ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সংকটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
সংকটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা

পর্যটন এলাকা মৌলভীবাজারে বসবাস করেন বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন। একসময় তারা নিজস্ব ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানতেন না বা ব্যবহারও করতেন না। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বাংলা মাধ্যমেই করতে হচ্ছে। এতে কমে গেছে তাদের মাতৃভাষার চর্চা। ফলে ক্রমেই সংকটে পড়ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা। সংশ্লিষ্টদের দাবি, নিজস্ব ভাষা রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হোক।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, বড়লেখাসহ সাতটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রয়েছে সংকটে। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি, প্রথা, ইতিহাস ও উৎসব বাঙালিদের মুগ্ধ করলেও চর্চা এবং সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের মাতৃভাষা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৃহত্তর সিলেটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় খাসিয়া, গারো, ত্রিপুরা, মুণ্ডা, সাঁওতাল, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মৈতৈ মণিপুরীসহ বেশ কয়েকটি সম্প্রদায় রয়েছে। এদের বাইরে চা-বাগান এলাকায় প্রায় অর্ধশতাধিক গোষ্ঠী রয়েছে। তার মধ্যে মুণ্ডা, ওঁরাও, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলুগু, তাঁতি, কৈরী, দেশওয়ারা, কুর্মী, চাষা, অলমিক, মোদি, তেলি, পাত্র, রাজবংশী, মোদক, বাড়াইক, ভূমিজসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করেন। তাদের অধিকাংশই পাহাড়-টিলার পাদদেশে, বন-জঙ্গলে কিংবা সমতল ভূমিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনযাপন করছেন। 

চা-শিল্পের সঙ্গে জড়িত এসব নৃগোষ্ঠীর লোকজনের জাতীয় অর্থনীতিতে আছে যথেষ্ট অবদান। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমির অধিকারসহ মাতৃভাষা রক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে এই জনগোষ্ঠী। চা-শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন এস এম শুভ। তিনি জানান, চা-শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক মাতৃভাষা চর্চাকেন্দ্র না থাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষরা তাদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না। তাই চা-বাগান অঞ্চলের মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা ও বিকাশের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

দেওড়াছড়া চা-বাগান এলাকার বাসিন্দা পঁচাত্তর ঊর্ধ্ব নিমাই মুণ্ডা বলেন, ‘আমরা যারা বৃদ্ধ তাদের কয়েকজন নিজেদের ভাষা জানি। পরিবারে থাকলে ছেলেমেয়েরা মুণ্ডা ভাষায় দু-একটি কথা বলে। কিন্তু বাইরে বের হলে নিজেদের ভাষার চর্চা হয় না।’
মাধবপুর মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের যুগ্ম সম্পাদক নির্মল এস পলাশ বলেন, ‘বাংলা ও ইংরেজিতে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় আমাদের মণিপুরীদের ভাষাও সংকটে রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বা একাডেমিক কোনো চর্চার ব্যবস্থা না থাকলে আগামীতে আরও সংকটে পড়বে আমাদের মাতৃভাষা।’ সরকার গৃহীত প্রাথমিক শিক্ষায় নৃ-জনগোষ্ঠীর শিশুদের পাঠ্য কার্যক্রম অচিরেই শুরু করার দাবি জানান তিনি।

কবি সুনীল শৈশব বলেন, রাষ্ট্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষাগত ঐতিহ্য সংরক্ষণে চিরকালই উদাসীন। দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, শ্রমবাজারে নিজেদের সম্পৃক্তকরণ, শিক্ষা কার্যক্রমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা চর্চা না থাকা ইত্যাদি কারণে বহু ভাষা হারিয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোর প্রতি যদি রাষ্ট্র বিশেষ দৃষ্টি ও পরিকল্পনা না করে, তবে সেই সব ভাষা রক্ষা করা কঠিন হবে। যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালোবাসা পায়, তবেই ভাষাগুলো বেঁচে থাকবে। মনে রাখতে হবে, একটি রাষ্ট্রের অলংকার তার বহুমুখী ভাষা-সংস্কৃতির প্রাণময় বৈচিত্র্য।

