গত সংখ্যার পর
রুকু ছোটবেলা থেকে বাবার এই দরিদ্রতা দেখে আসছে, দেখে আসছে সংবৎসর কোনোমতে ইজ্জত বাঁচিয়ে চলা পরিবারটি ঈদের সময় কেমন করে সমাজের সামনে সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলে।
একটু পর এলো রুকুর আরেক বন্ধু সিমি। রুকু ভালো করেই জানে পায়েলের মতো নয় সিমি, তার একান্ত লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য রুকুকে অপদস্থ করা। আপনা মাংসে হরিণা বৈরীর মতো রুকুর অসহ্য রকম সৌন্দর্য ক্যাম্পাসের ধনীর দুলালিদের শত্রুতে পরিণত করেছে তাকে। সেজন্য রুকু তাদের ওপর রাগ করে না, যদিও তাদের বিশেষত গ্রামের সহপাঠিনী সিমির অপমানজনক আচরণ তার ভেতরে তাজা রক্তনিঃসরণ করে অনুক্ষণ।
সিমি বলল, তোর জন্য মাংস নিয়ে আসলাম।
-বোস।
-বসব না। পাড়ায় মোট পনেরোটি ঘরে কুরবানি হয়নি। সবাইকে মাংস দিতে হবে। তোকে সবার আগে আর সবচেয়ে বেশি দিয়ে গেলাম, যাই।
অপমানে ভেতরটা চূর্ণ হলো রুকুর, কিন্তু মুখে বলল ধন্যবাদ। এই অপমান আর বেইজ্জতি থেকে দূরে যাওয়ার জন্য একবার রুকু ঈদের দিন বাবাকে নিয়ে ঘরে তালা মেরে বাইরে চলে গিয়েছিল। রাত্রে ফিরে দেখে, দুপুরের বাসি মাংস গেটের বাইরে জমা হয়েছে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো কিছু কিছু মাংসের ভাগার ওপর লেখা চিরকুট- শরিয়তে কুরবানির মাংস তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব প্রতিবেশীদের দেওয়ার বিধান আছে। মাংসটুকু গ্রহণ করে দিনের দায়িত্ব পালনে আমাদের পাশে থাকবেন।
রুকু কোনো প্রতিবাদী মেয়ে নয়। নয় সে আল্লাহদ্রোহীও। কিন্তু সেইবার প্রথম এবং বোধ করি শেষবারের মতো সে চিৎকার করে বলেছিল, আল্লাহ, তোমার বান্দারা তোমার নামে এই কি শরিয়ত বানিয়েছে?
তোমার সৃষ্টি এই ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র বান্দাকে তোমার নামে শরিয়ত বানিয়ে যারা দরিদ্র করে রাখে, অপমানিত করে তারা কেমন করে তোমার পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে? কেমন করে? তুমি না অন্যায়ের প্রতিবিধানকারী?
তোমার সৃষ্ট এই ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র বান্দাকে তোমার শরিয়তের জোরে দরিদ্র বানিয়ে অপমান করে কী আনন্দ পাও তুমি? কী আনন্দ পাও?
