুঝলে রতন নরম মানুষ?

-এই ছেড়ি, পঞ্চাশ বছর পুরুষ মানুষ নিয়ে কাটালাম, আর নরম-গরম বুঝিনে।

এবার যাও, স্নান করগে। কথা বাড়াল না রেণু। ওরা দ্রুত হাঁটা ধরল বাঁশবাগানের সরু পথ দিয়ে।

শুক্লাদ্বাদশী। ঘুম নেই রতনের চোখে। একদিকে রেণুর কথার ঝাল, অন্যদিকে পাড়শি দাদির টিপ্পনি। রতনের মনটা মর্মপীড়ায় বিষণ্ন। বাঁশবাগনে রাত জাগা পাখির করুন আর্তনাদ। মধ্য রাত হবে হয়তো। রতন ভাবে, সকালবেলা ভাটার পোড়ানো মাল নামাতে হবে। ঘরে সাজাতে হবে। বেঁচে যাওয়া মাটির ঢিবি পলিথিন দিয়ে ঢাকতে হবে। চৈত্র মাসের আজ উনত্রিশ দিন। দুই দিন পর থেকে হাতে কাজও নেই। এখন শুধু মালপত্র বিক্রির পালা। বোশেখে ধান ঘরে উঠলি কৃষকরা ধান দিয়ে খোলা-বালেন, ঢাকুন-ঢোকসা কেনে। সারা দিন খাটুনির পর চোখের পাতা এক সময় জোড়া লাগে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রতন। রতন স্বপ্ন পরাবৃত। ও দেখে একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে ঘরের রোয়াকে পত্রাসনের ওপর বসে আছে। পাশে কেউ নেউ। ঘোমটায় ঢাকা তার মুখ। তার চারপাশে হাঁড়ি-কলসির ভাঙা খাপরার কুচি। খাপরার কুচি নিয়ে কী করছে মেয়েটি? রতন মেয়েটির মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। ঘোমটা সরে গেল মেয়েটির মাথা থেকে। পেছনে মুখ করে বসা মেয়েটি। কেশবতী মেয়েটির মাথার কেশগুচ্ছ মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখে রেণুকা বিছানায় নেই। মেয়েটি কী রেণু! বলদেব এসে ভর করে রতনের মাথায়। উদ্বেলিত সে। উজবুকের মতো ও উঠে মেয়েটিকে জাপটে ধরতে গেলে মেয়েটিই উঠে রতনকে জাপটে ধরে। উচ্ছল মেয়েটির তুলোর মতো শরীরের মধ্যে রতন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। ভয়ে রতন চিৎকার দিয়ে ওঠে। সে শব্দে ঘুম ভাঙে রেণুর। রতনকে বুকের সঙ্গে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে- অমন করছ কেন? কী হয়েছে তুমার? রেণুকা রতনকে এমনভাবে আদর করতে থাকে যেন সে শক্তি ফিরে পায়। গভীর ধ্বনি দ্বারা নিনাদিত রেণু। মন্দ্রিত সে। মন্দাকিনীর জলে ভিজে যায় জমিন। অতিশয় আনন্দিত সে। রসোদ্গারের স্মৃতি ভুলে যায় রতন। রতনও সাহসী সুকানি হয়ে ওঠে। এখন সে রূপোন্মাদ। উর্বর মাটিতে ফসল রোয়াতে তৎপর হয়ে ওঠে ও।

কতক্ষণ পর রেণু আলুলায়িত কেশদামে কবরী বাঁধতে বাঁধতে আদরণীয় কণ্ঠে রতনের দিকে স্নিগ্ধ নয়নে চেয়ে বলল, অনুভব করতে পারছ, মৃত্তিকার ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। এতক্ষণে ভাটার চিমনিও ঠাণ্ডা হয়েছে গো। চলো এবার গা শীতল করা ডাকুয়ার জলে যাই। পবিত্র হয়ে ভাটার মালপত্র নামিয়ে ঘরে তুলি।

বিস্ময়াবিভূত রতন রেণুর অত্যুজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জানো, স্বপ্নে দেখা ওই সুন্দরী মেয়েটি আমাকে দৈবশক্তি দান করে গেছে।

-তুমি কী বলছ এসব! ওরে বলদ, তোমার স্বপ্নে দেখা ওই নাগরী মেয়েটি তো আমিই ছিলাম।

ঘোর কাটে না রতনের। অপ্সরীর মতো দেখতে স্বপ্নে দেখা মেয়েটি তার চোখের সামনে ছায়া হয়ে মন্দ্র মাতাল নাচতে থাকল।

কাচের দেয়াল নেই

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪০ পিএম
কাচের দেয়াল নেই

কাচের দেয়াল নেই
তবুও আপনার বুকে শত্রুর গুলি বিঁধে যাবার আগে 
কাচভাঙা বিকট শব্দ আমাদের পাড়ার বাতিগুলো 
নিভিয়ে দিয়ে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এলো দুঃসংবাদ, 
আমরা হতবাক, 
আমাদের নিতান্ত সাধারণ প্রয়োজনগুলোর কপালে ঘামের বিন্দু, 
অপ্রস্তুত জানালা দরজা ভিনদেশি আসবাব
চিৎকার করে উঠলেন মুদিদোকানি চা বিক্রেতা-
মুচি রিকশাচালক পাড়ার নবীন ব্যাচেলর;
আপনি কঁকিয়ে ওঠার আগে কেবিন রেখে বেরিয়ে এলেন নার্স, 
অ্যাপ্রোনে তখনও তার গোলাপ সুবাস,
আপনার বুকের চাতালে ফসল শুকাচ্ছেন কৃষাণ কৃষাণী,  
আপনার চোখ সাঁতরে যাচ্ছেন একদল নাবিক,

কাচের দেয়াল নেই তবুও শত্রুর ফাঁদ
তবুও আপনি চুপচাপ নিশানার কেন্দ্রবিন্দু।

বিশালাক্ষী

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৩৬ পিএম
বিশালাক্ষী

তোমার দেখায় আরেকটি চোখ প্রকাশিত হয়;
যে চোখে পূর্ণিমা জাগে রাতআকাশে,
শুকতারা প্রতীতি জাগায় আর একটি ভোরের।

পাংশু আশপাশ আড়মোড়া ভাঙে
ডাঙায় একটি হরিয়াল শুধু ডেকে যায় কপিশ কন্দরে।

চাওয়া-পাওয়া

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম
চাওয়া-পাওয়া

আমি যখন সকাল চাই
তুই তখন সন্ধ্যা
আমি যখন ফসল চাই
তুই ঊষর বন্ধ্যা

আমি যখন জলের কাছে
আঁজলা পাতি রাত্রে
তুই তখন দূরে কোথাও
নিবিড় ঘন গাত্রে

আমি যখন মরতে বসি
স্বপ্ন নিয়ে চক্ষে
তুই তখন বাহুলগ্না
অন্য কারও বক্ষে

তবু তোকেই চাই যে আমি
ভালোবাসার শর্তে
চাই বাঁচতে তোকে নিয়েই
তোর জন্য মরতে