লেখক ও শিক্ষক জাহাঙ্গীর জয়েস বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে তাদের বিশ্বাস, প্রথা, আচার, জ্ঞান ও সংগীত হারিয়ে যাওয়া। পরিবারে মা, বাবা, ভাইবোন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, সে ভাষায় স্কুলে পড়ানো হয় না। এই নৃগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে তাদের সমাজকে পরিপোষণ করে নির্ভর করে আসছে শ্রুতির ওপর, যার ভরকেন্দ্র হচ্ছে তাদের নিজস্ব ভাষা। তাই ধ্বংসের হুমকির মুখে থাকা ভাষাগুলোর পরিচর্চা, শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় স্কুলে পাঠদানের ব্যবস্থা করা জরুরি।

এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফজলুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার লিখিত বর্ণলিপি নেই, সেই সব ভাষার লিপি তৈরি করা প্রয়োজন। যাদের ভাষার লিপি আছে, তা সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

সোনারগাঁয়ে ঐতিহ্যের আলো

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১১:১৪ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১১:১৪ এএম
সোনারগাঁয়ে ঐতিহ্যের আলো
ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে পানাম নগরীর একাংশ। ছবি: খবরের কাগজ

ঐতিহাসিক স্মৃতিজড়ানো প্রাচীন এক জনপদের নাম সোনারগাঁ। এই অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা আর স্মৃতি-বিস্মৃতির আনন্দ-বেদনার উপাখ্যান। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সোনারগাঁ ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের রাজধানী। 

বছরভর দেশি-বিদেশি অতিথি পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে সোনারগাঁয়ে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার গড়ে আট থেকে দশ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। অনেকে আসেন সবান্ধব, সপরিবারে। সপ্তাহের অন্যান্য দিনে গড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ এখানে আসেন ঐতিহ্যের আলোয় স্নাত হতে।

মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যাসহ বিভিন্ন নদ-নদী বিধৌত এই অঞ্চল যুগ যুগ ধরেই ছিল অজেয়। প্রকৃতিগত কারণেই বহির্শক্তির আক্রমণ থেকে সোনারগাঁ ছিল নিরাপদ এবং সুরক্ষিত। তাই স্বাধীন সুলতানগণ বাংলার রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। মোগল সেনাপতিরা বারবার সোনারগাঁ আক্রমণ করতে এসে পরাজিত এবং পর্যুদস্ত হয়েছিলেন।

ষোল শতকের শেষার্ধে বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর আমলে সোনারগাঁ গৌরব এবং সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে। ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে এখন আর রাজপাট বা রাজত্ব কিছুই নেই। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় কিছু পুরোনো অট্টালিকা, জরাজীর্ণ প্রাসাদ, মসজিদ, মিনার, সমাধি সৌধ ইত্যাদি। অথচ এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘিরেই সুদূর অতীতে ঘটেছিল নানা জমজমাট ঘটনা, রচিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীন শাসকদের শৌর্য-বীর্য আর প্রাচুর্যের উপাখ্যান। এক সময়কার ঐশ্বর্যমণ্ডিত আজকের জীর্ণ-পরিত্যক্ত পানাম নগরী তার অন্যতম স্মৃতি স্মারক। সোনারগাঁয়ে আকাশে-বাতাসে, জরাজীর্ণ প্রতিটি অট্টালিকার ইটের পরতে পরতে আজও যেন ধ্বনিত স্পন্দিত হয় বাংলার গৌরবময় রোমাঞ্চকর ইতিহাসের চাপা দীর্ঘশ্বাস।

সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগাঁও নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। নারায়ণগঞ্জ থেকে আট মাইল উত্তর-পুবে পুরাতন মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আজকের সোনারগাঁ বা সুবর্ণ গ্রাম। সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া একসময় আন্তর্জাতিক নদীবন্দর হিসাবে পরিগণিত ছিল। এই কারণে মুসলিম শাসকদের আমলে সোনারগাঁ অত্যধিক বাণিজ্যিক গুরুত্ব লাভ করে। সে সময় এখানে সমুদ্রগামী জাহাজও ভিড় জমাত। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনেবতুতা, ফা হিয়েন এবং হিউয়েন সাং বঙ্গদেশ সফরে এসে এই মোগড়াপাড়া ঘাটেই অবতরণ করেছিলেন। 

