![শেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/04/05/1712300552.srestho-radhuni-purushkar.jpg)
গত সংখ্যার পর
এসময় হঠাৎ কী ভেবে হালিম শাহের মাইক হাতে নেন কবি হাসান আলী। তার গান এতদিন ধরে হালিম শাহ গেয়ে এসেছেন, গেয়ে মসজিদের জন্য টাকা তুলেছেন, আজ দেখি, কুরবানির এই নির্দয় ভোরে নিজের কণ্ঠে সেই গান কেমন মর্মরিয়া ওঠে। তিনি ধরলেন, কোনো এক উদাসী বিকালে লেখা জীবনের সকালবেলার গান-
একটা গান গাও জুড়াও এ দেহ মন,
দিনে দিনে জীবন ক্ষয় আর যদি না পাই সময়,
কেমন হবে গান ছাড়া সেই আঁধার মরণ।
গানে পাই প্রেম সাথি গানে প্রেমের মালা গাঁথি,
গান ছাড়া প্রেম বালা (হায় রে) গান ছাড়া গাঁথা মালা
শুকাইবে হায় মরুর মতন।
গান দিয়ে শুনি সবি গানে আঁকি প্রেমের ছবি,
গান বিনে শ্রুতি কথা (হায় রে) গান বিনে প্রেম গাঁথা
কে দেখে কে করে শ্রবণ।
স্তব্ধ জনতা, নির্বাক পৃথিবী।
ভোরে, ঈদের দিনের ভোরে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন দরিদ্র চালক। হয়তো তাঁর মতোই হতভাগ্য তাঁর গাড়ির যাত্রীরা। ঈদের আনন্দ নেই তাদের ভাগ্যে। তাই কুরবানির খুশি নয়, পরিজনের সঙ্গে ঈদের ছুটিতে মিলনের ব্যাকুল পিয়াসা তাদের চোখেমুখে উপছায়ে পড়ছিল।
কবি হাসান আলী জানেন, এসব লোকের কাছ থেকে আজ ঈদের চাঁদার বাক্সে কোনো টাকা পড়বে না, তবুও গান তাকে এমন অলৌকিক এক লোকে টেনে নিয়ে গেল, যেখান থেকে মানব লোকে চটজলদি ফিরে আসা সম্ভব নয়। গেয়েই গেলেন তিনি আর চট্টগ্রাম সড়ক অবরুদ্ধ করে মুগ্ধ চালকের সঙ্গে মুগ্ধ যাত্রীর দল রাস্তার ওপর বিহ্বল শুনে গেল সে গান।
গাড়ির লাইন পড়ে গেল মহাসড়কে। কিন্তু কোনো হাঁকডাক নেই। কথা নেই, নিশ্বাস পর্যন্ত নেই। আল ফালাহ মসজিদের ভাঙা মাইক যতটুকু পৌঁছে এক অন্ত্যজ গায়কের গলা বিলোল করে গেল শত শত গ্রামীণ মানুষ-
একটা গান গাও জুড়াও এ দেহ মন...
গান একসময় বন্ধ হলো, কিন্তু গানের রেশ রইল বহুক্ষণ। দূরপাল্লার গাড়িগুলো চলতে লাগল একসময়। যাত্রীরা, যাদের কাছ থেকে কিছুই আশা করেননি কবি, সে গরিব যাত্রীরাই যতটুকু সামর্থ্য উজাড় করে দিয়ে গেল মসজিদের দানবাক্সে।
কবি তো দানের জন্য এ গান গাননি। তাই হাত দিলেন না দানবাক্সের টাকায়। ছিটেফোঁটা যা পড়ল তাঁর তহবন্দে তাতেই সন্তুষ্ট থাকলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মনজুড়ে রইল পড়ে এক অপার্থিব শান্তি কপোতের পক্ষ বিধূনন।
বেলা আরও চড়ে গেলে ক্যানভাসার হালিম শাহ আর গণক হারাধন বাবু এলেন। কিন্তু ঈদের সকালে কি দুপুরে ইনকাম হলো না আর। সকালের সেই আয়টুকুই ভাগযোগ করে নিল তিনজন।
দুই বন্ধুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে অল্প টাকায় যতটুকু পারে মেয়ের মসলা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন কবি হাসান আলী। বিকালে আবার আসা যাবে।
এদিকে দুপুর অবধি বিকালের সেরা রান্নার মানসিক প্রস্তুতিতে কাটল রুকুর। একটু আগে বান্ধবীর থেকে ধার করা মোবাইলে কল দিয়েছেন ‘বাংলা টিভি’র পক্ষ থেকে রুকুর জন্য নির্ধারিত মেন্টর মৃদুল। অদ্ভুত রিনরিনে গলায় বলল মৃদুল- ঈদ মোবারক।
-ঈদ মোবারক।
-ঈদের দিন কেমন কাটছে?
এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে রুকু? তারা যে গরিব, তাদের বাড়িতে যে কুরবানি হয় না, তা কেমন করে বলে সে।
কিন্তু আজ বাড়িতে এ লোকটি আসবে। কুরবানির ঈদের মাংস দিয়ে রুকুর রান্না কুরবানির তবারুকের তদারক করবে সে। তারপর রুকুকে নিয়ে, রুকুর রান্নাকে নিয়ে যাবে টিভির প্রতিযোগিতায়- সেরা রাঁধুনি প্রতিযোগিতায়।
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে রুকু বলল, ভালো। আপনাদের কেমন কাটছে।
আর বলবেন না, প্রতিযোগিতার প্রস্তুতিতে দিন কাটছে, এমনিতে আমাদের ঘরে পশু কুরবানির চল নেই। বাবা পশু ক্লেশ নিবারণী সভার সভ্য। তবে কুরবানি হলেও অফিস ছেড়ে আজ বাসায় যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই আপনার তবারুকের মাংসেই আজ হবে আমাদের কুরবানির আহার; বিকালের আগেই আমি চলে আসব।
ঠিক আছে, বলতেই রুকুর লাইন কেটে গেল।
-কিন্তু কুরবানির মাংস কোথা থেকে আসবে, কোত্থেকে আসবে মসলা আর কীভাবেই-বা মুখ দেখাবে সেই অচেনা মৃদুল নামের যুবককে- সবকিছু রুকুকে আচ্ছন্ন করে রাখল। তার কানে বাজতে লাগল মৃদুলের শেষ কথা, বিকালের আগেই চলে আসব।
কিছুক্ষণ পুরোনো সাদা-কালো টিভিতে অনুষ্ঠান দেখল সে, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার কানে, মনে বাজতে লাগল সেই রিনরিনে গলা, কেমন মানুষ হবে সে গলার অধিকারী?
তার নিজের তো বহু দিনের চর্চিত গলা। পিতা কবি, গান লেখেন, গানের সুর দেন আর প্রকৃতির উদাস করা মুহূর্তে নিজে গলা মেলান নিজের দেওয়া সুরে। কিন্তু মেয়েকে নিজের সবটুকু উজাড় করে গান শিখিয়েছেন তিনি, যদিও প্রকাশ্যে গান গাওয়ার ব্যাপারে মেয়ের তীব্র অনীহা। সেই সাধিত গলার পরীক্ষায় একজন টিভি উপস্থাপকের সঙ্গে কেমন করে পারবে তুমি রুকাইয়া বেগম, নিজেকে প্রশ্ন করে রুকু।
নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে দেয় না রুকু। শুধু ভাবে, ভাবতেই থাকে। কিন্তু আচমকা এক অদ্ভুত অনুভবে বিচলিত হয়ে পড়ে সে।
বহুদিন আগের কথা,...
বহুদিনের খর বৈশাখে আদর্শ কলেজের সবুজ প্রকৃতি গৈরিক সন্ন্যাসীর বেশ নিয়েছে। ‘ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল’। প্রকৃতির সঙ্গে ক্যাম্পাসের বাসিন্দারাও এক গণ্ডুষ বৃষ্টির আসায় দিনাতিপাত করছে। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিতা নারী রুকুর তাবৎ প্রেমিককুল বৃষ্টির এন্তেজার করছে যখন শীতল মলয় সমীরে বলবে, কেমন আছ রুকু।
রুকু এসব জানে। জানে বলে তার সতর্কতায় এতটুকু ঢিলেমি থাকে না। একদিন অনেক অনেক দিনের অপেক্ষার অবসানে বৃষ্টি নেমেছে। রুকুকে কমন রুমে ডেকে নিয়েছেন বাংলার তরুণ শিক্ষক সৈয়দ আফাজ উদ্দিন। রুকু সব জানে, জানে এই শিক্ষকের নয়ন আকাশে তার দর্শনে কেমন করে কামনার বিদ্যুৎ চমকিয়া ওঠে। কিন্তু শিক্ষকের ডাক সে উপেক্ষা করে কীভাবে। রুমে ঢোকার পর শিক্ষক বললেন, বসো রুকু। বসল রুকু।
কিন্তু শিক্ষক কিছুই বলছেন না। মুহূর্তের পর মুহূর্ত অতিক্রম হলো, কিছুই বললেন না তরুণ শিক্ষক।
অবশেষে রুকু কোনোমতে বলল, স্যার, আমি কি এখন যেতে পারি?