মেয়ের মুখ চেপে ধরেছিলেন পিতা। বলেছিলেন, না মা, মানুষের বিধানকে আল্লাহর হুকুম ভাবিস নে, মা।
পিতা-পুত্রী দুজনই জানে, আল্লাহর নামে এ মানুষেরই সৃষ্ট বিধিবিধান। তবুও অপমানের তীব্রতা মাত্রা ছাড়ালে অনেক সময় তারা নিজেদের ধরে রাখতে পারে না, তাই তাদের কণ্ঠ প্রতিবাদী হয়। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে তারা গরিব, একান্তই গরিব।
সিমি চলে যাওয়ার পর পুরোনো কথা মনে পড়ায় অনেকক্ষণ থম মেরে বসেছিল রুকু। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল তার দিনের সমস্ত কাজ বাকি পড়ে আছে। নোরাকে খাওয়ানো, ডানাভাঙা কাকটির জন্য দানা ছড়ানো আর বাবার জন্য ভাত রুটি- কত কাজ। তা ছাড়া সে আসবে দুপুরের পর। নিজেকেও একটু পরিপাটি করে থাকতে হবে।
কুরবানির তবারুকের জন্য উঠোনে বসানো মাটির চুলায় ভাত চাপিয়ে দিল রুকু, তারপর বসল সারা দিনে জমা হওয়া মাংস নিয়ে।
গরুর মাংস বেশ কিছু হয়েছে, বিশেষত পায়েল দিয়ে গেছে এক হাঁড়ি, কিন্তু খাসির মাংস টেনে টুনে দুই কেজিও হবে না, তাও পায়ের নিচের অংশ, হাড় সর্বস্ব পিঠের মাংস। টিভির রেসিপি মতো রানের মাংস, কলিজা তন্ন তন্ন করেও পেল না সে। মনে মনে আওড়াল, ভিক্ষের চাল কাঁড়া আর আঁকাড়া। তারপর হাড্ডিসার সে মাংসটুকু ছোট টুকরো করে আমলকী-বহেরার জলে ম্যারিনেট করে বহু কষ্টে জোগাড় করা কিছু মসলা নিয়ে বাকি মসল্লার জন্য বাবার এন্তেজার করতে লাগল।
এক ঘণ্টা কেটে গেল।
কালাসুন্দর মিস্ত্রির ছেলে একবাটি খাসির মাংস দিয়ে গেল, যেখানে একটুকরা কলিজার সন্ধান পাওয়া গেল।
আরও এক ঘণ্টা পর গেটের দরজা খুলে কবি হাসান আলী নত মুখে মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। মেয়ের চাওয়ামতো কিছুই কিনতে পারেননি তিনি। তবে নিজেকে অথবা মেয়েকে সান্ত্বনার ছলে বললেন, ঈদের দিনের সকালে তো সবাই ঘরে থাকে, বিকালের দিকে সবাই রাস্তায় বেরোবে। ভাত খেয়ে বের হব, নিশ্চয়ই মসলার টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। মাংস কতটুকু পেলি মা?
মেয়ে বাবাকে কিছুই বলতে চায়নি। কিন্তু এমন নিরীহ প্রশ্নও কী জানি কেমন করে তার হৃদয়ের একবারে কোমল অংশে গিয়ে আঘাত করল। সে বলল, অনেক মাংস পেয়েছি বাবা। সারা দিন লোকজন এসেছে কুরবানিতে মিশকিনের প্রাপ্য তিন ভাগের এক ভাগের মাংস নিয়ে আর আমি দরজা খুলে তোমার অনুপস্থিতিতে নিজের হাতে তা নিয়েছি। আচ্ছা বাবা, মানুষ জীবনে প্রথমবার যখন ভিক্ষার জন্য হাত প্রসারিত করে, কেমন অনুভূতি হয় তার? তার চেয়েও বড় বাবা, তোমার-আমার যিনি সৃষ্টিকর্তা এমন দৃশ্য দেখে তাঁর কেমন লাগে!
হাসান আলী এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন? বকরির ঈদের দিনে হরীতকীর অম্বল দিয়ে রান্না করা হেলেঞ্চা শাকের ঘণ্ট দিয়ে দু-মুঠো ভাত খেয়ে নীরবে বাড়ি থেকে বাকি মসলা কেনার জন্য বৈকালিক রোজগারের আশায় আবার বেরিয়ে পড়েন।
মেয়ে রুকু দুপুরের ভাত খায় না। এক থালি হাড্ডিসার মাংস আর গুটিকয় মসলার সামনে আনন্দিত ঈদের দিন বেদনার্ত মনে একঠায় বসে থাকে।
আরও এক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়।
একসময় যখন ঘড়ির কাঁটা তিনটা অতিক্রম করল আর লাজুক হাতের করাঘাত পড়ল রুকুদের গেটে। প্রস্তুত হয়ে বসেছিল রুকু। সে গেট খুলে দিলে ভেতরে এসে ঢোকে মৃদুল, কিন্তু ঢোকা মাত্রই তাঁর চোখে পড়ে আজীবনের স্বপ্নচারিণীর মুখ, রুকুরও একই অবস্থা হয়, দুজন দুজনের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে, তাকিয়েই থাকে।
দুজনেরই মনে হলো এই মুখ শয়নে কী স্বপনে নিদ্রায় কী জাগরণে সারা জীবন দেখে এসেছে।
চলবে...