রানি প্রথম এলিজাবেথের দূত রালফ ফিস পনেরো শতকের শেষ দিকে সোনারগাঁয়ে এসেছিলেন। তিনি সোনারগাঁয়ের মসলিন বস্ত্রকে জগতের সর্বাপেক্ষা মিহি বলে অভিহিত করেন। পাল বংশ এবং সেন বংশের হিন্দু নৃপতিগণসহ সোনারগাঁ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুসলিম শাসক এবং সুলতান কর্তৃক শাসিত হয়। তবে সোনারগাঁয়ের সাফল্য সমৃদ্ধি পরিচিতি এবং সুখ্যাতির শেষ নায়ক ছিলেন বীর ঈশা খাঁ। তাই সোনারগাঁয়ের সঙ্গে ঈশা খাঁর নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

বাংলার বার ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন ঈশা খাঁ। তার পিতা রাজপুত বংশোদ্ভূত কালিদাস গজদানী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সোলায়মান নাম ধারণপূর্বক সোনারগাঁয়ের জমিদারি লাভ করেন। তার মৃত্যুর পর লোকশিল্প জাদুঘরে (সর্দারবাড়ী) সুযোগ্য পুত্র ঈশা খাঁ উত্তরাধিকার সূত্রে সোনারগাঁয়ের শাসনভার হাতে নেন। বর্তমানের ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ এবং পাবনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার শাসনাধীনে ছিল। পূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলের বিখ্যাত জমিদার ঈশা খাঁ দীর্ঘকাল ধরে দের আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেন। তার বিরুদ্ধে প্রেরিত বহু সুদক্ষ সেনাপতি তাকে দমন করতে ব্যর্থ হন। রাজা মানসিংহ তার সঙ্গে যুদ্ধে পর্যুদস্ত হন। মানসিংহের পুত্র দুর্জন সিংহ বিক্রমপুরের অনতিদূরে সংঘটিত এক যুদ্ধে ঈশা খাঁর হাতে পরাজিত ও বন্দি হয়ে পরে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ জীবনে ঈশা খাঁ  সম্রাট আকবরের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন। 

১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈশা খাঁর মৃত্যু হলে তার পুত্র মুসা খাঁ পিতার আসনে সমাসীন হন। তিনিও দের অনেক আক্রমণ বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেন। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে সুবেদার ইসলাম খাঁর কাছে তিনি পরাস্ত হন। ইসলাম খাঁর সময় ঢাকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকলে ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক নগরী সোনারগাঁয়ের পতন ঘটে। ইসলাম খাঁ পতনোন্মুখ সোনারগাঁয়ের বদলে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন।

ভুবনমোহিনী মসলিন- অত্যন্ত মিহি সুতোর তৈরি মসলিন বস্ত্রের জন্য একসময় সারা বিশ্বের নজর ছিল সোনারগাঁয়ের দিকে। প্রচণ্ড কদর ছিল মসলিনের। এখান থেকে বিভিন্ন পণ্যাদি সে সময় বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি হত। পানাম নগরের অতি কাছে খাসনগর দিঘী আজও যেন হারিয়ে যাওয়া মসলিনের বিস্মৃতি ও অনুশোচনার তাপে দগ্ধ। এই দিঘীর চারপাশে কারিগররা টানা দিতেন দীর্ঘ মসলিন সুতার। এই সুতা কখনো কখনো ১৭৫ হাত পর্যন্ত লম্বা হতো। বহিরাগত বণিক, লেখক এবং পরিব্রাজকরা মসলিন সম্পর্কে অনেক প্রশংসনীয় মন্তব্য করেছেন। 

সে আমলে বাংলার সুবেদারগণ  বাদশাহদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে মসলিন বস্ত্র পাঠাতেন। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান মসলিনের একজন মুগ্ধ অনুরাগী ছিলেন। পানাম নগর ছিল মসলিন শিল্পের প্রসিদ্ধ বাজার। এখান থেকে এশিয়া, ইউরোপ এমনকি সুদূর আফ্রিকাতেও মসলিন রপ্তানি করা হতো। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী মসলিনও। যেখানে মসলিন শিল্প আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছিল; সে শিল্পের অপমৃত্যুর কথা ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। ইংরেজ আমলের শেষ দিকেই মসলিন শিল্প নিঃশেষিত হয়। জনশ্রুতি আছে, মসলিন শিল্পের ক্রমবিকাশে ঈর্ষান্বিত হয়ে ইংরেজ সরকার তাদের পতনের আগে মসলিন কারিগরদের আঙুলের অগ্রভাগ কেটে দিয়েছিল, যাতে তারা আর মসলিন বুনতে না পারেন।