শিক্ষক বললেন, যাও। অনেক দিনের রৌদ্রক্লান্ত আমাদের পৃথিবীতে আজ বর্ষা নেমেছে। তাই ভাবলাম এই শুভক্ষণে তোমাকে ডাকি, ডেকে এই বৃষ্টি লগনে তোমার মনের অবস্থার খবর লই। কিন্তু তুমি তো কিছুই বলছ না।
সুনসান রুমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল রুকু। এ শিক্ষক মানুষটিকে ভালো করে চেনে সে, কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে তিনি যখন ডাকেন, অন্য একজনের এক অলৌকিক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করে সে। এ কি মনের চোখ, না চর্মচক্ষের দর্শন- তা অবশ্য হলফ করে বলতে পারে না রুকু। তবে সে অলৌকিক মানুষের উপস্থিতিতে তার প্রাণের মধ্যে কেমন করে ওঠে। জগতের সব ভয়-ডরের ঊর্ধ্বে উঠে সে মনভরে পৃথিবীর মানুষজনকে, তাদের নিম্নগামী দৃষ্টিকে উপেক্ষার আবিল চোখে দেখতে থাকে।
জানালার বাইরে সাপচড়া ছাতিমগাছের ছায়াটি লম্বা হয়ে জানালা গলে রুকুর পায়ের কাছে এসে পড়ে। ঝুম বৃষ্টি শেষে পৃথিবী অন্ধকার। আর আদর্শ কলেজের ছাতিমতলায় সেই একজনের বিমূর্ত ছবি রুকুর চোখে উদ্ভাসিত হয়, সে হাসে, কথা বলে। কিন্তু বহুদূর তো- তাঁর সেই কণ্ঠ রুকুর কান অবধি আসতে পারে না। তবে তাঁর রিনরিনে ধ্বনি তাঁর কর্ণকুহরে প্রতিবিম্বিত হতে থাকে প্রতিক্ষণ।
আজ বহুদিন পর সেই বহুল শ্রুত কণ্ঠস্বর নিজের কানে প্রত্যক্ষ শুনতে পেয়ে বিমূঢ় হয়ে গেল মেয়েটি।
‘এও কি সম্ভব!’ নিজের ভেতর তড়পায় সে।
‘আজ এতদিন পর এই পূতদিবসের পবিত্র লগনে আল্লাহ তাঁর ঈপ্সিত মানুষকে মিলিয়ে দিতে যাচ্ছেন’- এমনতর ভাবনা বিশ বৎসর বর্ষীয়া রুকু নামের মেয়েটিকে আশা এবং আশঙ্কার মাঝামাঝি কোনো মোকামে এতটুকু করে রাখল।
‘কেমন দেখতে হবে সে? নিশ্চয়ই তার চেয়ে অনেক লম্বা হবে। উচ্চশিক্ষিত হবে- সে ব্যাপারে তো সন্দেহ নেই’- ইত্যাকার হাজারো প্রশ্ন তার মস্তিষ্কে জট পাকাতে লাগল।
কিন্তু সেই জট দীর্ঘ হওয়ার আগেই বাড়ির গেটে কেউ আওয়াজ তুলল।
গেট খুলতেই এক ঝলক লিলুয়া বাতাসের মতো তার বন্ধু পায়েল তার বুকে ঝুঁকে পড়ে।
-কি রে, ঈদের দিনে এমন আনমনা যে! যে রাজকুমারীকে আদর্শ কলেজের কোনো ছাত্র-শিক্ষক টলাতে পারেনি, আজ কার কাছে তোর শক্ত হৃদয়কে কুরবানি দিলি?
রুকুর ভেতরে ভাঙচুর হয়, ‘ও টের পেল কীভাবে?’ তবে মুখে কিছুই বলে না সে; কিন্তু বুঝতে পারে, হয়তো তার চোখে-মুখে ভেতরের ছায়া পড়েছে, তাই মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে-
ঈদের দিন ফাজলামো করিস না। আমাদের মতো মানুষের প্রেম করার সময় আছে নাকি?