প্রাচ্যের ব্যাবিলনখ্যাত পানাম নগরী-পানাম ছিল সোনারগাঁয়ের অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরী। বাংলার ঐতিহ্য মসলিন শিল্পকে ঘিরে এই নগরী গড়ে উঠেছিল। ঐতিহ্যবাহী পানাম নগরের কারুকার্যমণ্ডিত ইমারতগুলোর অধিকাংশ অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কালের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে যে কয়েকটি ইমারত এখনো অবশিষ্ট আছে, সেগুলো থেকে ক্রমেই খসে পড়ছে ইট, চুন, সুরকি ও পলেস্তরা। প্রায়ই ধসে পড়ছে কোনো না কোনো প্রাসাদ, মুখ থুবড়ে পড়ছে ভবনের ছাদ। চুরি হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন স্থাপত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পুরাকীর্তি গুঁড়িয়ে ফেলে গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। পাচার হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান পাথর, সমাধিস্থলের দুর্লভ স্মৃতিফলক। 

ঐতিহ্যমণ্ডিত এবং ঐতিহাসিক এই স্থাপনাগুলো অনতিবিলম্বে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে সচেতন সুধীমহল মনে করেন। সেই সঙ্গে এই পুরাকীর্তিগুলো তার পুরোনো কাঠামো এবং আদলেই সংস্কার ও সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন, নয়তো যে কয়েকটি স্থাপনা এখনো অবশিষ্ট আছে, একসময় তার শেষ চিহ্নটুকুও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে এক ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ নগরীর গর্বিত ইতিহাস। 

লোকশিল্প জাদুঘর: শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং সরকারি সাহায্য ও সহযোগিতায় সোনারগাঁয়ের পানাম নগরী এলাকায় একটি লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের শিল্পকলা হচ্ছে লোক ও কারুশিল্প, যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরাট উপাদান। অথচ আমাদের গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য প্রায় বিলুপ্তির পথে ছিল। এককালের পল্লীগীতি, জারি-সারি, ভাটিয়ালী গান, মুর্শিদী গান, পুঁথিপাঠের আসর, মরমী গানের সুর, আউল-বাউলের পদচারণায় মুখর গ্রাম বাংলা, মেলা উৎসবে দক্ষ কারিগরের হাতে গড়া, মাটিরপাত্র, চিত্রিত হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, খেলনা, পাতার বাঁশি, বাঁশের বাঁশি, পল্লীবালার হাতে বোনা নকশিকাঁথা, শীতল পাটি, হাতপাখা, নানা ধরনের সুচিকর্মসহ নানা লোকজ উপাদান যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। শিল্পাচার্যের স্বপ্ন ছিল এগুলো ধরে রেখে আমাদের আবহমান ঐতিহ্যের মর্যাদা দিতে হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিপণন ও পুনরুজ্জীবনই হলো এই ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য। ১৯৭৬ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে পানাম নগরের একটি সরকারি রিকুইজিশন করা পুরোনো ভবন সংস্কার করে ওই ভবনেই লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের কাজ শুরু হয়।

গত ৪৮ বছরে ১৫০ বিঘা জমির ওপর লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে দুটি কারুশিল্প জাদুঘর রয়েছে। (১) লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর (সর্দারবাড়ী)। (২) শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। সর্দারবাড়ীতে স্থাপিত জাদুঘর ভবনে মোট ১০টি গ্যালারি রয়েছে। ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে স্থাপিত শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে মোট ২টি গ্যালারি রয়েছে। দ্বিতল এই আধুনিক ভবনটিতে জাদুঘর ছাড়াও রয়েছে ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক ভবন। জাদুঘরে মোট সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা ৪০১২, গ্যালারিতে প্রদর্শিত নিদর্শন ৯১২টি। স্টোরে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে ৩১০০টি।

লোক ও কারুশিল্পের ওপর গবেষণার প্রয়োজনে এখানে একটি আধুনিক লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টারও গড়ে তোলা হয়েছে। স্থাপত্য নকশা অনুযায়ী এখানে রয়েছে একটি কৃত্রিম আঁকাবাঁকা জলাশয়, যা গ্রামবাংলার খালের বৈশিষ্ট্যের আলোকে নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য সংবলিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও সৃষ্টি করা হয়েছে। নানা তরুলতা, পুষ্পপল্লব শোভিত এবং গাছগাছালি বেষ্টিত এই ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সের সর্বত্রই গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিকল্পিত স্বাক্ষর চোখে পড়ে। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশনে ৬০/৭০ কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। বিশাল আয়তনের এই কমপ্লেক্সের শাশ্বত লোকজ পরিবেশে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর লোক ও কারুশিল্প মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই মেলাকে প্রতি বছরই নানারূপে নতুন আঙ্গিকে শৈল্পিক সাজসজ্জায় উপস্থাপন করা হয়। 

চায়ের রাজ্যে ২০০ বছর

প্রকাশ: ২১ মে ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
আপডেট: ২১ মে ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
চায়ের রাজ্যে ২০০ বছর
চা পাতা তোলা শেষে নির্দিষ্ট স্থানে জমা দিচ্ছেন চা- শ্রমিকরা। ছবি: খবরের কাগজ

ঘুম থেকে উঠেই অনেকের দিন শুরু হয় এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা পান করে। কোনো দিন সকালে এই রুটিনের ব্যতিক্রম হলে সারা দিন যেন কিছুই ভালো লাগে না। সারাক্ষণ মন পড়ে থাকে এক কাপ চায়ের ওপর। চুমুকেই যেন পরিতৃপ্তি। 

পাড়ার গলির চায়ের দোকান হোক বা অফিসের পাশের টঙের দোকান, রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি, বিনোদন, সব ধরনের আলাপ জমে ওঠে চায়ের আড্ডায়। বন্ধু বা পরিচিত মহলে তর্ক-বিতর্কের ঝড় ওঠে চায়ের কাপে। এমনকি অতিথি আপ্যায়নেও এক কাপ চা না সাধলে আপ্যায়ন যেন পরিপূর্ণ হয় না। অনেকে তো এমনও বলে থাকেন যে, দিনে দুই বেলা খাবার না খেলেও চলবে, তবে চা না পান করলে চলবে না।

চায়ের জনপ্রিয়তাকে আমলে নিয়ে চা-প্রেমীদের জন্য গোটা একটি দিন উৎসর্গ করেছে জাতিসংঘ। সেই দিন হলো প্রতিবছর মে মাসের ২১ তারিখ। অর্থাৎ আজকের দিন। 

চা-গাছের আদি নিবাস পূর্ব এশিয়া। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। চীনকে চায়ের জন্মভূমি মনে করা হয়।  ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, মালয়েশিয়া ও উগান্ডা এক হয়ে আন্তর্জাতিক চা দিবস পালন করে। লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী চায়ের সাংস্কৃতিক গুরুত্বের স্বীকৃতি অর্জন এবং এর টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার আরও প্রসারিত করা। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে ২১ মে জাতিসংঘ বিশ্ব চা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২০ সালের ২১ মে জাতিসংঘ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব চা দিবস পালন করে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্র থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৪ জুন  থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসেবে চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। তার সময়ে ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা-গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা দেন। চায়ের উচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গলস্থ ভাড়াউড়া বাগানে উচ্চ ফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তিনি ‘টি অ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা-বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন, যা এখনো চালু রয়েছে।

চা-শিল্পে বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০২১ সাল থেকে ৪ জুন দেশে জাতীয় চা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে।  এ ছাড়া ইতোমধ্যে জাতীয় চা পুরস্কার নীতিমালা ২০২২ অনুমোদিত হয়েছে। চা উৎপাদনের অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে ২০২৩ সালে দেশের ১৬৮টি চা-বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান থেকে রেকর্ড পরিমাণ মোট ১০২.৯২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।  

আলোকচিত্র মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৬ মে ২০২৪, ১২:৫৭ পিএম
আলোকচিত্র মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল
ছবি: খবরের কাগজ

ছবি শুধু ছবি নয়, অনেক সময় কথা বলে, হয়ে ওঠে এক জীবন্ত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে ধারণ করা এমন ৫৩ মর্মস্পর্শী ছবিও যেন স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে জীবন্ত দলিল হিসেবে প্রতীয়মান। পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার পাশাপাশি উদ্বাস্তু এবং উদ্বাস্তু শিবিরের মানবিক গল্পগুলো এসব ছবিতে চিরন্তন ও প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে।