পায়েল কিছুই বলে না। শুধু স্মিত হাসে। রুকুর কপোলে জমা প্রেমরাগ একজন মেয়ে হয়ে তার চোখ এড়াবে কীভাবে! কিন্তু কিছুই বলে না সে।
কলেজের বাইরে এই বন্ধুটির সঙ্গেই রুকুর যা একটু বন্ধুত্ব। একই গ্রামে বাড়ি ওদের। সম্পন্ন গৃহস্থের মেয়ে পায়েল। তবে সবচেয়ে বড় কথা, রুকুদের অবস্থা সে জানে, আর জানে বলেই সে এমন কিছু করে না, পাছে রুকুর মনে কষ্ট জমাট বাঁধে। যেমন অন্য ঈদের মতো আজও সে রুকুর জন্য কুরবানির মাংস নিয়ে এসেছে। সে জানে, রুকুরা কুরবানি করে না, করবার সামর্থ্য নেই, তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিবারের মতো বলল-
বাবাকে কতবার বললাম, পশু কুরবানি না করতে, কে শোনে কার কথা। হজরত ইব্রাহিম তো নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, তাঁর শিশু পুত্রকে কুরবানি দিয়েছিলেন, পারলে নিজের ছেলেমেয়েদের কুরবানি দেন, তা কিন্তু করবে না। এ হচ্ছে এ সমাজের কুরবানির নমুনা।
-আমার বাবা যদি তোর বাবার মতো হতো! তুই বুঝবি নাহ; কত বড় ভাগ্যবতী তুই এরকম পশু কুরবানিবিরোধী বাবা পেয়েছিস।
রুকু চুপ করে থাকে। সে জানে, তার প্রাণের এ বন্ধু তাকে ভালোবেসে এসব বলে। একবার তার মনে হয়, পায়েল হয়তো অন্তর থেকেই চায় পশুবিহীন কুরবানি, সে নিজে অবশ্য চায় একদিন সম্পন্ন গৃহস্থ হলে তার বাবাও গ্রামের সেরা কুরবানি দেবে। ভাবনার এ পর্যায়ে নিজেকে পায়েলের কাছে ছোট মনে হয়।
বন্ধুর হাত ধরে সে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। হরীতকী-বহেরা দিয়ে বানানো তার জাদুর চা খাওয়ায়, আর পায়েল বলতে থাকে-
জানিস তো আম্মুর হাতের রান্না একবারের বেশি দুই বার মুখে তোলা যায় না। তবুও প্রতিদিন খেতে হয়। এইবার আম্মুকে বলে কিছু মাংস নিয়ে এসেছি তোকে দিয়ে রাঁধাব বলে। তুই আর আমি মিলে হাত ডুবিয়ে খাব। সাদা চালের রুটিও এনেছি। দারুণ মজা হবে।
রুকু কোনোমতে কান্না চেপে রাখে। এ যে তাকে কুরবানির মাংস দেওয়ার জন্য পায়েলের বাঁধা গল্প সে বেশ বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, ধনী মানুষেরা কুরবানির থালি নিয়ে গরিবের বাড়ি বাড়ি যেভাবে ভিক্ষার মতো বিতরণ করে তার বিপরীতে পায়েলের এই প্রাণান্ত প্রয়াস।
বন্ধুর বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতায় সে খুশি হয়। কিন্তু নিজের অসামর্থ্যতা তার ভেতরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। আবার নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে, হয়তো আসলেই তার মায়ের রান্না খারাপ।
পায়েল চলে গেলে তার আনীত মাংস নিয়ে বসে রুকু। মাংসের পরিমাণ ভালোই, তবে খাসির মাংস নেই। তার রেসিপির জন্য যে খাসির মাংস লাগবে! কী করবে সে এখন।
পরবর্তী দুই-তিন ঘণ্টা ধরে একের পর এক ধনী গৃহের কাজের লোকেরা ডালিতে সাজানো মাংসের ভাগ দিয়ে গেল তাকেসহ গ্রামের দরিদ্রদের!
রুকুর একবার মনে হলো, এক-একজন লোক তাদের দুয়ারে মাংস নিয়ে আসে আর সবার কাছে তাদের দরিদ্রতা, অপরাগত নতুন করে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। খোদা, কথিত আনন্দের ঈদের দিন তোমার বান্দাদের সঙ্গে এমন খেলা কেন খেলো? কেন খোদা?
চলবে...