রবিবার (৫ মে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা ইনস্টিটিউটের জয়নুল আর্ট গ্যালারিতে ভারতীয় আলোকচিত্রী রঘু রাইয়ের তোলা মর্মস্পর্শী এমন ৫৩টি ছবি নিয়ে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাবি ও দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের (ডিবিএফ) যৌথ ব্যবস্থাপনায় ‘রাইজ অব নেশন’ শীর্ষক ওই আলোচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ১৫ দিনের ওই প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন।

অনুষদের ওসমান জামাল মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে এ দেশের মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সে দেশের জনগণ যেভাবে তাদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই চিত্র যারা স্বচক্ষে দেখেননি তাদের বুঝানো খুব কঠিন। বরেণ্য চিত্রশিল্পী রঘু রাই সে সময় মানুষের নিদারুণ কষ্ট, জীবন বাঁচানোর যে আকুতি, সেটি ফুটিয়ে তুলেছেন।’

তিনি বলেন, “আমরা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করছি। আমার মনে হয় রঘু রাইয়ের অ্যালবাম ‘রাইজ অব এ নেশন’ এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথা ইতিহাস নিয়ে নানা সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু এর বিপরীতে থাকা যুদ্ধাপরাধী আলবদর-আলশামসদের আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। যেকোনো জিনিস এক তরফা হলে স্থায়িত্ব থাকে না। আমি আহ্বান জানাব, একদিকে বীরত্বের কথা এবং অন্যদিকে এর বিপক্ষে থাকাদের নিয়ে আলোচনা রাখতে হবে। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপলব্ধি আসবে তারা কোন পক্ষে অবস্থান নেবে।”

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘আমরা সীমিত পরিসরে থেকে বিশ্বমানের ছবি উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছি। এই প্রদর্শনী চারুকলা অনুষদের ৭৬ বছরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

প্রদর্শনীর কিউরেটর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জিহান করীম বলেন, ‘প্রখ্যাত ভারতীয় আলোকচিত্রশিল্পী রঘু রাই তার ক্যামেরায় অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি মর্মস্পর্শী করুণ কাব্যিক রূপ ধারণ করেছেন। ছবিতে হানাদারদের বর্বরতার পাশাপাশি সেখানে উদ্বাস্তু এবং উদ্বাস্তু শিবিরের গভীর মানবিক গল্পগুলো ধরা পড়েছে, চিরন্তন হয়ে উঠেছে ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলো। সীমিত সংস্থান নিয়ে অস্থায়ী শিবিরে আটকে থাকা উদ্বাস্তুদের দুর্দশা রাইয়ের ছবিতে ভিন্ন ব্যঞ্জনা পেয়েছে, করুণ নির্মম একটি অন্ধকার অনুচ্ছেদের ওপর তিনি মানবিক আলো ফেলেছেন।’

নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সভাপতিত্বে ও চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান নাসিমুল খবিরের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারোয়ার আলী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের উপাচার্য ড. রুবানা হক, দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা দুর্জয় রহমান, স্কয়ার গ্রুপের ডিরেক্টর অঞ্জন চৌধুরী প্রমুখ।

আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন এবং ঘুরে দেখেন। প্রদর্শনীটি আগামী ১৯ মে পর্যন্ত বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জয়নুল গ্যলারিতে প্রদর্শিত হবে।

বলীখেলা ঘিরে জমে উঠেছে লালদিঘী পাড়ের বৈশাখী মেলা

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৫২ এএম
আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১১ পিএম
বলীখেলা ঘিরে জমে উঠেছে লালদিঘী পাড়ের বৈশাখী মেলা

চট্টগ্রামের লালদিঘী পাড়ে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলাকে কেন্দ্র করে বসা বৈশাখী মেলা জমে ওঠেছে। ইতোমধ্যে নগরের আন্দরকিল্লা মোড় থেকে হাজারী গলি হয়ে টেরীবাজার, লালদিঘী পাড়, কে সি দে রোড, সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে অন্তত এক হাজার দোকান বসেছে। এসব দোকানে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ক্রেতারাও ভিড় করতে শুরু করেছেন জিনিসপত্র কিনতে।

বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) বিকেল ৪টা থেকে শুরু হবে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার ১১৫তম আসর। তবে মেলা চলবে শুক্রবার পর্যন্ত। 

ইতোমধ্যে বলীখেলাকে ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে আয়োজক কমিটি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এবারও দেড় শতাধিক বলী এই খেলায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। বলীখেলা উপলক্ষে নগরীর আন্দরকিল্লা, লালদিঘী, পুরাতন টেলিগ্রাফ রোড, নিউমার্কেট, জহুর মার্কেট, মহল মার্কেট মোড়সহ আশপাশের এলাকার যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে নগর পুলিশ। 

লাখো মানুষের সমাগম হবে এই বলীখেলা ও বৈশাখী মেলায়, এমনটাই আশা করছেন আয়োজক কমিটি। 

সরেজমিন মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে মেলার স্থানে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর আন্দরকিল্লা মোড় থেকে লালদিঘী পাড়, কে সি দে রোড, হাজারী গলির দুই মুখ, সিনেমা প্যালেস, মহল মার্কেট পর্যন্ত আশপাশের দুই কিলোমিটার পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে সারি সারি অসংখ্য দোকান বসেছে। কেউ বাঁশ-বেতের তৈরি কুলা, ঢালা, ঝুড়ি, মোড়া, মাছ ধরার চাঁইসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করছেন। আবার কেউ তালপাতার তৈরি হাতপাখা, কেউ মাটির তৈরি তৈজসপত্র (মাটির ব্যাংক, বাসন, জগ, থালা, ফুলদানি) বিক্রি করছেন। আবার কেউ শীতল পাটি ও বাঁশের বাঁশির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। আবার কেউ কেউ বড় বড় চটের বস্তায় রংবেরঙের আঙ্গুলি খাবার বিক্রি করছেন। 

আগামীকাল বলীখেলা হলেও এক দিন আগেই জমে উঠেছে বৈশাখী মেলা। মেলায় ঘুরে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে। বিশেষ করে মাটির তৈরি জিনিসপত্র, শীতল পাটি, ফুলের ঝাড়ু, ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে দোকানে নারী ও পুরুষ ক্রেতাদের সমাগম সবচেয়ে বেশি। বেচাকেনাও চলছে হরদম। 

তীব্র রোদের খরতাপে মেলায় আগতদের কেউ ক্লান্ত হয়ে বেল, লেবুর শরবত পান করছেন, কেউবা খাচ্ছেন কুলফি, মালাই আইসক্রিম। 

সড়কের ধারে বসা এসব দোকানে কেউ যেন কোনো চাঁদা নিতে না পারে সেজন্য মেলার আয়োজক কমিটি বারবার মাইকে ঘোষণা দিচ্ছেন। আয়োজকদের নামে কেউ যদি চাঁদা দাবি করে তাহলে তাদের থানায় সোপর্দ করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। 

নরসিংদী জেলা থেকে বেতের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে এসেছেন খোকন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, আমি বাড়িতে তৈরি ঢালা, কুলা, পাখা, ঝাড়ুসহ হরেক রকম জিনিসপত্র এনেছি। আশা করি আশানুরূপ বিক্রি হবে। 

দিনাজপুর থেকে শিমুল তুলা বিক্রি করতে এসেছেন জামাল হোসেন ভুঁইয়া। তিনি বলেন, আমরা দিনাজপুরে নিজস্ব বাগানে তুলা চাষ করি। সেই তুলা তুলে নানা প্রক্রিয়ার পর মেলায় আনি। কেজি ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করছি শিমুল তুলা। 

হরিপদ দাশ বলেন, তিনি গাজীপুর থেকে এসেছেন মাটি তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে। দেশের নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে মেলা করায় তার পেশা। ৩০ বছর ধরে তিনি চট্টগ্রামের জব্বারের বলীখেলাকে ঘিরে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় দোকান করেন। 

জানা যায়, গতবার ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার ১১৪তম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই আসরে চ্যাম্পিয়ন হন কুমিল্লার শাহজালাল বলি। আর রানার্সআপ হয়েছিলেন চকরিয়ার তারেকুল ইসলাম জীবন। 

তার আগের আসরে জীবন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। আর শাহজালাল হয়েছিলেন রানার্সআপ। 

১১৪তম আসরে তারা দুজন সাত মিনিট ধরে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। বলীখেলায় চ্যাম্পিয়নকে দেওয়া হয় বিজয় ট্রফিসহ ৩০ হাজার টাকা প্রাইজমানি, দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থকে দেওয়া হয় যথাক্রমে ২০ হাজার, ১০ হাজার ও ৫ হাজার টাকা আর ট্রফি।

মনির/অমিয়/

ডামুড্যায় ২০০ বছর পুরোনো মাছ ধরা উৎসব

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
ডামুড্যায় ২০০ বছর পুরোনো মাছ ধরা উৎসব
ডামুড্যায় ২০০ বছর পুরোনো মাছ ধরা উৎসব চলছে। ছবি: খবরের কাগজ

শরীয়তপুর ডামুড্যায় দক্ষিণ সূতলকাঠি এলাকায় হয়ে গেল দিনব্যাপী মাছ ধরা উৎসব। সকাল থেকে মাছ ধরা উৎসবে অংশগ্রহণ করেন ১১০ জন জেলে। ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে ৩২টি পরিবার আয়োজন করে আসছে এ উৎসব। 

শনিবার (২০ এপ্রিল) এ উৎসব ঘিরে আনন্দ মেতে ওঠেন এলাকাবাসী। এ মাছ ধরা উৎসব দেখতে দূর-দূরান্ত ও আত্মীয়-স্বজনসহ হাজারো মানুষ ভিড় করেন পুকুরের চারপাশে।

প্রতি বছরের মতো এবারও মাছ ধরা উৎসব উপলক্ষে বসেছিল মেলা।

সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর ইউনিয়নের সূতলকাঠির ফোরকার পার এলাকায় একটি পুকুরে সৌখিন শিকারিরা প্রতিটি জালের জন্য দেড় থেকে দুই হাজার টাকা টিকিট কেটে মাছ ধরছেন। শতাধিক শিকারি ওই পুকুরে নৌকা, কলাগাছের ভেলা দিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাছ ধরেন। এই মাছ ধরা উৎসব দেখতে বিভিন্ন গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ ভিড় করেন। 

উৎসবে শিকারিদের অনেকেই নানা প্রজাতির মাছ ধরেছেন। পানিতে জাল টেনে হইহুল্লোড় আর উল্লাসে মাছ ধরেন তারা। এই মাছ ধরা দেখতে অনেকের আত্মীয়-স্বজনরা এখানে বেড়াতে এসেছেন। 

মাছ ধরা উৎসবে আসা আল-আমিন নামে একজন বলেন, ‘প্রতি বছর এই আয়োজন করা হয়ে থাকে। আমরা এখানে আসি। মাছ ধরা দেখতে খুব ভালো লাগে। দেখে মনে হয় বাঙালির চিরচেনা সেই ঐতিহ্য ফিরে এসেছে।’

শিকারিদের অনেকেই রুই, কাতলা, চিতল, ফলি, তেলাপিয়া, বিভিন্ন ধরনের কার্প মাছসহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির মাছ ধরেন। কেউ কেউ একাধিক ধরলেও কেউ ফিরেন সামান্য মাছ নিয়ে। যারা বড় মাছ শিকার করেছেন তাদের চোখে মুখে ছিল আনন্দের ছাপ।

তবে মাছ শিকারিরা বলেন, মাছ পাওয়া বড় বিষয় নয়; এখানে অংশ নিয়েছি এটাই আনন্দের।

সৌখিন মৎস্য শিকারি রুহুল আমিন বলেন, ‘মাছ ধরতে আমার ভালো লাগে। অনেক মাছ পেয়েছি। তাই খুশি একটু বেশিই।’

উৎসবের আয়োজক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘গ্রাম বাংলার মাছ ধরার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এ মৎস্য শিকার উৎসবের আয়োজন করা। এটা ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। আমরা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।’

কনেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও এ মাছ ধরা উৎসবের আয়োজন করা। এ আয়োজন মাধ্যমে সৌখিন মাছ শিকারি ও এলাকাবাসীদের ভেতরে এক ধরনের আনন্দ বিরাজ করে। আমি আশা করব এই আয়োজন যেন অব্যহত থাকে।’

রাজিব হোসেন/অমিয়/